ইনভয়েস কারসাজিতে কালোটাকা ॥ বছরে ৫৮ হাজার কোটি
কালো টাকার সন্ধানে ৩
০ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে গত দশ বছরে সৃষ্টি হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা
০ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েস হয় ২৫০ কোটি ডলার
০ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে গত দশ বছরে সৃষ্টি হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা
০ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েস হয় ২৫০ কোটি ডলার
কাওসার রহমান ॥ বৈদেশিক বাণিজ্যে মিথ্যা মূল্য ঘোষণা তথা মূল্য কারসাজির মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে বিপুল পরিমাণ কালো টাকার সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু চীনের ও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই প্রতিবছর এই মূল্য কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার কালো টাকার সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভারত থেকে বছরে আরও প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আসে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বছরে প্রায় ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হচ্ছে মূল্য কারসাজির মাধ্যমে। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এই অবৈধ টাকার একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই বাণিজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনা যেতে পারলে কম করে হলেও বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের শুল্ক আদায় হতো। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়াত ২৪ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে দেশে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ১০ বছরে শুধু চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের সৃষ্টি হয়েছে এক হাজার ৬১০ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৭৭ টাকা ধরলেও যার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, চীন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে স্পেয়ার পার্টসের দাম ৪ ডলার, আন্ডার ইনভয়েস করে তার দাম দেখায় ১০ সেন্ট। দেশে আসার পর ওই ১০ সেন্ট মূল্যের ওপর এনবিআর কর্মকর্তারা ৩১ শতাংশ জরিমানা ধার্য করেন। এতে ওই পণ্যের দাম দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১০ সেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে ওই আমদানিকারক জরিমানা দিয়ে ওই পণ্য ছাড়িয়ে নেন। কারণ জরিমানা দেয়ার পরও চার ডলারের একটি স্পেয়ার পার্টসের দাম পড়ে মাত্র ১৩.১০ সেন্ট।
এভাবে চীন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একটি ৪০ ফুট কন্টেনারে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ডলারের পণ্য আনা হয়। আর ডাইরেক্ট প্রোফরমা ইনভয়েসের (ডিপিআই) মাধ্যমে ওই পণ্য আমদানিতে মূল্য দেখানো হয় ৫ থেকে ৬ হাজার ডলার। আর পণ্যের বাকি মূল্য হুন্দির মাধ্যমে চীনা রফতানিকারককে বিদেশী মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়। এভাবে পণ্য আমদানির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রতিবছর শুধু বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা।
বর্তমানে চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আমদানি বাণিজ্য হচ্ছে। যে কারণে এ দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি। তবে ঘাটতির চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো-এই দুটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আন্ডার ইনভয়েস হচ্ছে। ওভার ইনভয়েস হলেও তার পরিমাণ অনেক কম। ফলে এই আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমেই সৃষ্টি হচ্ছে অবৈধ অর্থ, যাকে আমাদের দেশে কালো টাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চীনের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অর্থের সৃষ্টির হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবছর এই অবৈধ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩৫৪ কোটি ডলার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এই অবৈধ অর্থের সৃষ্টি হচ্ছে। চীন বার বার এ বিষয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশে কোন সরকারী কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ দেখায়নি। চলতি বছরের ৭ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের এক অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার বলে উল্লেখ করেন। একই বছরের ৩১ মার্চ গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে বাংলাদেশ সফররত ইউনান প্রদেশের গবর্নরের এক অনুষ্ঠানে একই পরিসংখ্যান পুনরাবৃত্তি করেন। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের দুই দেশের মধ্যে এক হাাজর কোটি ডলারের বাণিজ্যের বিপরীতে ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৭৭৫ কোটি ডলার বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ চীনে রফতানি করে ৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং চীন থেকে আমদানি করে ৬৩০ কোটি ডলার। শুধু তাই নয়, তিনি জানান, এটি-ই তাঁদের সরকারী পরিসংখ্যান। এর বাইরে তাঁরা কিছু জানেন না। অথচ ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কেউ একবারও খতিয়ে দেখছে না দুই দেশের বাণিজ্যের পরিসংখ্যানে কেন এত পার্থক্য হচ্ছে? দুই দেশের মধ্যে এত বাণিজ্য হলে সরকার আদৌ তার শুল্ক পাচ্ছে কিনা? না পেলে কেন পাচ্ছে না শুল্ক?
চীন এই অবৈধ বাণিজ্যের ইস্যুটি নিয়ে হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দেয় গত জুন মাসে কুনমিংয়ে নবম চায়না-সাউথ এশিয়া বিজনেস ফোরামে। ওই ফোরামে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইউনান প্রদেশের বাণিজ্য বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক শীর্ষক একটি পুস্তিকা উপস্থাপন করে। চীন সরকারের ওই ডকুমেন্টে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের গত ১০ বছরের বাণিজ্যের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়, যা ওই ফোরামে বাংলাদেশের উপস্থাপিত পরিসংখ্যানকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
ওই ফোরামে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২-১৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘চীন বাংলাদেশের এক বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। আমদানির বৃহত্তম উৎস। আমাদের বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৫ কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু পণ্য আমদানি হয়েছে ৬৩০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের।’
অথচ ইউনান প্রদেশের বাণিজ্য বিভাগের ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে চীন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৬০ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য এবং বাংলাদেশে রফতানি করেছে ৯৭০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। এ বছর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয় এক হাজার ৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের।
দুই দেশের বাণিজ্যের তথ্যে এত ফাঁরাক দেখে ফোরামে উপস্থিত শুধু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই নন, চীনা ব্যবসায়ীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের তথ্য নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন। এ ব্যাপারে অবশ্য উপস্থিত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান। তাঁদের বক্তব্য হলো- এটাই তাঁদের সরকারী পরিসংখ্যান। এর বাইরে তাঁরা কিছু জানেন না।
বাংলাদেশের সরকারী পরিসংখ্যান ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বার্ষিক অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস হচ্ছে ৩৪০ কোটি ডলার এবং রফতানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস হচ্ছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৭৭ টাকা ধরলেও বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।
এভাবে হিসাব করে দেখা যায়, গত ২০১২ সালে এই অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ ১৬১ কোটি ৫৯ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ১২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এই অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ৭৯ লাখ ডলার বা ১৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালে ছিল ৩০৬ কোটি ১২ লাখ ডলার বা ২৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে ছিল ১০৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলর বা ৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে ছিল ১৪৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলার বা ১১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে ছিল ৭৭ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বা ৫ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে ছিল ১০৪ কোটি ৫৮ লাখ ডলার বা ৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে ছিল ৭৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার বা ৬ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং ২০০৪ সালে ছিল ৭৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার বা ৬ হাজার ৪২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের সৃষ্টি হয়েছে এক হাজার ৬১০ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৭৭ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।
চীনের সঙ্গে গত ১৯ বছরের বাণিজ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত ২০১০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য অনেক বেড়ে গেছে। এই বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আন্ডার ইনভয়েসের পরিমাণও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আন্ডার ইনভয়েসের পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এক সময় ভারতে বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেকই ছিল অবৈধ বাণিজ্য, যা চোরাচালানের মাধ্যমে সংঘটিত হতো। বাণিজ্য উদারীকরণের পর সেই চোরাচালান অনেকটাই কমে গেছে। সেখানে এখন জায়গা করে নিয়েছে আন্ডার ইনভয়েসিং ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বছরে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলার আন্ডার ইনভয়েস হচ্ছে, যার মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে অবৈধ অর্থ বা কালো টাকা। এই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, ডাইরেক্ট প্রোফরমা ইনভয়েসের (ডিপিআই) মাধ্যমে এ সকল পণ্য আমদানি হচ্ছে। ডিপিআই যেহেতু করজালের আওতায় নেই, তাই ডিপিআইয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আন্ডার ইনভয়েসের সুযোগ নিচ্ছে।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, এক ব্যবসায়ী নিজে উপস্থিত থেকে চীনের ই-ইউ প্রভিন্স থেকে ৮০০ কার্টন স্টেশনারি পণ্য কিনেছেন। এর মধ্যে একটি কন্টেনারে ৬৮০ কার্টন পণ্য জায়গা নিয়েছে। এ সকল পণ্য দেশে আনার জন্য ছয় হাজার ডলারের এলসি দিয়ে ওই কন্টেনার তিনি দেশে নিয়ে এসেছেন। পরবর্তীতে আবার ছয় হাজার ডলারের ঋণপত্র (এলসি) দিয়ে বাকি পণ্যসহ আরও এক কন্টেনার স্টেশনারি পণ্য তিনি দেশে আনবেন বলে জানা যায়।
চীন থেকে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বৈদ্যুতিক পণ্য, জুতো, স্টেশনারি, ডেকোরেশন মেটেরিয়াল, তৈরি পোশাক, হার্ডওয়্যার ইনস্ট্রুমেন্ট, সিরামিক টাইলস, স্পেয়ার পার্টস ও মেশিনারি। বিশেষ করে রাজধানীর নগর ভবনের পেছনের মার্কেটগুলোতে যত পণ্য বিক্রি হয় তার প্রায় সবই আন্ডার ইনভয়েসের পণ্য।
এই আন্ডার ইনভয়েস পণ্যের সঙ্গে পেরে উঠছে না দেশের তৈরি পণ্য। ফলে একে একে রুগ্ন হয়ে পড়ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। অনুসন্ধান করতে গিয়েই জানা যায়, বিদেশী ইলেক্ট্র্রিক্যাল পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রুগ্ন হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোরিয়া ইলেক্ট্রিক্যাল কোম্পানি।
অনুসন্ধান করে আরও দেখা যায়, পাকিস্তান থেকে যে সকল বৈদ্যুতিক পণ্য আসে তার মাত্র ১০ শতাংশ আসে এলসির মাধ্যমে। আর ৯০ শতাংশই আসে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। একইভাবে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, হংকং প্রভৃতি দেশ থেকেও বছরে প্রায় দেড় শ’ কোটি ডলারের পণ্য আসে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই বছরে প্রায় ৫০৪ কোটি ডলারের আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েস হচ্ছে। এই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসের পরিমাণ খুবই কম। সিংহভাগই হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েস।
এর সঙ্গে ভারতের আন্ডার ইনভয়েসের বাণিজ্য যোগ করলে প্রতিবছর দেশের আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ৭৭ টাকা হিসাবে ধরলেও এই বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সৃষ্ট অবৈধ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বর্তমানে সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত আছে। গড়ে ৪০ শতাংশ শুল্ক ধরলেও এই বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে সরকার প্রায় তিন শ’ কোটি ডলার রাজস্ব পেত। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
এই বাণিজ্যের অবৈধ টাকা কিভাবে পাচার হয় তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, ওভার ইনভয়েসের টাকা সরাসরি বিদেশে চলে যায়। কিংবা রফতানিকারকরা রফতানি আয়ের পুরো আয় দেশে না এনে বিদেশী ক্রেতাদের ডিসকাউন্ট বা ছাড় দেখিয়ে ওই অর্থ বিদেশে রেখে দেন। আর আন্ডার ইনভয়েসের টাকা হু-ির মাধ্যমে পাচার করা হয় বিদেশে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের প্রবাসী আয়ে।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী হুন্দি ব্যবসায়ীদের সক্রিয় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ নেটওয়ার্কের মূল কেন্দ্র হচ্ছে দুবাই। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশীদের রেমিটেন্স ঢাকা থেকে টাকায় পরিশোধ করা হয়। আর তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ওখান থেকে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়। এতে যে শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, দেশের রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের প্রভাবেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ড. মইনুল হোসেন বলেন, ‘প্রবাসীদের মধ্যে যারা রেমিটেন্স পাঠায়, তারা ওই সব দেশ থেকে ডলার দিচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশে তাদের স্বজনদের দেয়া হচ্ছে টাকা। এতে যেমন বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।’
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ব্যাংকার মামুন রশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে আমদানির বিপরীতে অতি মূল্যায়িতভাবে ইনভয়েসিং করা হচ্ছে, যাকে বলা হয় ওভার ইনভয়েসিং। আমাদের মেশিনারি ও প্রকল্পের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি হয়ত ঢুকছে কিন্তু সেগুলোর উপযুক্ত মূল্য দেখানো যাচ্ছে না। ঋণপত্রের বিপরীতে অতিরিক্ত টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘রফতানিকারকের সহযোগিতায় আমদানিকারকের ব্যাংকে অতিরিক্ত টাকাটা জমা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। আমরা দেখতে পেয়েছি, বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রকল্প যখন দেশে বাস্তবায়িত হয়, সে সব প্রকল্পের যারা মালিক সে প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় এ ধরনের কাজগুলো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে বলে প্রতীয়মান।’
আন্ডার ইনভয়েস বন্ধ করতে ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনতে ২০১৩ সালের ৯ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেন অর্থমন্ত্রী। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এবং ৯ এপ্রিল বাণিজ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেন তিনি। ওই চিঠিতেও ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনার অনুরোধ করেন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার ইগো সমস্যার কারণে ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনতে হলে আমদানি নীতি সংশোধন করতে হবে।
অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এর দায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর চাপাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছে, এটা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্ব। আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, তাদের দায়িত্ব কর আদায়ের। এলসির মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক আদায় তাদের কাজ। এর বাইরে তাদের কিছু করার নেই। সরকারের এই দুই প্রতিষ্ঠানের ঠেলাঠেলির কারণে ডিপিআই করজালের আওতায় আসছে না এবং আন্ডার ইনভয়েসের পাগলা ঘোড়া থামছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনডেন্টিং এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কেএমএইচ শহীদুল হক বলেন, ‘ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনতে হলে আমদানি নীতি ২০১২-১৫ (এসআরও নং ৪১১-আইন/২০১২) এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৫ ধারা অর্থমন্ত্রীর পত্র মোতাবেক সংশোধন করতে হবে। এটা সংশোধন করলে আন্ডার ইনভয়েস অনেকটা কমে আসবে এবং রাজস্ব আদায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। ওই প্রজ্ঞাপনে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্টের ১৮-এ ও ১৮-বি ধারা সংশোধন করতে হবে। এ দুটি পদক্ষেপ নিলেই আন্ডার ইনভয়েসের পাগলা ঘোড়াকে বাগে আনা যাবে।’
আন্ডার ইনভয়েসের প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘আন্ডার ইনভয়েসের কারণে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। দেশে নতুন শিল্পায়ন হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। বরং আন্ডার ইনভয়েসের টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে দেশের প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আন্ডার ইনভয়েসের কারণে দেশে কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে। এই কালো টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের কারণে জমি, বাড়ি, গাড়ির দাম বেড়ে যাচ্ছে, যা সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে।’
ড. মাহবুব আলী বলেন, ‘বাংলাদেশে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার কোটিপতি আছে। কিন্তু ৫০ থেকে ৬০ জনও এক কোটি টাকার বেশি ট্যাক্স দেয় না। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, এখানে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে।’
কেন দেশে আন্ডার ইনভয়েস বেড়ে যাচ্ছে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার এবং শুল্ক বৈষম্যের কারণে আন্ডার ইনভয়েস বেড়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হলে শুল্ক কাঠামো সংস্কারসহ সকল ধরনের আমদানি প্রক্রিয়া করের আওতায় আনতে হবে। তাহলে দেশে রাজস্ব আদায় যেমন বাড়বে, তেমিন শিল্পায়ন হবে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। আন্ডার ইনভয়েস বন্ধের জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সুপারিশে ট্যারিফ ভ্যালু বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ট্যারিফ ভ্যালু বাড়িয়েও এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, আমাদের অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, বেশির ভাগ টাকা পাচার আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে হচ্ছে। এটা দেখভাল করার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ ব্যাপারে যৌথ উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান গবর্নর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে অনলাইন যোগসূত্র স্থাপন করা হচ্ছে। যাতে কী এলসি (লেটার অব ক্রেটিড) হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী পণ্য দেশে এলো কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা যায়।’
আতিউর রহমান বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশন লেভেল কম। তাদের সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় চলে এলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর একযোগে কাজ করলে এই আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েস কমে আসবে।’
ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট যুগোপযোগী করার জন্য সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই সংশোধনের কাজ সরকার করবে। এ জন্য খসড়া তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে।’
গবর্নর বলেন, টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট পরিবর্তন করা দরকার। এ জন্য আইন করতে হবে। আইন করার কাজ সরকারের হাতে। তবে অমরা একের পর এক রেগুলেশন করে যতদূর সম্ভব ফাঁকফোকর বন্ধ করার চেষ্টা করছি। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন আরও সহজ করা হচ্ছে। আমাদের নানামুখী পদক্ষেপের কারণেই এলসি খোলা ও এলসি নিষ্পত্তি খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রতিটি বৈদেশিক লেনদেন এখন ‘ডেসবোর্ডের’ মাধ্যমে হচ্ছে। ফলে কোন লেনদেনে সমস্যা দেখা দিলে আমাদের পরিদর্শকরা তা সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে ধরতে পারছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চলে যাচ্ছে।
পণ্য আমদানি-রফতানিতে মূল্য কারসাজি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আন্ডার ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে চুরি হয়-এটা আমাদের জানা আছে। এটা বন্ধ করার জন্য আমরা কাজ করছি। এ জন্য আমরা ডাইরেক্ট প্রোফরমা ইনভয়েসকে করজালের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছি। এক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট সংশোধন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই আইনটি অনেক পুরনো। সময়ে সময়ে সংশোধন করা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলোসহ পুরো আইনকে আধুনিকায়ন করা হবে। বিমা আইনকে আমরা যেভাবে আধুনিকায়ন করেছি, তেমনি ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন আইনকেও আধুনিকায়ন করা হবে।’
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ১০ বছরে শুধু চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের সৃষ্টি হয়েছে এক হাজার ৬১০ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৭৭ টাকা ধরলেও যার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, চীন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে স্পেয়ার পার্টসের দাম ৪ ডলার, আন্ডার ইনভয়েস করে তার দাম দেখায় ১০ সেন্ট। দেশে আসার পর ওই ১০ সেন্ট মূল্যের ওপর এনবিআর কর্মকর্তারা ৩১ শতাংশ জরিমানা ধার্য করেন। এতে ওই পণ্যের দাম দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১০ সেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে ওই আমদানিকারক জরিমানা দিয়ে ওই পণ্য ছাড়িয়ে নেন। কারণ জরিমানা দেয়ার পরও চার ডলারের একটি স্পেয়ার পার্টসের দাম পড়ে মাত্র ১৩.১০ সেন্ট।
এভাবে চীন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একটি ৪০ ফুট কন্টেনারে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ডলারের পণ্য আনা হয়। আর ডাইরেক্ট প্রোফরমা ইনভয়েসের (ডিপিআই) মাধ্যমে ওই পণ্য আমদানিতে মূল্য দেখানো হয় ৫ থেকে ৬ হাজার ডলার। আর পণ্যের বাকি মূল্য হুন্দির মাধ্যমে চীনা রফতানিকারককে বিদেশী মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়। এভাবে পণ্য আমদানির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রতিবছর শুধু বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা।
বর্তমানে চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আমদানি বাণিজ্য হচ্ছে। যে কারণে এ দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি। তবে ঘাটতির চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো-এই দুটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আন্ডার ইনভয়েস হচ্ছে। ওভার ইনভয়েস হলেও তার পরিমাণ অনেক কম। ফলে এই আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমেই সৃষ্টি হচ্ছে অবৈধ অর্থ, যাকে আমাদের দেশে কালো টাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চীনের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অর্থের সৃষ্টির হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবছর এই অবৈধ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩৫৪ কোটি ডলার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এই অবৈধ অর্থের সৃষ্টি হচ্ছে। চীন বার বার এ বিষয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশে কোন সরকারী কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ দেখায়নি। চলতি বছরের ৭ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের এক অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার বলে উল্লেখ করেন। একই বছরের ৩১ মার্চ গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে বাংলাদেশ সফররত ইউনান প্রদেশের গবর্নরের এক অনুষ্ঠানে একই পরিসংখ্যান পুনরাবৃত্তি করেন। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের দুই দেশের মধ্যে এক হাাজর কোটি ডলারের বাণিজ্যের বিপরীতে ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৭৭৫ কোটি ডলার বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ চীনে রফতানি করে ৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং চীন থেকে আমদানি করে ৬৩০ কোটি ডলার। শুধু তাই নয়, তিনি জানান, এটি-ই তাঁদের সরকারী পরিসংখ্যান। এর বাইরে তাঁরা কিছু জানেন না। অথচ ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কেউ একবারও খতিয়ে দেখছে না দুই দেশের বাণিজ্যের পরিসংখ্যানে কেন এত পার্থক্য হচ্ছে? দুই দেশের মধ্যে এত বাণিজ্য হলে সরকার আদৌ তার শুল্ক পাচ্ছে কিনা? না পেলে কেন পাচ্ছে না শুল্ক?
চীন এই অবৈধ বাণিজ্যের ইস্যুটি নিয়ে হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দেয় গত জুন মাসে কুনমিংয়ে নবম চায়না-সাউথ এশিয়া বিজনেস ফোরামে। ওই ফোরামে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইউনান প্রদেশের বাণিজ্য বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক শীর্ষক একটি পুস্তিকা উপস্থাপন করে। চীন সরকারের ওই ডকুমেন্টে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের গত ১০ বছরের বাণিজ্যের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়, যা ওই ফোরামে বাংলাদেশের উপস্থাপিত পরিসংখ্যানকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
ওই ফোরামে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২-১৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘চীন বাংলাদেশের এক বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। আমদানির বৃহত্তম উৎস। আমাদের বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৫ কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু পণ্য আমদানি হয়েছে ৬৩০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের।’
অথচ ইউনান প্রদেশের বাণিজ্য বিভাগের ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে চীন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৬০ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য এবং বাংলাদেশে রফতানি করেছে ৯৭০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। এ বছর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয় এক হাজার ৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের।
দুই দেশের বাণিজ্যের তথ্যে এত ফাঁরাক দেখে ফোরামে উপস্থিত শুধু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই নন, চীনা ব্যবসায়ীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের তথ্য নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন। এ ব্যাপারে অবশ্য উপস্থিত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান। তাঁদের বক্তব্য হলো- এটাই তাঁদের সরকারী পরিসংখ্যান। এর বাইরে তাঁরা কিছু জানেন না।
বাংলাদেশের সরকারী পরিসংখ্যান ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বার্ষিক অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস হচ্ছে ৩৪০ কোটি ডলার এবং রফতানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস হচ্ছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৭৭ টাকা ধরলেও বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।
এভাবে হিসাব করে দেখা যায়, গত ২০১২ সালে এই অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ ১৬১ কোটি ৫৯ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ১২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এই অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ৭৯ লাখ ডলার বা ১৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালে ছিল ৩০৬ কোটি ১২ লাখ ডলার বা ২৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে ছিল ১০৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলর বা ৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে ছিল ১৪৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলার বা ১১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে ছিল ৭৭ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বা ৫ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে ছিল ১০৪ কোটি ৫৮ লাখ ডলার বা ৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে ছিল ৭৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার বা ৬ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং ২০০৪ সালে ছিল ৭৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার বা ৬ হাজার ৪২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের সৃষ্টি হয়েছে এক হাজার ৬১০ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৭৭ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।
চীনের সঙ্গে গত ১৯ বছরের বাণিজ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত ২০১০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য অনেক বেড়ে গেছে। এই বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আন্ডার ইনভয়েসের পরিমাণও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আন্ডার ইনভয়েসের পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এক সময় ভারতে বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেকই ছিল অবৈধ বাণিজ্য, যা চোরাচালানের মাধ্যমে সংঘটিত হতো। বাণিজ্য উদারীকরণের পর সেই চোরাচালান অনেকটাই কমে গেছে। সেখানে এখন জায়গা করে নিয়েছে আন্ডার ইনভয়েসিং ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বছরে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলার আন্ডার ইনভয়েস হচ্ছে, যার মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে অবৈধ অর্থ বা কালো টাকা। এই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, ডাইরেক্ট প্রোফরমা ইনভয়েসের (ডিপিআই) মাধ্যমে এ সকল পণ্য আমদানি হচ্ছে। ডিপিআই যেহেতু করজালের আওতায় নেই, তাই ডিপিআইয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আন্ডার ইনভয়েসের সুযোগ নিচ্ছে।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, এক ব্যবসায়ী নিজে উপস্থিত থেকে চীনের ই-ইউ প্রভিন্স থেকে ৮০০ কার্টন স্টেশনারি পণ্য কিনেছেন। এর মধ্যে একটি কন্টেনারে ৬৮০ কার্টন পণ্য জায়গা নিয়েছে। এ সকল পণ্য দেশে আনার জন্য ছয় হাজার ডলারের এলসি দিয়ে ওই কন্টেনার তিনি দেশে নিয়ে এসেছেন। পরবর্তীতে আবার ছয় হাজার ডলারের ঋণপত্র (এলসি) দিয়ে বাকি পণ্যসহ আরও এক কন্টেনার স্টেশনারি পণ্য তিনি দেশে আনবেন বলে জানা যায়।
চীন থেকে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বৈদ্যুতিক পণ্য, জুতো, স্টেশনারি, ডেকোরেশন মেটেরিয়াল, তৈরি পোশাক, হার্ডওয়্যার ইনস্ট্রুমেন্ট, সিরামিক টাইলস, স্পেয়ার পার্টস ও মেশিনারি। বিশেষ করে রাজধানীর নগর ভবনের পেছনের মার্কেটগুলোতে যত পণ্য বিক্রি হয় তার প্রায় সবই আন্ডার ইনভয়েসের পণ্য।
এই আন্ডার ইনভয়েস পণ্যের সঙ্গে পেরে উঠছে না দেশের তৈরি পণ্য। ফলে একে একে রুগ্ন হয়ে পড়ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। অনুসন্ধান করতে গিয়েই জানা যায়, বিদেশী ইলেক্ট্র্রিক্যাল পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রুগ্ন হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোরিয়া ইলেক্ট্রিক্যাল কোম্পানি।
অনুসন্ধান করে আরও দেখা যায়, পাকিস্তান থেকে যে সকল বৈদ্যুতিক পণ্য আসে তার মাত্র ১০ শতাংশ আসে এলসির মাধ্যমে। আর ৯০ শতাংশই আসে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। একইভাবে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, হংকং প্রভৃতি দেশ থেকেও বছরে প্রায় দেড় শ’ কোটি ডলারের পণ্য আসে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই বছরে প্রায় ৫০৪ কোটি ডলারের আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েস হচ্ছে। এই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসের পরিমাণ খুবই কম। সিংহভাগই হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েস।
এর সঙ্গে ভারতের আন্ডার ইনভয়েসের বাণিজ্য যোগ করলে প্রতিবছর দেশের আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ৭৭ টাকা হিসাবে ধরলেও এই বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সৃষ্ট অবৈধ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বর্তমানে সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত আছে। গড়ে ৪০ শতাংশ শুল্ক ধরলেও এই বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে সরকার প্রায় তিন শ’ কোটি ডলার রাজস্ব পেত। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
এই বাণিজ্যের অবৈধ টাকা কিভাবে পাচার হয় তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, ওভার ইনভয়েসের টাকা সরাসরি বিদেশে চলে যায়। কিংবা রফতানিকারকরা রফতানি আয়ের পুরো আয় দেশে না এনে বিদেশী ক্রেতাদের ডিসকাউন্ট বা ছাড় দেখিয়ে ওই অর্থ বিদেশে রেখে দেন। আর আন্ডার ইনভয়েসের টাকা হু-ির মাধ্যমে পাচার করা হয় বিদেশে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের প্রবাসী আয়ে।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী হুন্দি ব্যবসায়ীদের সক্রিয় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ নেটওয়ার্কের মূল কেন্দ্র হচ্ছে দুবাই। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশীদের রেমিটেন্স ঢাকা থেকে টাকায় পরিশোধ করা হয়। আর তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ওখান থেকে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়। এতে যে শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, দেশের রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের প্রভাবেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ড. মইনুল হোসেন বলেন, ‘প্রবাসীদের মধ্যে যারা রেমিটেন্স পাঠায়, তারা ওই সব দেশ থেকে ডলার দিচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশে তাদের স্বজনদের দেয়া হচ্ছে টাকা। এতে যেমন বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।’
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ব্যাংকার মামুন রশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে আমদানির বিপরীতে অতি মূল্যায়িতভাবে ইনভয়েসিং করা হচ্ছে, যাকে বলা হয় ওভার ইনভয়েসিং। আমাদের মেশিনারি ও প্রকল্পের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি হয়ত ঢুকছে কিন্তু সেগুলোর উপযুক্ত মূল্য দেখানো যাচ্ছে না। ঋণপত্রের বিপরীতে অতিরিক্ত টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘রফতানিকারকের সহযোগিতায় আমদানিকারকের ব্যাংকে অতিরিক্ত টাকাটা জমা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। আমরা দেখতে পেয়েছি, বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রকল্প যখন দেশে বাস্তবায়িত হয়, সে সব প্রকল্পের যারা মালিক সে প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় এ ধরনের কাজগুলো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে বলে প্রতীয়মান।’
আন্ডার ইনভয়েস বন্ধ করতে ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনতে ২০১৩ সালের ৯ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেন অর্থমন্ত্রী। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এবং ৯ এপ্রিল বাণিজ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেন তিনি। ওই চিঠিতেও ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনার অনুরোধ করেন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার ইগো সমস্যার কারণে ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনতে হলে আমদানি নীতি সংশোধন করতে হবে।
অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এর দায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর চাপাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছে, এটা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্ব। আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, তাদের দায়িত্ব কর আদায়ের। এলসির মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক আদায় তাদের কাজ। এর বাইরে তাদের কিছু করার নেই। সরকারের এই দুই প্রতিষ্ঠানের ঠেলাঠেলির কারণে ডিপিআই করজালের আওতায় আসছে না এবং আন্ডার ইনভয়েসের পাগলা ঘোড়া থামছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনডেন্টিং এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কেএমএইচ শহীদুল হক বলেন, ‘ডিপিআইকে করজালের আওতায় আনতে হলে আমদানি নীতি ২০১২-১৫ (এসআরও নং ৪১১-আইন/২০১২) এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৫ ধারা অর্থমন্ত্রীর পত্র মোতাবেক সংশোধন করতে হবে। এটা সংশোধন করলে আন্ডার ইনভয়েস অনেকটা কমে আসবে এবং রাজস্ব আদায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। ওই প্রজ্ঞাপনে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্টের ১৮-এ ও ১৮-বি ধারা সংশোধন করতে হবে। এ দুটি পদক্ষেপ নিলেই আন্ডার ইনভয়েসের পাগলা ঘোড়াকে বাগে আনা যাবে।’
আন্ডার ইনভয়েসের প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘আন্ডার ইনভয়েসের কারণে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। দেশে নতুন শিল্পায়ন হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। বরং আন্ডার ইনভয়েসের টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে দেশের প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আন্ডার ইনভয়েসের কারণে দেশে কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে। এই কালো টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের কারণে জমি, বাড়ি, গাড়ির দাম বেড়ে যাচ্ছে, যা সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে।’
ড. মাহবুব আলী বলেন, ‘বাংলাদেশে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার কোটিপতি আছে। কিন্তু ৫০ থেকে ৬০ জনও এক কোটি টাকার বেশি ট্যাক্স দেয় না। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, এখানে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে।’
কেন দেশে আন্ডার ইনভয়েস বেড়ে যাচ্ছে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার এবং শুল্ক বৈষম্যের কারণে আন্ডার ইনভয়েস বেড়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হলে শুল্ক কাঠামো সংস্কারসহ সকল ধরনের আমদানি প্রক্রিয়া করের আওতায় আনতে হবে। তাহলে দেশে রাজস্ব আদায় যেমন বাড়বে, তেমিন শিল্পায়ন হবে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। আন্ডার ইনভয়েস বন্ধের জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সুপারিশে ট্যারিফ ভ্যালু বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ট্যারিফ ভ্যালু বাড়িয়েও এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, আমাদের অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, বেশির ভাগ টাকা পাচার আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে হচ্ছে। এটা দেখভাল করার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ ব্যাপারে যৌথ উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান গবর্নর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে অনলাইন যোগসূত্র স্থাপন করা হচ্ছে। যাতে কী এলসি (লেটার অব ক্রেটিড) হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী পণ্য দেশে এলো কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা যায়।’
আতিউর রহমান বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশন লেভেল কম। তাদের সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় চলে এলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর একযোগে কাজ করলে এই আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েস কমে আসবে।’
ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট যুগোপযোগী করার জন্য সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই সংশোধনের কাজ সরকার করবে। এ জন্য খসড়া তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে।’
গবর্নর বলেন, টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট পরিবর্তন করা দরকার। এ জন্য আইন করতে হবে। আইন করার কাজ সরকারের হাতে। তবে অমরা একের পর এক রেগুলেশন করে যতদূর সম্ভব ফাঁকফোকর বন্ধ করার চেষ্টা করছি। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন আরও সহজ করা হচ্ছে। আমাদের নানামুখী পদক্ষেপের কারণেই এলসি খোলা ও এলসি নিষ্পত্তি খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রতিটি বৈদেশিক লেনদেন এখন ‘ডেসবোর্ডের’ মাধ্যমে হচ্ছে। ফলে কোন লেনদেনে সমস্যা দেখা দিলে আমাদের পরিদর্শকরা তা সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে ধরতে পারছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চলে যাচ্ছে।
পণ্য আমদানি-রফতানিতে মূল্য কারসাজি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আন্ডার ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে চুরি হয়-এটা আমাদের জানা আছে। এটা বন্ধ করার জন্য আমরা কাজ করছি। এ জন্য আমরা ডাইরেক্ট প্রোফরমা ইনভয়েসকে করজালের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছি। এক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট সংশোধন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই আইনটি অনেক পুরনো। সময়ে সময়ে সংশোধন করা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলোসহ পুরো আইনকে আধুনিকায়ন করা হবে। বিমা আইনকে আমরা যেভাবে আধুনিকায়ন করেছি, তেমনি ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন আইনকেও আধুনিকায়ন করা হবে।’
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/
No comments:
Post a Comment