সমন্বয়হীন অর্থবছর
শাহ আলম খান
প্রকাশ : ২০ আগস্ট, ২০১৪
অর্থবছরের সঙ্গে শিক্ষাবর্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডার, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থের জোগান দেয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা চলছে। অর্থবছরের শুরুতে টাকার অভাব এবং বর্ষার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে অর্থবছর শেষে বরাদ্দের টাকা খরচে তড়িঘড়ি করায় মানহীন কাজ হচ্ছে। এতে বাড়ছে দুর্নীতি, বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রকল্প ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়নেও দেখা দিচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। এ কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদরা সমন্বয়হীনতা দূর করার জন্য অর্থবছর পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছেন। অর্থবছর জটিলতায় পড়ে জেলা প্রশাসকরাও স্থানীয় কর্মকাণ্ডে এ সমন্বয়হীনতা অনুভব করছেন। এ কারণে তারাও সরকারের উচ্চপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের সঙ্গে অর্থবছরের সমন্বয় করার জন্য সুপারিশ করেছেন।
বাংলাদেশে অর্থবছর শুরু হয় জুলাই মাসে। শেষ হয় জুন মাসে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জানুয়ারি থেকে, শেষ হয় ডিসেম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ক্যালেন্ডার শুরু হয় জুলাইয়ে, শেষ হয় জুনে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ষ শুরু হয় জানুয়ারি থেকে, শেষ হয় ডিসেম্বরে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বছর শুরু হচ্ছে ১ জানুয়ারি থেকে। একটি দেশে নানা ধরনের ‘বর্ষ’ থাকায় প্রয়োজনীয় কাজ সারতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। খোদ সরকারই বেশি সমস্যায় পড়ে থাকে। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে সরকারকে ঝামেলায় পড়তে হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান অর্থবছরের সঙ্গে শিক্ষাবর্ষ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ক্যালেন্ডার এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সমন্বয়হীনতা দূর করা না গেলে অর্থবছরকেন্দ্রিক জটিলতা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। অর্থবছর পরিবর্তন করে সংকট সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে লাভ-ক্ষতির বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। কারণ এটি মোটেও সহজ কাজ নয়। ব্যাপক ব্যয়সাধ্যও বটে।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, অর্থবছর নির্ধারণের সবচেয়ে উপযোগী সময় হচ্ছে মার্চ টু এপ্রিল। কর্পোরেট ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, কৃষিসহ অর্থনৈতিক প্রবাহ তৈরি করে এমন সব খাতের হিসাবের সঙ্গেই এ সময়টির সঙ্গতি মেলানো সম্ভব হবে। এটি করতে সরকারকে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হবে না। তিনি বলেন, শুধু প্রথম বছরটি নয় মাস ধরে হিসাব করতে হবে। নতুনভাবে অর্থবছর সাজানো হলে সমন্বয়হীনতা দূর হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ১ জুলাই থেকে অর্থবছর শুরু হওয়ায় সরকারের নতুন বছরের সমুদয় কর্মকাণ্ড শুরু হচ্ছে এ সময় থেকে। কিন্তু রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় বছরের শুরুতে সরকারের আর্থিক সংকট থাকে প্রকট। এই সময়ে সরকার ইচ্ছা থাকলেও উন্নয়নসহ অন্যান্য কাজে অর্থ ছাড় করতে পারে না। কারণ এ সময়টা সরকার চলে ঋণ করে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩৫ দিনে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৬ হাজার ৩০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে অর্থবছরের প্রথম তিন মাস চলে যায় টাকার সংকটের কারণে। এছাড়া নানা কারণে বছরের শুরুতে প্রকল্প অনুমোদন করাও সম্ভব হয় না। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রকল্প চূড়ান্ত করতে চলে যায় ছয় মাস। চালু প্রকল্পে অর্থ সংকটের কারণে ছাড় বন্ধ থাকে। এছাড়া জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হয় বর্ষাকাল। বর্ষাকালে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা সম্ভব হয় না। এদিকটিও সরকারকে মাথায় রাখতে হয়। যে কারণে জুলাইয়ে অর্থবছর শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে কাজ শুরু হচ্ছে জানুয়ারি থেকে। এ সময়ে এসে সরকারের রাজস্ব আদায়, বৈদেশিক অনুদান ও বৈদেশিক ঋণ পাওয়া বাড়ে। ফলে অর্থ ছাড়ও বেড়ে যায়। জানুয়ারিতে শুরু হওয়া কাজ জুনের মধ্যে শেষ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে বরাদ্দ ব্যয়ে তড়িঘড়ি শুরু হয়। এতেও কাজ শেষ না হওয়ায় চলে যায় পরের অর্থবছরে। সেখানে বরাদ্দ নিয়ে দেখা দেয় নতুন জটিলতা।
শিক্ষাবর্ষ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ায় এই খাতের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ব্যাপারেও সরকার অর্থবছরকেন্দ্রিক কার্যক্রম করে। বিশেষ করে কোনো স্কুলের শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ বা অন্য কোনো উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দের পর কাজ শুরু হয় জানুয়ারির দিকে। এই সময়ে নতুন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর কারণে হোঁচট খেতে হয়। ব্যবসায়ীরা জানুয়ারি থেকে বছর হিসাব করলেও সরকারের সঙ্গে লেনদেন হচ্ছে অর্থবছরকেন্দ্রিক। ফলে শুরুতেই অর্থ ছাড় নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত জানুয়ারি টু ডিসেম্বরভিত্তিক হিসাব পরিচালনা করছে। নিু উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাবর্ষেরও একই হিসাব। আবার কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে মার্চ টু এপ্রিল কৃষিতে চাঙ্গা ভাব থাকে। মানুষের পকেটে পয়সা থাকে। অর্থবছর গণনার এ সময়টিও ভালো সময়। বিশ্বের অনেক দেশেই মার্চ টু এপ্রিল অর্থবছর ধরা হয়েছে। সেটি আমাদের দেশেও করা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ক্যালেন্ডার শুরু হচ্ছে জুলাই থেকে। তারাও অর্থ না পাওয়ায় একে কার্যকর করতে পারছে না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা, জরিপসহ অনেক কাজ থাকে যেগুলো একাডেমিক ক্যালেন্ডারের শুরু থেকে করতে হয়। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে এগুলো শুরু করা যায় না। আবার যখন অর্থের সংস্থান মেলে তখন সময় থাকে না।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে অর্থবছর নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও সেটি হওয়া উচিত। এতে অর্থ ব্যবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের কর্ণধার লায়ন এমকে বাশার বলেন, শিক্ষাবর্ষ ও অর্থবর্ষ অভিন্ন হলে সব ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে জাতীয় কর্মকাণ্ডে সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্রে। এই সমন্বয় থাকলেই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
কোন দেশে অর্থবছর কখন : জানা গেছে, পাকিস্তান ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক রয়েছে এমন আর কোনো দেশেই জুলাই টু জুন অর্থবছর হিসাব করা হয় না। ভারত ও শ্রীলংকায় অর্থবছর হিসাব করা হয় পহেলা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। মালদ্বীপ ও ভুটানে পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর, নেপালে ২১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রে পহেলা অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপানে অর্থবছর হিসাব করা হচ্ছে পহেলা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশ পাকিস্তান আমলে প্রবর্তিত অর্থবছর ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) বর্তমান চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার অন্যতম কৌশল হিসেবে অর্থবছর মার্চে শুরু হওয়া প্রয়োজন। এতে অর্থ ব্যবহারে গতি আসবে।
No comments:
Post a Comment