বিশ্বের কালো টাকার কি খোঁজ মিলবে?
কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়
দৃশ্য এক : ১৭৫০ সালের আগস্ট মাসের এক ঝড়ের রাত। উত্তর অতলান্তিকের ছোট্ট নর্মান দ্বীপের তীরে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। কিন্তু ওই ঝড়জলের মধ্যেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিকটবর্তী ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপকুঞ্জের ৬০০ একরের এই দ্বীপের দিকে এগিয়ে চলেছে রৌপ্যমুদ্রা বোঝাই কয়েকটা নৌকা। গন্তব্য এই দ্বীপের তীরবর্তী গুহা যেখানে নৌকার রুপো বোঝাই ৫৫ পেটি লুকিয়ে রাখা হবে। স্প্যানিশ জাহাজ নুয়েস্ত্রা সেনোরা দি ওয়াদালুপে থেকে নামানো সেই ধনরাশির পুরোটা আজও উদ্ধার করা যায়নি। জাহাজের ক্যাপ্টেন ওয়েন লয়েডের এই কা-ের ২৬৪ বছর পরও তাই আজও জনমানবহীন নর্মান দ্বীপ গুপ্তধনের মায়াবী হাতছানি দেয়। হাতছানির কারণ অবশ্য আরও রয়েছে। ঘটনার ১৩০ বছর পরে নর্মান দ্বীপকেই মূলত মাথায় রেখেইে রবার্ট লুই স্টিভেনসন লেখেন তাঁর অমর জলদুস্য-গুপ্তধন-এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ট্রেজার আইল্যান্ড।
দৃশ্য দুই : ২০১৪ সালের ২১ জুলাইয়ের বৃষ্টি ধোয়া এক সকাল। প্যারিসের ধা চকচকে শাতে লা মুয়েতের সদর দফতরে জরুরী বৈঠকে বসেছে ৩৪ দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-র সদস্যরা। ওইসিডিতে সাবেক বেলজিয়াম রাষ্ট্রদূত রজার অকরেন্টের নামাঙ্কিত কক্ষে সেই জরুরী বৈঠকে বসেছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রোলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত বিশ্বের সদস্যরা। বিশ্বের কোনায় কোনায় নামে বেনামে যে সব লক্ষ কোটি ডলার লুকানো আছে তা খুঁজে বের করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান প্রদান ব্যবস্থার রূপরেখা।
সময়ের বালুমড়িতে দুই দৃশ্যের ফারাক ২৬৪ বছরের। কিন্তু একই সুতোয় বাঁধা দুটিই। কালো টাকা। অতীতে যা ছিল গুপ্তধন আজকের বিশ্বে তারই পোশাকী নাম কালো টাকা। অতীতের মতো এ কালেও সেই লুক্কায়িত ধনের খোঁজে হন্যে হয়ে খোঁজা চলছে।
ওইসিডির এই প্রয়াসের কাটাছেঁড়া করার আগে দেখে নেয়া যাক কালো টাকা বলতে ঠিক কি বোঝায়? অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুসারে, কালো টাকা মূলত দুটি রাস্তায় হতে পারে। প্রথমত, মাদক পাচার, শিশু ও নারী পাচার, সোনা, হীরে ছবি চোরাপাচার, বাঘ, গণ্ডুর, হাতি পাখির চোরাশিকার, চোরাচালান, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা প্রভৃতি বেআইনী উপয়ে রোজগার করে। দ্বিতীয়ত, আইনী পথে রোজগার করেও যদি সেই উপার্জনের জন্য যথাযথ কর না দেয়া হয়। অর্থাৎ কর ফাঁকি দেয়া সম্পদও কালো টাকার আওতায় পড়বে। সোজা কথা হলো কালো টাকা হলো হিসাববহির্ভূত অর্থ।
রাষ্ট্রসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত দফতর ইউনাইটেড নেশন অফিস অন ড্রাগস এ্যান্ড ক্রাইম (ইউনোডিসি)-এর হিসাব মতো প্রতি বছর বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্থমূল্যের ২ থেকে ৫ শতাংশ হয় বেআইনী পথে। আনমানিক হিসাবে যা দাঁড়ায় ৮০ হাজার কোটি ডলার থেকে ২ লাখ কোটি ডলার। পাশাপাশি, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কিং কর্তৃপক্ষ এসএনবি-র দেয়া সাম্প্রতিক তথ্য জানাচ্ছে, ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার সুইজারল্যান্ডের ২৮৩টি ব্যাঙ্কে জমা রয়েছে। এই তালিকায় প্রথম পাঁচটি দেশ হলো ইংল্যান্ড (২৭,৭০০ কোটি সুইস ফ্রাঁ), আমেরিকা (১৯৩০০ কোটি সুইস ফ্রাঁ), ওয়েস্ট ইন্ডিজ ( ১০ হাজার কোটি সুইস ফ্রাঁ), জার্মানি (৫২৪০ কোটি সুইস ফ্রাঁ) এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাঝের খাড়ির দ্বীপরাষ্ট্র ওয়ের্নসে (৪৯৬০ কোটি সুইস ফ্রাঁ)
