বিপদসীমা ছাড়িয়েছে সাত নদীর পানি
কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, শিশুর মৃত্যু, বিপাকে বানভাসি লক্ষাধিক মানুষ
ইত্তেফাক ডেস্ক
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার সকাল ৬টায় গাইবান্ধায় ঘাঘট নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার প্রধান নদী যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চারটি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র বইছিল বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। আর যমুনা নদী বাহাদুরাবাদ ও সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যথাক্রমে বিপদসীমার ২৭ ও ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া এলাসিন ঘাট পয়েন্টে ধলেশ্বরী নদী বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, বাঘাবাড়ি পয়েন্টে আত্রাই নদী বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে, সুরমা নদী কানাইঘাটে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে ৩৮ সেন্টিমিটার এবং কংশ নদী জারিয়া জাঞ্জাইলে বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে ওপারে গৌহাটি ও পাণ্ডুতে পানি কমায় দেশের ব্রক্ষপুত্র অববাহিকায় নদ-নদীর পানি কমতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, জেলার সাঘাটা উপজেলায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গতকাল সকাল ১১টার দিকে উত্তর সাথালিয়া পয়েন্টে ক্রস বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে মূল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। ফলে আতঙ্কিত লোকজন বসতবাড়ি সরাতে শুরু করেছেন। দুপুরে সাথালিয়া গ্রামের ঘেতা মিয়ার দুটি, সাহেব মিয়ার দুটি ঘর ভেঙ্গে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হুমকির মুখে আছে আরো ১০টি পরিবার।
এদিকে জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ৫০ হাজার মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে আছেন। ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ভাঙন কবলিত ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী বাঁধের ১০টি পয়েন্টে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মীর আব্দুর রাজ্জাক জানান, এ পর্যন্ত বন্যাকবলিত ৪ উপজেলায় ১ হাজার ৪৫৬ হেক্টর আবাদি জমি তলিয়ে গেছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমুল হুদা জানান, চার উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের ৯ হাজার পরিবারের ৪৫ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সরকারি ত্রাণ সহায়তা বাবদ তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে ৪০ মে. টন চাল ও ৪০ হাজার টাকার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। তবে প্রদানকৃত ত্রাণ সামগ্রী চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে বন্যাদুর্গতরা জানিয়েছেন।
তালা (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার পাশে আশাশুনি এলাকায় কপোতাক্ষ, বেতনা ও খোলপেটুয়া নদীর তীরে বেড়িবাঁধের ৯টি পয়েন্টে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। আতংকে দিন কাটাচ্ছেন নদীর তীরবর্তী গ্রামের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ। এলাকাবাসীর আশঙ্কা বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা না হলে যে কোন মুহূর্তে নদীর পানিতে ভেসে যেতে পারে এ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে যমুনার নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীর পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে যমুনার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, চৌহালী, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুর উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি ও শিশু খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া গবাদি পশুর খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তা প্রদান করা হয়নি।
এদিকে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে সদর, কাজিপুর ও এনায়েতপুর উপজেলায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন। পানির প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তের কারণে ইতিমধ্যেই এনায়েতপুরে নদীর ভাঙ্গন রোধে নির্মিত সলিড স্পার বাঁধের মাটির অংশের প্রায় ৩০ মিটার এলাকা যমুনায় ধসে গেছে।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, এনায়েতপুর ও চৌহালী থানার ৯টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে এসব এলাকার প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এনায়েতপুরের সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়নের বেতিল চর, মাজগ্রাম ও বিনদহ এলাকার প্রায় ৩ শতাধিক বাড়ি ১ থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে আছে। এর মধ্যে কয়েকটি স্কুলও রয়েছে। কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে পাঠ দান। ঘরে পানি প্রবেশে কোন ভাবে চৌকির উপর বসবাস করছে পরিবারের লোকজন। যাদের দুর্ভোগের সীমা নেই। বেতিল চরের বৃদ্ধ শুকুর মন্ডলের সাথে আলাপ করতে গেলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জানান, 'সকালে সবাই না খাইয়া ছিলাম। দুপুরে বাড়ির পাশের এ্যাক জনের থিকা চাল আইনা গেদার মাও আলু ভর্তা দিয়া ভাত রানছে। আমরা কষ্ট কইরা মইরা যাইতাছি, আমাগোরে কি দেহার কেউ নাই?'
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩১ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার। এদিকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ, চুকাইবাড়ী, চিকাজানী ৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে এবং ইসলামপুর উপজেলার যমুনার তীরবর্তী ৭ ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্ল¬াবিত হয়ে অত্যন্ত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে যমুনার উলিয়ার ১২শ' মিটার দৈর্ঘ্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অধিকাংশ পানিতে বিলীন হয়ে গেছে।
রাজশাহী অফিস জানায়, বন্যার পানিতে জেলার বাঘা, চারঘাট, গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিলীন হয়েছে কয়েকশ' বিঘা ফসলী জমি। পদ্মার চরাঞ্চলে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনে শতাধিক পরিবার বাড়ি ছাড়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, বিপদসীমা ১৮.৫০ মিটার হলেও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজশাহীতে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিলো ১৭ দশমিক ৩২ মিটার। এদিকে পবা উপজেলার চরখিদিরপুরে গত দু'দিনে ৫৫ থেকে ৬০টি বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। ওই এলাকায় শহীদ মিনার ও বড় মসজিদ পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
শিবালয় (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, যমুনার পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আরিচা পয়েন্টে গতকাল মঙ্গলবার সকালে ৯ দশমিক ১০ অর্থাত্ বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর প্রভাবে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। দুর্গম চলাচঞ্চলে অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে পদ্মা-যমুনায় প্রবল বাতাসে সৃষ্ট ঢেউ ও স্রোতের কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা-কাজীর হাটসহ বিভিন্ন নৌরুটে ফেরি, লঞ্চ ও নৌকা চলাচল মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, গতকাল সকাল ১১টার দিকে উপজেলার চন্দনবাইশায় বন্যার পানিতে ডুবে সাকিম নামে ৭ মাসের এক শিশু মারা গেছে। চন্দনবাইশা ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হক জানান, ঘুঘুমারী শেখ পাড়ার মিজানুরের স্ত্রী ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে রেখে কাজ করার সময় হঠাত্ ঘরের মধ্যে পানিতে পড়ে সাকিম মারা যায় । এদিকে যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ও ভয়াবহ ভাঙনে উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়ায় নদী তীরবর্তী রৌহাদহ, ঘুঘুমারী, ইছামারা ও ফকিরপাড়া গ্রামের ১০ হাজার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ।
বিশ্বনাথ (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, ধারাবাহিক বর্ষণে তলিয়ে গেছে উপজেলার নিম্নাঞ্চল। প্রায় সাড়ে তিন থেকে চারশ' হেক্টর জমিতে লাগানো ধানের চারা তলিয়ে গেছে। এ নিয়ে কৃষকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। দুই তিন দিনের মধ্যে পানি না কমলে আমন ফসল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় রয়েছেন কৃষকরা। কিছু কিছু এলাকায় পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধানের চারা পচে গেছে। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খায়রুল আমিন বলেন, উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের বেশির ভাগ জমিতে লাগানো চারা পানিতে তলিয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment