আদিবাসীদের নিয়ে বহুলতম বিভ্রান্তি :: ফিরোজ আহমেদ
আদিবাসীদের নিয়ে বহুলতম প্রচারিত বিভ্রান্তিটি হলো কে কত বছর ধরে এই মুল্লুকে বসবাস করছে, তা নিয়ে টানহ্যাচড়া।
মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্র বস্তুটাই অনেক নতুন। আদিবাসী হলো সে যে একটা অঞ্চলে তার ঐতিহ্যিক জীবনযাপন করছে, তার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তার জীবিকা গড়ে তুলেছে। মনিপুরী সম্প্রদায় কত বছর আগে মনিপুর থেকে সিলেটে এসেছে, সেটা ইতিহাসে বাঙালি শব্দটার পয়লাবার উল্লেখের আগে না পড়ে, সেটা গোনার বিষয় না। বিষয় হলো সে নির্দিষ্ট ওই অঞ্চলটিকে আবাদ করেছে, এবং তার পরম্পরা বিদ্যমান। একই কথা প্রযোজ্য মারমা কি রাখাইন, চাকমা কি গারো সকলের জন্য। সে সময়ে এই রাষ্ট্র ঠিক এই ধারণা নিয়ে বিদ্যমান ছিল না, ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোতে অধিকাংশ স্থলে তার কোন এখতিয়ার বা উপস্থিতি ছিল না। কোন কোন ক্ষেত্রে, যেমন সাঁওতালদের বেলায়, রাষ্ট্র উপস্থিত থাকলেও সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ওই অনাবাদী অঞ্চলগুলোকে তাদের উৎপাদিকা শক্তির বিপুল ব্যায়ে কয়েক প্রজন্ম ধরে সেই বিরাণভূমিগুলোকে বসতি করেছে। ফলে তারও একটা ঐতিহ্যিক ও পরম্পরাগত দাবি অটুট আছে।
ইতিহাসের ধারায় সকল অঞ্চলেই বহু জাতি আরও বহু জাতিকে উচ্ছেদ করেছে, কেউ আগে এসেছে বা কেউ পড়ে এসেছে। কেউ রাষ্ট্র গঠন করেছে, কেউ প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ জীবনে অপরিবর্তিত রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে অজস্র জাতি মিলে একটি বৃহৎ জাতি গঠন করেছে, যেমন বাঙালি। ইতিহাসখ্যাত পুণ্ড্রদের বাস এই অঞ্চলে ছিল, কিন্তু তারা বাঙালি ছিল, এমন প্রমাণ কেউ হাজির করেনি। কাহার-কিরাত-ডোম-নিষাদ-কৈবর্তসমেত অজস্র আদিবাসী জাতি ও গোষ্ঠীর উত্তরাধিকার আমরা। সম্প্রতিক কয়েকশ বছরের ইতিহাসে কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ বাঙালি জনগোষ্ঠির সাথে মিশে গিয়েছে, একটা অংশ তাদের জাতিগত পরিচয় অক্ষুন্ণ রেখেছে।
কথা হলো এই যে, রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু এই শক্তিতে মদমত্ত হয়ে আর সব জাতির ওপর হামলা-নিপীড়নকে বৈধ করা, তাদের অস্তিস্ব অস্বীকার করা, সে বিষয়ে নীরব থাকা অসুস্থতম হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ। এটা শুধু আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতাই দেয় না, নিজ জনগোষ্ঠীরও বৃহৎ অংশ যে নিপীড়িতই আছে, তারও নিদর্শন। নিজের জনগোষ্ঠীর সঙ্কটের কোন যথাযথ রূপরেখা মাথায় ছিল না বলেই রাষ্ট্রের একদল মাতব্বর তাদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছেন, আরেকদল তারই ধারাবাহিকতায় বন্দুকের জোরে সমাধান করতে চেয়েছেন। দখলকাণ্ডেও কেউ পিছিয়ে নেই এক পাও।
আমাদের জমির সমস্যা, আমাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা, আমাদের জনসংখ্যার সমস্যা আমরা যদি নিজেদের জমিতে মেটাতে না পারি, শেষ পাহাড়টাকে খুড়ে ফেলে, শেষ অরণ্যটাকে ভূমিহীনদের জন্য ইজারা দিয়ে, শেষ বৃক্ষটাকে আসবাব বানিয়েও তা সমাধান করতে পারবো না। কিন্তু এই উচ্ছেদের প্রক্রিয়াতে যে মুনাফাটা তৈরি হয়, তারই লালসায় লুটেরারা সাধারণ উপায়হীন মানুষগুলোকে ঠেলে দেয় আদিবাসীদের বসত ভিটায়।
অন্তত এটুকু মনে রাখলেই চলবে, আদিবাসী মানে হজরত আদমের সময় থেকে বাস করা না, অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বমান থাকা না। আদিবাসী মানে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটা ঐতিহ্যিক জীবিকার সংস্থান, ভাষা-সংস্কৃতির পরম্পরাগত বিকাশ, প্রকৃতির ওপর ক্রিয়া করে একটা স্বতন্ত্র পরিমণ্ডল নির্মাণ করার একটা জনগোষ্ঠী।
আদিবাসীদের নিয়ে একটা মর্মান্তিক স্মৃতির কথা বলি, আগেও একবার লিখেছিলাম এটার কথা।
এমনিতেই জমজমাট মেলা, তাও বারোয়ারী পুজামণ্ডপে স্থানীয় সাঁওতাল নারীরা দলবেধে এসে নেচে-গেয়ে ভক্তি নিবেদন করে ফেরত যায় এই দৃশ্যটার জন্য বিশেষভাবে অপেক্ষা করে সকলে। তো, বছর দুয়েক আগে সেবারই তারা প্রথমবার আসেনি। কেউ বলছেন ওরা এখন ইশকুলে যায়, আগের দিন কি আর আছে। কারও আক্ষেপ এত বছরের একটা ঐতিহ্য!
অদ্ভুদ অভিজ্ঞতাটা হলো সন্ধ্যায় দিকে। পোষাক আশাকে বোঝা গেল স্থানীয়, তিনজনই টলছে, একজন মৃদু জড়ানো গলায় শুধোচ্ছে কি রে, তোদের মেয়েরা যে এবার আসলো না যে? এত মানুষ দেখতে আসলো... যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সে একদম চুর, পাটকাঠির মত শরীর, গা শিওরানো সেই উত্তরটা দিলো: মোসলমানের দ্যাশ, হেদুগোর পুজা, সাঁওতালের কি!
বাঙালির দেশে ধর্ম বিভাজন, বর্ণবিভাজনেরও বাইরে আর যে একটা অস্তিত্বহীনতার উপলদ্ধি বরাদ্দ আছে বাকি জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য, সেইটার মত অসহায়ত্ব বোধহয় আর কোনকিছুতে নাই।
মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্র বস্তুটাই অনেক নতুন। আদিবাসী হলো সে যে একটা অঞ্চলে তার ঐতিহ্যিক জীবনযাপন করছে, তার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তার জীবিকা গড়ে তুলেছে। মনিপুরী সম্প্রদায় কত বছর আগে মনিপুর থেকে সিলেটে এসেছে, সেটা ইতিহাসে বাঙালি শব্দটার পয়লাবার উল্লেখের আগে না পড়ে, সেটা গোনার বিষয় না। বিষয় হলো সে নির্দিষ্ট ওই অঞ্চলটিকে আবাদ করেছে, এবং তার পরম্পরা বিদ্যমান। একই কথা প্রযোজ্য মারমা কি রাখাইন, চাকমা কি গারো সকলের জন্য। সে সময়ে এই রাষ্ট্র ঠিক এই ধারণা নিয়ে বিদ্যমান ছিল না, ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোতে অধিকাংশ স্থলে তার কোন এখতিয়ার বা উপস্থিতি ছিল না। কোন কোন ক্ষেত্রে, যেমন সাঁওতালদের বেলায়, রাষ্ট্র উপস্থিত থাকলেও সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ওই অনাবাদী অঞ্চলগুলোকে তাদের উৎপাদিকা শক্তির বিপুল ব্যায়ে কয়েক প্রজন্ম ধরে সেই বিরাণভূমিগুলোকে বসতি করেছে। ফলে তারও একটা ঐতিহ্যিক ও পরম্পরাগত দাবি অটুট আছে।
ইতিহাসের ধারায় সকল অঞ্চলেই বহু জাতি আরও বহু জাতিকে উচ্ছেদ করেছে, কেউ আগে এসেছে বা কেউ পড়ে এসেছে। কেউ রাষ্ট্র গঠন করেছে, কেউ প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ জীবনে অপরিবর্তিত রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে অজস্র জাতি মিলে একটি বৃহৎ জাতি গঠন করেছে, যেমন বাঙালি। ইতিহাসখ্যাত পুণ্ড্রদের বাস এই অঞ্চলে ছিল, কিন্তু তারা বাঙালি ছিল, এমন প্রমাণ কেউ হাজির করেনি। কাহার-কিরাত-ডোম-নিষাদ-কৈবর্তসমেত অজস্র আদিবাসী জাতি ও গোষ্ঠীর উত্তরাধিকার আমরা। সম্প্রতিক কয়েকশ বছরের ইতিহাসে কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ বাঙালি জনগোষ্ঠির সাথে মিশে গিয়েছে, একটা অংশ তাদের জাতিগত পরিচয় অক্ষুন্ণ রেখেছে।
কথা হলো এই যে, রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু এই শক্তিতে মদমত্ত হয়ে আর সব জাতির ওপর হামলা-নিপীড়নকে বৈধ করা, তাদের অস্তিস্ব অস্বীকার করা, সে বিষয়ে নীরব থাকা অসুস্থতম হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ। এটা শুধু আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতাই দেয় না, নিজ জনগোষ্ঠীরও বৃহৎ অংশ যে নিপীড়িতই আছে, তারও নিদর্শন। নিজের জনগোষ্ঠীর সঙ্কটের কোন যথাযথ রূপরেখা মাথায় ছিল না বলেই রাষ্ট্রের একদল মাতব্বর তাদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছেন, আরেকদল তারই ধারাবাহিকতায় বন্দুকের জোরে সমাধান করতে চেয়েছেন। দখলকাণ্ডেও কেউ পিছিয়ে নেই এক পাও।
আমাদের জমির সমস্যা, আমাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা, আমাদের জনসংখ্যার সমস্যা আমরা যদি নিজেদের জমিতে মেটাতে না পারি, শেষ পাহাড়টাকে খুড়ে ফেলে, শেষ অরণ্যটাকে ভূমিহীনদের জন্য ইজারা দিয়ে, শেষ বৃক্ষটাকে আসবাব বানিয়েও তা সমাধান করতে পারবো না। কিন্তু এই উচ্ছেদের প্রক্রিয়াতে যে মুনাফাটা তৈরি হয়, তারই লালসায় লুটেরারা সাধারণ উপায়হীন মানুষগুলোকে ঠেলে দেয় আদিবাসীদের বসত ভিটায়।
অন্তত এটুকু মনে রাখলেই চলবে, আদিবাসী মানে হজরত আদমের সময় থেকে বাস করা না, অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বমান থাকা না। আদিবাসী মানে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটা ঐতিহ্যিক জীবিকার সংস্থান, ভাষা-সংস্কৃতির পরম্পরাগত বিকাশ, প্রকৃতির ওপর ক্রিয়া করে একটা স্বতন্ত্র পরিমণ্ডল নির্মাণ করার একটা জনগোষ্ঠী।
আদিবাসীদের নিয়ে একটা মর্মান্তিক স্মৃতির কথা বলি, আগেও একবার লিখেছিলাম এটার কথা।
এমনিতেই জমজমাট মেলা, তাও বারোয়ারী পুজামণ্ডপে স্থানীয় সাঁওতাল নারীরা দলবেধে এসে নেচে-গেয়ে ভক্তি নিবেদন করে ফেরত যায় এই দৃশ্যটার জন্য বিশেষভাবে অপেক্ষা করে সকলে। তো, বছর দুয়েক আগে সেবারই তারা প্রথমবার আসেনি। কেউ বলছেন ওরা এখন ইশকুলে যায়, আগের দিন কি আর আছে। কারও আক্ষেপ এত বছরের একটা ঐতিহ্য!
অদ্ভুদ অভিজ্ঞতাটা হলো সন্ধ্যায় দিকে। পোষাক আশাকে বোঝা গেল স্থানীয়, তিনজনই টলছে, একজন মৃদু জড়ানো গলায় শুধোচ্ছে কি রে, তোদের মেয়েরা যে এবার আসলো না যে? এত মানুষ দেখতে আসলো... যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সে একদম চুর, পাটকাঠির মত শরীর, গা শিওরানো সেই উত্তরটা দিলো: মোসলমানের দ্যাশ, হেদুগোর পুজা, সাঁওতালের কি!
বাঙালির দেশে ধর্ম বিভাজন, বর্ণবিভাজনেরও বাইরে আর যে একটা অস্তিত্বহীনতার উপলদ্ধি বরাদ্দ আছে বাকি জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য, সেইটার মত অসহায়ত্ব বোধহয় আর কোনকিছুতে নাই।
No comments:
Post a Comment