মনে রাখা দরকার এটা কেবলমাত্র সুইস ব্যাঙ্কের হিসাব। কিন্তু বেআইনী অর্থ ব্যাঙ্কের এ্যাকাউন্টে রাখার নিরিখে সুইস ব্যাঙ্কগুলোর মৌরসীপাট্টায় এখন ভাগ বসাচ্ছে মোনাকো, কেমেন দীপপুঞ্জ, মরিসাস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন দীপপুঞ্জ, লুক্সেমবার্গ, লিচেনস্টাইন, আইল অফ ম্যান, গ্রিস প্রভৃতি দেশের ব্যাঙ্কগুলোও। এদের সঠিক হিসাব কিন্তু এখনও অমিল।
একবার বিশ্ব সম্পদের দিকে চোখ বোলালে পরিস্থিতি যে কত গুরুতর তা আরও ভাল করে বোঝা যাবে। ২০১৩ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব অনুসারে প্রায় ৭৫ লাখ কোটি ডলার হলো বিশ্বের মোট উৎপাদন। দক্ষিণ এশিয়ার হলো ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে গোটা দক্ষিণ এশিয়া যা উৎপাদন করে, বিশ্বের কালো টাকা তাকেও ছাপিয়ে যাবে।
মোদ্দা কথা, বিশ্বজুড়ে হিসাববহির্ভূত অর্থ একটা সমান্তরাল সাম্রাজ্য চালাচ্ছে শুধু নয়, দিনে দিনে তা আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। এমনিতেই অর্থনীতির ওপর কালো টাকার একটা সর্বনাশা প্রভাব পড়েই। উইপোকা ভেতর থেকে খেয়ে কাঠামোর মূল কাঠামোটাকেই ফোঁপড়া করে দেয় আর তার ফলে সেটা অল্প ধাক্কাতেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। অথচ বাইর থেকে এই বিপদের আঁচ পাওয়া যায় না। কালো টাকাও এই উইপোকার কাজ করে। লাগাম ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতির সুনামি অর্থনীতির মূল কাঠামোটাকেই নড়বড়ে করে দেয়। ফলে যে কোন আর্থিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলে। বেশি দূর যেতে হবে না। গোটা লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বহুদেশ ভুগছে এই রোগে।
বিষয়টা একটু বিশদে বোঝানো যাক। ধরা যাক কোন দেশের আয়ের একটা অংশের ওপর সেই দেশের সরকার কোন কর তো পাচ্ছেই না, উল্টো কর ফাঁকি দেয়া টাকাটার একাংশ বিদেশি কোন ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে। আর যে অংশটা দেশে রয়ে যাচ্ছে সেটা দেশের বাজারে ঘুরপথে ঢুকে পড়ছে।
এতে দেশ তথা বিশ্বঅর্থনীতির দুভাবে সর্বনাশ হচ্ছে। প্রথমত, কোন দেশের মুদ্রা বাজারে ঠিক কত পরিমাণ অর্থ আছে সেই মূল হিসাবটাই আর সরকারের হাতে থাকছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পুরোপুরি মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যে দাওয়াইই দিক না কেন মুদ্রাবাজারে একাংশ তার আওতার বাইরে থেকেই যাচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদী কোন আর্থিক ব্যবস্থা নেয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশী ব্যাঙ্কে হিসাববহির্ভূত অর্থ জমা হওয়ায় কোন দেশের বাইরে অনাকাক্সিক্ষত সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করবে যার সম্বন্ধে সরকারের না থাকবে কোও ধারণা না থাকবে সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় হচ্ছে তার উপর কোন রকম নিয়ন্ত্রণ। ফলে ধীরে ধীরে সেই দেশের বাইরে যদি আর্থিক ক্ষমতার অন্য ভরকেন্দ্র গড়ে ওঠে তাহলে আশ্চর্যের কিছু হবে না। এ কথা মনে রাখা অত্যন্ত জরুরী যে, বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো কোন নির্দিষ্ট দেশে আর তাদের তহবিল রাখছে না। আল কায়েদার মতো সংগঠনের নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রেখেছে। ফলে সমূলে বিনাশ করা দুরূহ হয়ে উঠছে।
এ ছাড়া যে অর্থ দেশের ব্যাঙ্কে জমা থাকলে ব্যাঙ্কের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ত সেই অর্থ বাইরে থেকে বিদেশী ব্যাঙ্কের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করছে। হাস্যকর পরিস্থিতি হতে পারে যদি সরকার তারই দেশের কালো টাকায় বলীয়ান হওয়া বিদেশী ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। লাতিন ও মধ্য আমেরিকায় এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে যেখানে পশ্চিমী ব্যাঙ্কগুলো একদম মহাজনী কায়দায় অনাদায়ী অর্থ আদায় করতে নেমে দেশের সম্পদ গ্রাস করতে দ্বিধা করেনি।
আর এই সবই বিশ্বজুড়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই মাসের বৃষ্টিধোয়া সাত সকালে প্যারিসে ওইসিডি-র কর্তাদের তড়িঘড়ি প্রস্তাবিত ব্যবস্থা নিয়েও দীর্ঘ বৈঠক এই কারণেই। কোন দেশের কালো টাকা জমা হচ্ছে, কোন দেশ কত দুর্নীতিবাজ এসব কাসুন্দি ঘাঁটার চেয়ে এই বিপদকে সমূলে বিনাশ করা দরকার আর এই কাজে প্রয়োজন সব দেশেরই সহযোগিতা। তাই গোপনীয়তার চাদরে মোড়া কোটি কোটি ডলারের খোঁজ পাওয়াটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ওইসিডি উঠেপড়ে লেগেছে কালো টাকা খুঁজে বের করতে।
এতদিন পর্যন্ত কোন সন্দেহ হলে এক দেশ অন্য দেশকে অনুরোধ করত তথ্য দেয়ার জন্য। সুইজারল্যান্ডের মতো ব্যাঙ্কীয় গোপনীয়তার ঢাল দেখিয়ে তা এড়িয়েও যেত। ওইসিডি আর এইসব ঢাকঢাক গুড়গুড় রাখতে চাইছে না।
কারো ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে লেনদেন হলেই তা প্রস্তাবিত ব্যবস্থার নজরে চলে আসবে আর সেই ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা সব এ্যাকাউন্টেরই নাড়ির খবর টেনে বের করা হবে। সাধারণভাবে দেখা যায় এক দেশের হিসাববহির্ভূত অর্থ বেনামে অন্য দেশের ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে বা কোন ব্যবসায়ে সেই টাকা ঢালা হচ্ছে। এই জন্যই অনেক দেশকে এক সঙ্গে এই আধুনিক গুপ্তধন খোঁজার কাজে পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছে ৩৪ সদস্য দেশের এই সংগঠন, যাতে না অপরাধী কোনভাবে পালাতে পারে। আমন্ত্রিত দেশ হিসাবে ভারত ইতোমধ্যেই চুক্তিতে সইও করে দিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জি-২০ দেশের অর্থমন্ত্রীরা প্রস্তাবটিতে সম্মতির সিলমোহর দিলেই তা বিশ্বব্যাপী অভিযানে নেমে পড়বে।
কিন্তু কাজটা যত সহজে বলা হলো ব্যাপারটা আদৌ তত সহজ নয়।
প্রথমত, পুরো অনুসন্ধানটা দাঁড়িয়ে থাকবে প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। বিশ্বের অনেক দেশেই দুর্নীতি এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে যে প্রাথমিক তথ্যের নির্ভরযোগ্যতাই প্রশ্নাতীত নয়। ফলে ভুল তথ্যের ওপর দাঁড় করানো অনুসন্ধানের ভবিষ্যত যে খুব উজ্জ্বল নয় তা বলাই বাহুল্য।
দ্বিতীয়ত, সন্দেহ করা হচ্ছে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদীরা হাওয়ালা পদ্ধতিতে অর্থ আদানপ্রদান করে। বিভিন্ন দেশে হাওয়ালার বিভিন্ন নাম। যেমন ভারতে বলা হয় হুন্ডি, চীনে এর নাম ফেই-চিয়েন, হংকং এ হুই কুয়ান, ফিলিপিন্সে পাদালা, থাইল্যান্ডে ফেই কোয়ান। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, পশ্চিম আফ্রিকার মালি, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হাওয়ালার রমরমা। ফলে মুদ্রাবাজারের একটা ভাল অংশেরই যে কোন তথ্যই মিলবে না তা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয়ত, এই হিসাববহির্ভূত অর্থের মালিকরা প্রকৃত অর্থেই যথেস্ট শক্তিশালী এবং খোঁজখবর নেয়া শুরু হলে তারা যে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না তা জানার জন্য শার্লক হোমস হওয়ার দরকার নেই। বিশ্বের বহু দেশেই রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের আজ্ঞাবহ এবং প্রয়োজনে তারা সেটা ব্যবহার করতে যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কালো টাকার রমরমা খুঁজতে নামছে ওইসিডি। কিন্তু বিশ্বের বহু প্রান্তে স্থানীয় সংগঠিত অপরাধ চক্র কোন মাপকাঠিতেই কম নয়। বরং বহু ক্ষেত্রে তারা প্রথমে স্থানীয়ভাবে বলীয়ান আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখছে।
পঞ্চমত, ওইসিডির এই নজরদারি ব্যবস্থা ধরেই নিয়েছে বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এক অভিন্ন ধাঁচে রয়েছে। তা কিন্তু আদৌ নয়। এখনও বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের একটা বড় অংশ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে কালো টাকা খুঁজতে সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক ব্যবস্থার নিরিখেই তা করতে হবে।
ষষ্ঠত, ধরে নেয়া যাক ওইসিডি তার রিপোর্ট তৈরি করল। কিন্তু রিপোর্ট অনুসারে কাজ হবে কি না সেটা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না। রাজনৈতিক হিসাব মেটানোর হাতিয়ারও যে হবে না তাও নিশ্চিত করে বলা যায় কি?
এত সব বাধার কাসুন্দি ঘেঁটেও বিশ্ব কিন্তু অধীর আগ্রহে ওইসিডির এই তদন্তের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
গুপ্তধন কি সত্যিই মিলবে?
লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
দৃশ্য দুই : ২০১৪ সালের ২১ জুলাইয়ের বৃষ্টি ধোয়া এক সকাল। প্যারিসের ধা চকচকে শাতে লা মুয়েতের সদর দফতরে জরুরী বৈঠকে বসেছে ৩৪ দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-র সদস্যরা। ওইসিডিতে সাবেক বেলজিয়াম রাষ্ট্রদূত রজার অকরেন্টের নামাঙ্কিত কক্ষে সেই জরুরী বৈঠকে বসেছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রোলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত বিশ্বের সদস্যরা। বিশ্বের কোনায় কোনায় নামে বেনামে যে সব লক্ষ কোটি ডলার লুকানো আছে তা খুঁজে বের করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান প্রদান ব্যবস্থার রূপরেখা।
সময়ের বালুমড়িতে দুই দৃশ্যের ফারাক ২৬৪ বছরের। কিন্তু একই সুতোয় বাঁধা দুটিই। কালো টাকা। অতীতে যা ছিল গুপ্তধন আজকের বিশ্বে তারই পোশাকী নাম কালো টাকা। অতীতের মতো এ কালেও সেই লুক্কায়িত ধনের খোঁজে হন্যে হয়ে খোঁজা চলছে।
ওইসিডির এই প্রয়াসের কাটাছেঁড়া করার আগে দেখে নেয়া যাক কালো টাকা বলতে ঠিক কি বোঝায়? অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুসারে, কালো টাকা মূলত দুটি রাস্তায় হতে পারে। প্রথমত, মাদক পাচার, শিশু ও নারী পাচার, সোনা, হীরে ছবি চোরাপাচার, বাঘ, গণ্ডুর, হাতি পাখির চোরাশিকার, চোরাচালান, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা প্রভৃতি বেআইনী উপয়ে রোজগার করে। দ্বিতীয়ত, আইনী পথে রোজগার করেও যদি সেই উপার্জনের জন্য যথাযথ কর না দেয়া হয়। অর্থাৎ কর ফাঁকি দেয়া সম্পদও কালো টাকার আওতায় পড়বে। সোজা কথা হলো কালো টাকা হলো হিসাববহির্ভূত অর্থ।
রাষ্ট্রসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত দফতর ইউনাইটেড নেশন অফিস অন ড্রাগস এ্যান্ড ক্রাইম (ইউনোডিসি)-এর হিসাব মতো প্রতি বছর বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্থমূল্যের ২ থেকে ৫ শতাংশ হয় বেআইনী পথে। আনমানিক হিসাবে যা দাঁড়ায় ৮০ হাজার কোটি ডলার থেকে ২ লাখ কোটি ডলার। পাশাপাশি, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কিং কর্তৃপক্ষ এসএনবি-র দেয়া সাম্প্রতিক তথ্য জানাচ্ছে, ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার সুইজারল্যান্ডের ২৮৩টি ব্যাঙ্কে জমা রয়েছে। এই তালিকায় প্রথম পাঁচটি দেশ হলো ইংল্যান্ড (২৭,৭০০ কোটি সুইস ফ্রাঁ), আমেরিকা (১৯৩০০ কোটি সুইস ফ্রাঁ), ওয়েস্ট ইন্ডিজ ( ১০ হাজার কোটি সুইস ফ্রাঁ), জার্মানি (৫২৪০ কোটি সুইস ফ্রাঁ) এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাঝের খাড়ির দ্বীপরাষ্ট্র ওয়ের্নসে (৪৯৬০ কোটি সুইস ফ্রাঁ)
মনে রাখা দরকার এটা কেবলমাত্র সুইস ব্যাঙ্কের হিসাব। কিন্তু বেআইনী অর্থ ব্যাঙ্কের এ্যাকাউন্টে রাখার নিরিখে সুইস ব্যাঙ্কগুলোর মৌরসীপাট্টায় এখন ভাগ বসাচ্ছে মোনাকো, কেমেন দীপপুঞ্জ, মরিসাস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন দীপপুঞ্জ, লুক্সেমবার্গ, লিচেনস্টাইন, আইল অফ ম্যান, গ্রিস প্রভৃতি দেশের ব্যাঙ্কগুলোও। এদের সঠিক হিসাব কিন্তু এখনও অমিল।
একবার বিশ্ব সম্পদের দিকে চোখ বোলালে পরিস্থিতি যে কত গুরুতর তা আরও ভাল করে বোঝা যাবে। ২০১৩ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব অনুসারে প্রায় ৭৫ লাখ কোটি ডলার হলো বিশ্বের মোট উৎপাদন। দক্ষিণ এশিয়ার হলো ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে গোটা দক্ষিণ এশিয়া যা উৎপাদন করে, বিশ্বের কালো টাকা তাকেও ছাপিয়ে যাবে।
মোদ্দা কথা, বিশ্বজুড়ে হিসাববহির্ভূত অর্থ একটা সমান্তরাল সাম্রাজ্য চালাচ্ছে শুধু নয়, দিনে দিনে তা আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। এমনিতেই অর্থনীতির ওপর কালো টাকার একটা সর্বনাশা প্রভাব পড়েই। উইপোকা ভেতর থেকে খেয়ে কাঠামোর মূল কাঠামোটাকেই ফোঁপড়া করে দেয় আর তার ফলে সেটা অল্প ধাক্কাতেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। অথচ বাইর থেকে এই বিপদের আঁচ পাওয়া যায় না। কালো টাকাও এই উইপোকার কাজ করে। লাগাম ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতির সুনামি অর্থনীতির মূল কাঠামোটাকেই নড়বড়ে করে দেয়। ফলে যে কোন আর্থিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলে। বেশি দূর যেতে হবে না। গোটা লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বহুদেশ ভুগছে এই রোগে।
বিষয়টা একটু বিশদে বোঝানো যাক। ধরা যাক কোন দেশের আয়ের একটা অংশের ওপর সেই দেশের সরকার কোন কর তো পাচ্ছেই না, উল্টো কর ফাঁকি দেয়া টাকাটার একাংশ বিদেশি কোন ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে। আর যে অংশটা দেশে রয়ে যাচ্ছে সেটা দেশের বাজারে ঘুরপথে ঢুকে পড়ছে।
এতে দেশ তথা বিশ্বঅর্থনীতির দুভাবে সর্বনাশ হচ্ছে। প্রথমত, কোন দেশের মুদ্রা বাজারে ঠিক কত পরিমাণ অর্থ আছে সেই মূল হিসাবটাই আর সরকারের হাতে থাকছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পুরোপুরি মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যে দাওয়াইই দিক না কেন মুদ্রাবাজারে একাংশ তার আওতার বাইরে থেকেই যাচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদী কোন আর্থিক ব্যবস্থা নেয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশী ব্যাঙ্কে হিসাববহির্ভূত অর্থ জমা হওয়ায় কোন দেশের বাইরে অনাকাক্সিক্ষত সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করবে যার সম্বন্ধে সরকারের না থাকবে কোও ধারণা না থাকবে সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় হচ্ছে তার উপর কোন রকম নিয়ন্ত্রণ। ফলে ধীরে ধীরে সেই দেশের বাইরে যদি আর্থিক ক্ষমতার অন্য ভরকেন্দ্র গড়ে ওঠে তাহলে আশ্চর্যের কিছু হবে না। এ কথা মনে রাখা অত্যন্ত জরুরী যে, বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো কোন নির্দিষ্ট দেশে আর তাদের তহবিল রাখছে না। আল কায়েদার মতো সংগঠনের নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রেখেছে। ফলে সমূলে বিনাশ করা দুরূহ হয়ে উঠছে।
এ ছাড়া যে অর্থ দেশের ব্যাঙ্কে জমা থাকলে ব্যাঙ্কের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ত সেই অর্থ বাইরে থেকে বিদেশী ব্যাঙ্কের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করছে। হাস্যকর পরিস্থিতি হতে পারে যদি সরকার তারই দেশের কালো টাকায় বলীয়ান হওয়া বিদেশী ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। লাতিন ও মধ্য আমেরিকায় এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে যেখানে পশ্চিমী ব্যাঙ্কগুলো একদম মহাজনী কায়দায় অনাদায়ী অর্থ আদায় করতে নেমে দেশের সম্পদ গ্রাস করতে দ্বিধা করেনি।
আর এই সবই বিশ্বজুড়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই মাসের বৃষ্টিধোয়া সাত সকালে প্যারিসে ওইসিডি-র কর্তাদের তড়িঘড়ি প্রস্তাবিত ব্যবস্থা নিয়েও দীর্ঘ বৈঠক এই কারণেই। কোন দেশের কালো টাকা জমা হচ্ছে, কোন দেশ কত দুর্নীতিবাজ এসব কাসুন্দি ঘাঁটার চেয়ে এই বিপদকে সমূলে বিনাশ করা দরকার আর এই কাজে প্রয়োজন সব দেশেরই সহযোগিতা। তাই গোপনীয়তার চাদরে মোড়া কোটি কোটি ডলারের খোঁজ পাওয়াটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ওইসিডি উঠেপড়ে লেগেছে কালো টাকা খুঁজে বের করতে।
এতদিন পর্যন্ত কোন সন্দেহ হলে এক দেশ অন্য দেশকে অনুরোধ করত তথ্য দেয়ার জন্য। সুইজারল্যান্ডের মতো ব্যাঙ্কীয় গোপনীয়তার ঢাল দেখিয়ে তা এড়িয়েও যেত। ওইসিডি আর এইসব ঢাকঢাক গুড়গুড় রাখতে চাইছে না।
কারো ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে লেনদেন হলেই তা প্রস্তাবিত ব্যবস্থার নজরে চলে আসবে আর সেই ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা সব এ্যাকাউন্টেরই নাড়ির খবর টেনে বের করা হবে। সাধারণভাবে দেখা যায় এক দেশের হিসাববহির্ভূত অর্থ বেনামে অন্য দেশের ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে বা কোন ব্যবসায়ে সেই টাকা ঢালা হচ্ছে। এই জন্যই অনেক দেশকে এক সঙ্গে এই আধুনিক গুপ্তধন খোঁজার কাজে পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছে ৩৪ সদস্য দেশের এই সংগঠন, যাতে না অপরাধী কোনভাবে পালাতে পারে। আমন্ত্রিত দেশ হিসাবে ভারত ইতোমধ্যেই চুক্তিতে সইও করে দিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জি-২০ দেশের অর্থমন্ত্রীরা প্রস্তাবটিতে সম্মতির সিলমোহর দিলেই তা বিশ্বব্যাপী অভিযানে নেমে পড়বে।
কিন্তু কাজটা যত সহজে বলা হলো ব্যাপারটা আদৌ তত সহজ নয়।
প্রথমত, পুরো অনুসন্ধানটা দাঁড়িয়ে থাকবে প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। বিশ্বের অনেক দেশেই দুর্নীতি এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে যে প্রাথমিক তথ্যের নির্ভরযোগ্যতাই প্রশ্নাতীত নয়। ফলে ভুল তথ্যের ওপর দাঁড় করানো অনুসন্ধানের ভবিষ্যত যে খুব উজ্জ্বল নয় তা বলাই বাহুল্য।
দ্বিতীয়ত, সন্দেহ করা হচ্ছে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদীরা হাওয়ালা পদ্ধতিতে অর্থ আদানপ্রদান করে। বিভিন্ন দেশে হাওয়ালার বিভিন্ন নাম। যেমন ভারতে বলা হয় হুন্ডি, চীনে এর নাম ফেই-চিয়েন, হংকং এ হুই কুয়ান, ফিলিপিন্সে পাদালা, থাইল্যান্ডে ফেই কোয়ান। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, পশ্চিম আফ্রিকার মালি, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হাওয়ালার রমরমা। ফলে মুদ্রাবাজারের একটা ভাল অংশেরই যে কোন তথ্যই মিলবে না তা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয়ত, এই হিসাববহির্ভূত অর্থের মালিকরা প্রকৃত অর্থেই যথেস্ট শক্তিশালী এবং খোঁজখবর নেয়া শুরু হলে তারা যে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না তা জানার জন্য শার্লক হোমস হওয়ার দরকার নেই। বিশ্বের বহু দেশেই রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের আজ্ঞাবহ এবং প্রয়োজনে তারা সেটা ব্যবহার করতে যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কালো টাকার রমরমা খুঁজতে নামছে ওইসিডি। কিন্তু বিশ্বের বহু প্রান্তে স্থানীয় সংগঠিত অপরাধ চক্র কোন মাপকাঠিতেই কম নয়। বরং বহু ক্ষেত্রে তারা প্রথমে স্থানীয়ভাবে বলীয়ান আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখছে।
পঞ্চমত, ওইসিডির এই নজরদারি ব্যবস্থা ধরেই নিয়েছে বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এক অভিন্ন ধাঁচে রয়েছে। তা কিন্তু আদৌ নয়। এখনও বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের একটা বড় অংশ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে কালো টাকা খুঁজতে সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক ব্যবস্থার নিরিখেই তা করতে হবে।
ষষ্ঠত, ধরে নেয়া যাক ওইসিডি তার রিপোর্ট তৈরি করল। কিন্তু রিপোর্ট অনুসারে কাজ হবে কি না সেটা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না। রাজনৈতিক হিসাব মেটানোর হাতিয়ারও যে হবে না তাও নিশ্চিত করে বলা যায় কি?
এত সব বাধার কাসুন্দি ঘেঁটেও বিশ্ব কিন্তু অধীর আগ্রহে ওইসিডির এই তদন্তের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
গুপ্তধন কি সত্যিই মিলবে?
লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html
No comments:
Post a Comment