সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে ২০ দলের নেতারা
সব অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকার
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে বিচারক অপসারণ হবে : ফখরুল সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ দুরভিসন্ধি-মূলক : মওদুদ
ইত্তেফাক রিপোর্ট
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারাসহ দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নেতারা বলেছেন, বর্তমান সরকার অত্যন্ত দুর্বল। তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। তাই ক্ষমতায় থাকতে হলে তাদের জোর করেই থাকতে হবে। জোর করে থাকার উদ্দেশেই গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধী-নতাসহ এ সরকার একে একে মানুষের সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। এ সরকার প্রতিবাদ শুনবে না। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না, আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে, দুর্বার গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে বিদায় করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ নির্বাচনের দাবি আদায় করতে হবে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাতিলের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০ দল আয়োজিত সমাবেশে তারা এসব কথা বলেন।সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপি চেয়ার-পারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। সমাবেশে সভাপতিত্বকারী ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণার আগে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন হঠাত্ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারেননি। সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংবিধান সংশোধন করে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসনের দায়িত্ব দেয়া হলে সেটি হবে কার্যত আওয়ামী লীগেরই দলীয় সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন, মানুষের কথা বলার ও লেখার স্বাধীনতা হরণ করতেই সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে। এই নীতিমালার ভয়ে এখন আর কেউ টেলিভিশনের টকশোতে সত্য কথা বলতে পারবে না। আওয়ামী লীগ এভাবে বারবার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ধুলিস্যাত্ করেছে। নিজেদের ক্ষমতাকে পোক্ত করতে তারা দেশের মানুষের সকল অধিকার একে একে কেড়ে নিচ্ছে। অধিকার ফিরে পেতে হলে সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। আঙ্গুল বাঁকা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে দাবি আদায় করতে হবে।
ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল, যারা শুধু মুখেই গণতন্ত্র বিশ্বাস করে। তারা অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে, ব্যাংকগুলো খেয়ে ফেলেছে, শেয়ারবাজার লুট করেছে।
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার পদক্ষেপের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এই উদ্যোগ দুরভিসন্ধিমূলক ও স্ববিরোধী। এ সরকার বলছে- জিয়াউর রহমান মার্শাল ল জারি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। কিন্তু তারা একবারও বলছে না যে, তারা আইন করে সুপ্রিমকোর্টকে রাষ্ট্রপতির অধীনে নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান সেখান থেকে ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের সময় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেখে দিয়েছিলেন, এখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছেন-এটা রাখা ঠিক হবে না। তার এই বক্তব্য স্ববিরোধী। মওদুদ আরও বলেন, এই সরকার দুর্বল। তাই জোর করে ক্ষমতায় থাকতে তারা আরও নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নেবে। তবে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হবে, সেদিন বেশি দূরে নয়।
সমাবেশে মির্জা আব্বাস বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তা না হলে সরকার বড় ভুল করবে। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, পুলিশকে দিয়ে উস্কানিমূলক কাজ করাবেন না, তাহলে দেখবেন গণআন্দোলন কাকে বলে। ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সংলাপ ও নির্বাচনের কথা বললেই সরকার আতঙ্কে ভোগে, জলাতঙ্ক রোগের মত। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।
সমাবেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দলের শীর্ষ নেতাদেরসহ কারাবন্দী দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি করেন জামায়াতের নায়েবে আমির মজিবুর রহমান।
২০ দলীয় জোট শরিক এলডিপি সভাপতি ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব.) বলেন, শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াকে জড়িয়ে সরকার মিথ্যাচার করছে। কর্নেল তাহের বলেছিলেন- শেখ মুজিবের মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়া উচিত, নইলে একটি মাজার হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, '৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া কখনও সম্ভব নয়, এখন ২০১৪ সাল, বাংলাদেশকে ৩৪ বছর পেছনে নেয়া যাবে না।
কল্যাণ পার্টি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব। সেই আন্দোলনের রূপরেখা দেবেন খালেদা জিয়া।
কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. টিআইএম ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, এই সরকারের কাছ থেকে বৈধ কোনো কাজ আশা করা যায় না।
খেলাফত মজলিশের নেতা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, এ সরকার আমাদের বড় বড় সব নেতাকে গ্রেফতার করবে, বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করতে পারে। তবে ঢাকা মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটি খালেদা জিয়ার নির্দেশ মেনে ঢাকাকে অচল করে দিতে পারবে।
ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী বলেন, এ সরকার গণবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ না করলে তাদেরকে অপমান হয়ে বিদায় নিতে হবে।
এনপিপি'র একাংশের চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার কারণেই এই সরকারের পতন ঘটবে।
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের ২৭, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। সাংবাদিক, আইনজীবী ও নাগরিকদের এর প্রতিবাদ জানানো একান্ত জরুরি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি আতঙ্কের।
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকার আগেই বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে বিটিভি'র খবর প্রচারে বাধ্য করেছে। এই সম্প্রচার নীতিমালার ফলে এখন বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে বিটিভি'র মতোই সংবাদ প্রচার করতে হবে। কোনো বিবেকবান মানুষ এখন আর টকশোতে যাবে না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে কালো আইন ও নীতিমালা করছে। আ.স.ম হান্নান শাহ বলেন, এ সরকার প্রতিবাদের ভাষা বোঝে না। স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। ক্ষমতায় এসে বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো ধ্বংস করছে।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সরকার এবার সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছে। আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে হটাতে হবে।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিচারকদের চাকরি থাকবে কিনা, এই সংসদ সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
ড. আবদুল মঈন খান বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার নামে সরকার দলননীতি করেছে, উদ্দেশ্য সরকার জনগণকে কথা বলতে দেবে না।
এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধান পরিপন্থি। এর আগেও আওয়ামী লীগ সংবাদপত্র বন্ধ করেছিল, এবার আরেকটি কালো অধ্যায় সৃষ্টি করলো। সমাবেশে বিএনপিপন্থি সাংবাদিক নেতারাও বক্তব্য রাখেন। বিএফইউজে'র একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, 'সরকারের সম্প্রচার নীতিমালা সাংবাদিক সমাজ মানে না'। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, এই নীতিমালা গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি।
দুপুর ২টা থেকেই ঢাকার বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন হাতে খণ্ড-খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসতে থাকেন। জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাও ব্যানারসহ মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসেন। সমাবেশ মঞ্চের ডানপাশে অবস্থান নেন শিবির নেতা-কর্মীরা। সমাবেশে বিপুল লোক সমাগম ঘটে।
No comments:
Post a Comment