Monday, August 18, 2014

জাপানী বিনিয়োগকারীরা আসছেন ॥ টয়োটা গাড়ি, সনি টিভি তৈরি হবে বাংলাদেশে, যাবে বিদেশে

জাপানী বিনিয়োগকারীরা আসছেন ॥ টয়োটা গাড়ি, সনি টিভি তৈরি হবে বাংলাদেশে, যাবে বিদেশে
এম শাহজাহান ॥ টয়োটা গাড়ি কিংবা সনি টেলিভিশনের মতো বিশ্বখ্যাত জাপানী ব্র্যান্ডের পণ্যসামগ্রী তৈরি হবে বাংলাদেশে। উৎপাদিত এসব পণ্য জাপানে যাওয়ার পাশাপাশি রফতানি হবে সারা বিশ্বে। আর বাংলাদেশের মানুষের হবে কর্মসংস্থান। সরকার পাবে ট্যাক্স ও ভ্যাট। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে বড় অঙ্কের রাজস্ব। যা দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণসহ দেশের উন্নয়ন করা হবে। ঠিক এই ধরনের একটি প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাপানের বিনিয়োগকারীরা। ওই দেশের উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশমুখী। আগামী ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাপানের উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারী ও এফবিসিসিআইয়ের একটি প্রতিনিধি দল জরুরী বৈঠকে মিলিত হবেন। সেখানে এদেশে জাপানের বিনিয়োগ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, জাপানী উদ্যোক্তারা এদেশে বিনিয়োগ করতে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশকে। ওই প্রস্তাবগুলো পাওয়ার পর বাংলাদেশের দাবিগুলো উপস্থাপন করা হবে। তবে সূত্রগুলো বলছে, জাপানী বিনিয়োগাকারীরা এদেশে টয়োটা গাড়ি ও সনি টেলিভিশনের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী। এজন্য ‘জাপানী ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন’ নামে একটি আলাদা শিল্পাঞ্চল করার মতো জমি বরাদ্দের দাবি রয়েছে তাঁদের। আর ওই জোনটি হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশপাশে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দীন আহ্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, জাপানী উদ্যোক্তারা এদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে চায়। তাঁরা তাদের দেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলো বাংলাদেশে রি-লোকেট করতে আগ্রহী। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, জাপানী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে বিসিআইএমের সভা একমাস পিছিয়ে দেয়া হবে। জাপান আমাদের বড় সহযোগী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে বিসিআইএম গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরই জাপানী তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। তাঁরা বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায়। এ কারণে ওই দেশের বড় ধরনের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাকেরও বড় বাজার হবে জাপান। সেখানে ডিউটি ও কোটা ফ্রিতে পোশাক বিক্রির দাবি রয়েছে বাংলাদেশের।
সূত্র মতে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে পাশে পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অর্থনৈতিক শক্তি জাপান। দেশটি পুবের দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় বাংলাদেশকে। ভারতের পর কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার ক্ষেত্রে শত্রুমনোভাবাপন্ন দুই দেশ চীন ও জাপানের সাম্প্রতিক আগ্রহের পেছনে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বঙ্গোপসাগরের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়টিই কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আসিয়ানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বাংলাদেশ প্রধান মি. মিকিও হাতেদা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই সময় জাইকা প্রধান বলেছেন, বাংলাদেশ চাইলে আসিয়ানের রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরকেপ) সদস্য হতে পারে।
জানা গেছে, আসিয়ানের ১০ সদস্যরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া ও লাওস অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে (এফটিএ) যে অংশীদারি তৈরি করেছে, সেটিকেই রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’ (আরকেপ) নামে ডাকা হয়। আরকেপের মাধ্যমে আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে-অষ্ট্রেলয়া, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড বাদে আরকেপের সদস্য এশিয়ার চার অর্থনৈতিক শক্তি চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বাধিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। সব দেশই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। বিশেষ করে এই চার দেশ থেকেই বাংলাদেশের শিল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল ও শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভারি যন্ত্রপাতি, মেশিন, গাড়ি, মোটরবাইক, ট্রাক-লরিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। এ ছাড়া এই গ্রুপটির মাধ্যমে আসিয়ানের ১০ সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারও সুযোগ থাকছে। এর মাধ্যমে আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও সার্কের (সাফটা) মাধ্যমে প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন ও জাপানের সঙ্গে সে অর্থে বাংলাদেশের কোন অর্থনৈতিক জোট নেই। সে কারণে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে বিসিআইএম নামে একটি অর্থনৈতিক জোট গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চীন। বিসিআইএম গঠনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
জানা গেছে, চীনের এই জোট গঠনের কারণ হচ্ছে এ অঞ্চলে একটি অর্থনৈতিক যোগাযোগ (করিডর) সৃষ্টি করা। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, বিশাল অর্থনৈতিক জোনের দিকেও দৃষ্টি রয়েছে চীনের। বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও এত দিন বাংলাদেশকে নিয়ে এ ধরনের সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি জাপান। তবে চীনের বিসিআইএম গঠনের প্রস্তাবের পর এবার আগ বাড়িয়েই আগ্রহ দেখাল দেশটি। আর এ পরিস্থিতিতে আসিয়ানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে জাপানের আগ্রহ মূলত এ অঞ্চলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সম্ভাবনাকেই চিহ্নিত করে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের ওপর নির্ভর করেই এ ধরনের জোট গঠনে বিশেষ বিশেষ দেশ আগ্রহী হয়। এ মুহূর্তে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সেন্টার হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে আমাদের বাণিজ্য সম্ভাবনা বেড়েছে কয়েক গুণ।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার জাপান ॥ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার জাপান। বর্তমানে বাংলাদেশে জাপানের রফতানির পরিমাণ ১০৪ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে জাপানে আমদানির পরিমাণ মাত্র ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। ফলে বাণিজ্যিক ভারসাম্য জাপানের অনুকূলে রয়েছে। তবে বাংলাদেশে জাপানী বিনিয়োগ ও জাপানী শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এই অসমতা দূর করা সম্ভব। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড এ্যাসোসিয়েশন (জেট্রো) জাপানের জন্য বাংলাদেশকে এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ লাভজনক ব্যবসায়িক স্থান মনে করে। এ কারণে শতকরা ৮৭ ভাগ জাপানী ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এছাড়া দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষত মহাসড়ক, পাতাল রেল, মনোরেল, রেলপথ, বিদ্যুতকেন্দ্র ও সেরা মানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে জাপান ইতোমধ্যে এগিয়ে এসেছে। এছাড়া ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত একক দেশ হিসেবে জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। অনুদান, সাহায্য, কারিগরি সহায়তা ও সহজ শর্তে ঋণের ধারাবাহিক প্রবাহ মিলে গত বছর পর্যন্ত এর মোট পারিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার।

No comments:

Post a Comment