Tuesday, August 19, 2014

গাজার জনগণের সামাজিক মিডিয়াযুদ্ধ

গাজার জনগণের সামাজিক মিডিয়াযুদ্ধ
ইসরাইলের দানবীয় সামরিক শক্তি গাজায় হিংস্র আক্রমণ চালিয়ে ১৭শ’ অসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা ও গাজার এক বড় অংশ ধূলিসাত করে দিয়ে সামরিক দিক দিয়ে হয়ত কিছু ফায়দা তুলে নিয়েছে, কিন্তু তারা হেরে গেছে গাজার সামাজিক মিডিয়াযুদ্ধে। এই সামাজিক মিডিয়া গাজার যুদ্ধাঞ্চলের লোকজনের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সংযোগই শুধু ঘটায়নি, উপরন্তু তা যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সামাজিক মিডিয়ার মধ্যে টুইটারের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
যুদ্ধ ও তার ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করার জন্য আমরা এতদিন পুরনো মিডিয়া চ্যানেলগুলোর ওপর নির্ভর করতাম। আজ সে জায়গায় সোস্যাল মিডিয়াও নিজের পথ করে নিয়েছে। উপরন্তু পুরনো মিডিয়া চ্যানেলের সঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ার শক্তির ভারসাম্যে এক ব্যাপক পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক মিডিয়া নিজ প্রভাব রাখছে তিনটি কাজ করার ক্ষমতার মাধ্যমে। প্রথমত, টিভি নেটওয়ার্ক যা দেখিয়ে থাকে তা থেকে স্বাধীনভাবে জনগণকে বাস্তবতা বা তার এক সংস্করণ দেখানো। দ্বিতীয়ত, কর্মরত সাংবাদিকদের ঘটনাটা জানিয়ে দিয়ে তাদের কাজ সহজ করে দেয়া। টুইটারের তথ্য ও চিত্র দেখে সাংবাদিকরা সহজেই শর্টকাট পথে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করতে পারছেন। এতে তাদের শ্রম ও সময় দুটোই বাঁচছে। তৃতীয়ত, বাস্তবতাকে সঠিকভাবে তুলে ধরে সামাজিক মিডিয়া প্রচলিত মিডিয়ার তুলনায় মানুষের চেতনার জগতে অনেক গভীর ও শক্তিশালী প্রভাব রাখছে।
একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা ও সত্য কিভাবে পরস্পরকে ছেদ করবে গাজা তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গার্ডিয়ান পত্রিকার রিপোর্টার পল ম্যাসন গাজার এ সময়কার সামাজিক মিডিয়ার ভূমিকা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, সকাল বেলায় সেলফোনের মাধ্যমে তথ্যের প্রবাহ ঘটে। সাধারণ মানুষের অনেকের হাতে স্মার্টফোন নেই বটে তবে তাদের হাতে যে সেট আছে তা রেডিও হিসেবেও কাজ করে। কাজেই প্রাতঃরাশের টেবিলে বসে আগের রাতের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি মৃত্যুর বিবরণ পাওয়া যায়।
গাজার কিছু কিছু তরুণ আছে যারা লড়াইয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা হামাসের বেতার বা টিভি কেন্দ্রের পক্ষে রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করতে রাজি হয়নি। বরং তার বদলে তারা অসাধ্য সাধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা হলোÑ সশস্ত্র প্যারামিলিটারির দ্বারা চালিত একটি দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা। এই তরুণ সাংবাদিকরা তথ্যের এমন এক জগতে বাস করে যা ফেসবুক, টুইটার ও ইস্টাগ্রাম দ্বারা সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্যের সঙ্গে যুক্ত। তারা ডিজিটাল ক্যামেরার উদ্ভাবনীমূলক ব্যবহার খুঁজে পেয়েছে। এদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় প্রখরভাবে কাজ করে। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে তারা টের পায় চক্বর মেরে চলা একটি এফ-১৬ বিমান নিকষ কালো অন্ধকার নগরীর বুকে কখন বোমা ফেলবে। তারা জানালা দিয়ে একটি ডিএসএলআর ঝুলিয়ে দেবে। সেটা এতদূর পর্যন্ত খোলা অবস্থায় বাড়ানো থাকবে যে বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞের রাত্রিকালীন দৃশ্য ক্যামেরায় ঠিকই ধরা পড়বে। অথচ খালিচোখে দেখতে গেলে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না। উদ্দেশ্য ব্যবহারযোগ্য কোন ফটো তৈরি করা নয়, বরং আক্রমণের টার্গেট কি ছিল সে ব্যাপারে অন্যদের সবাইকে এড়িয়ে আগেভাগে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা।
গার্ডিয়ানের সেই সাংবাদিক পল ম্যাসন জানান, গাজার মতো যুদ্ধাঞ্চলে প্রচার-প্রচারণা বেশ তীব্র। সেই প্রচারের রূপটা এফ-১৬ বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত লিফলেটও হতে পারে আবার গভীর রাতে টিভিতে প্রচারিত হামাস কমান্ডারদের ভাষণও হতে পারে। এ সবই টুইটার আর ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তবে যুদ্ধকালীন আর সব প্রচারণার মতো এর কার্যকারিতা শুধু তখনই থাকে যখন তাতে বাস্তবতার ছোঁয়া থাকে। গাজার মানুষ কিউবার মতো বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বস্তুগতভাবে বিচ্ছিন্ন। এখানে আধুনিকতার যা কিছু আছে সেগুলোসহ সবই সেই ১৯৭০-এর দশকের যুগে আটকে পড়া অর্থনীতির মধ্যে মিশে আছে। তাই জরাজীর্ণ ভলভো এবং ততোধিক বিপর্যস্ত খচ্চরের পাশে মাঝে মধ্যে ঝকঝকে নতুন গাড়িও চলতে দেখা যায়।
গাজার মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চায়। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাদের কুয়েত, এমনকি সুদানের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হয়। তাদের মস্তো আশঙ্কা হলো পাশ্চাত্যের সংস্পর্শের আঘাতে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবে কিংবা এমনভাবে বদলে যাবে যে আর দেশে ফিরবে না। তবে যাই হোক অতি মেধাবী ও শিক্ষিত ছেলেমেয়েদেরও চিরতরের জন্য গাজা ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এভাবেই বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় গাজার মানুষদের। আর বিচ্ছিন্ন থাকার কারণেই তথ্যকে বাস্তবতাকে ঘিরে পুনর্বিন্যস্ত করতে হয়। হামাসের সামরিক নেতা কি বলছেন প্রত্যেককে তা গ্রাহ্যের মধ্যে নিতে হয়। তাঁর ভাষণ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। নেতানিয়াহুর ভাষণ ভিন্ন কারণে টিভিতে শোনা হয়। নেতানিয়াহুর প্রসঙ্গ এলেই গাজার প্রতিটি মানুষ শখের মনস্তাত্ত্বিক বনে যান। তারা নেতানিয়াহুর চেহারার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি ভাঁজ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ইসরাইলের ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাব্য লক্ষণগুলোর অনুসন্ধান করেন। গাজাবাসীর অনেকের বিশ্বাস যে, ইসরাইলের গণমাধ্যমে নিহত ইসরাইলী সৈন্যের যে সংখ্যা দেয়া হয়ে থাকে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা তার দ্বিগুণ। ইসরাইলী বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত লিফলেট নিয়ে তারা নানান ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ করে। তারা জোর দিয়ে বলে যে ইসরাইলী সৈন্য গাজার শহরাঞ্চলে প্রবেশের চেষ্টা করলে পরাজিত হবে। অথচ ইতোমধ্যে তারা যে শহরাঞ্চলের অনেক জায়গা দখল করে নিয়েছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, গাজার মানুষের নিজ পক্ষের প্রচার প্রচারণায় বিশ্বাস করার যথেষ্ট আগ্রহ আছে এবং এখানেই প্রচার প্রচারণার সার্থকতা।
সামাজিক মিডিয়া বাড়তি স্থান যুগিয়েছে যেখানে অধিকতর সত্যনিষ্ঠ ও স্ক্ষ্মূ বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা চলতে পারে এবং সেইসঙ্গে তা বাইরের জগতকে তথ্য যোগানোর পথ সৃষ্টি করতে পারে। গাজার যুদ্ধে সামাজিক মিডিয়ার পরিবেশিত প্রধান তথ্য ছবির আকারে এসেছে। বলা হয়ে থাকে যে, ছবিরও কারসাজি করা যায়। কিন্তু তারপরও ঘটনাস্থলে কেউ থাকলে সে বলতে পারে কোন ছবিটি বাস্তব এবং কোনটি নয়। কাজেই ভুয়া ছবিটি এক সময় ঠিকই ধরা পড়ে যায়। গাজার যুদ্ধের সময় লাশের ছবি, বিধ্বংস্ত বাড়িঘর ভবনের ছবি, আহত ও ক্ষুব্ধ মানুষের ছবিই গাজার জনগণ ও বহির্বিশ্বের জনগণের মধ্যে যোগাযোগের নীরব রূপ ধারণ করেছিল। যুদ্ধের ছবি সর্বদাই দর্শক মনে সুউচ্চ প্রভাব ফেলে। কিন্তু গাজার এই ছবিগুলোই সম্ভবত প্রথম যুদ্ধের ছবি যার বেশিরভাগই তুলেছে অপেশাদার লোকজন।
চলমান ডেস্ক
সূত্র : গার্ডিয়ান
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment