Wednesday, August 20, 2014

পাচার করা টাকায় দেশে দেশে গড়ে উঠেছে ॥ সেকেন্ড হোম কালো টাকার সন্ধানে ৪ ০ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আমলারাও টাকা পাচারে পিছিয়ে নেই ০ ১/১১-এর পর থেকে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যত-আতঙ্কে কিছু টাকা বিদেশে রাখছে

পাচার করা টাকায় দেশে দেশে গড়ে উঠেছে ॥ সেকেন্ড হোম
কালো টাকার সন্ধানে ৪
০ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আমলারাও টাকা পাচারে পিছিয়ে নেই
০ ১/১১-এর পর থেকে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যত-আতঙ্কে কিছু টাকা বিদেশে রাখছে
কাওসার রহমান ॥ বিদেশীর জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। অন্তত পাঁচ লাখ বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পের সুযোগ গ্রহণ করেছে। কানাডায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী বসবাস করে এমন একটি এলাকার নামকরণ হয়েছে বেগমপাড়া। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশীদের এমনই একটি সেকেন্ড হোম গড়ে উঠেছে যার নাম সচিবপাড়া। থাইল্যান্ড, হংকং সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশেও অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে। সেখানে তাঁরা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সিঙ্গাপুর-সৌদি আরবেও এদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কিনেছেন দামী এ্যাপার্টমেন্ট।
অনুসন্ধান করে দেখা যায়, শুধু ব্যবসায়ীরাই নন, টাকা পাচার থেকে পিছিয়ে নেই রাজনীতিক-আমলারাও। দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা বিদেশে টাকা পাচার করে সম্পদ গড়ে তুলেছেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আঁচ থেকে বাঁচতে তারা গড়ে তুলেছেন স্বস্তির বিকল্প আবাসন। তবে এ টাকা পাচারে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা। সুইস ব্যাংকে টাকা রেখে এবং বিদেশে সেকেন্ড হোম কিনে কিংবা ব্যবসায়িক স্থাপনা গড়ে তুলেছেন নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য। মক্কার জমজম টাওয়ারে যেখানে একটি এ্যাপার্টমেন্টের দামই এক কোটি ডলার, সেখানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক ব্যাংকার মামুন রশিদ বলেন, ‘এক-এগারো’র পর এখন দেশের সব ব্যবসায়ীই আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন। তারা মনে করেন, কিছু পরিমাণ টাকা বিদেশে রেখে দেয়া উচিত। বিপদের সময় কাজে দেবে। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়ার, নিজেদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য বিদেশের ব্যাংকে টাকা থাকা প্রয়োজন। এ জন্য ব্যবসায়ীরা এখন বিদেশে টাকা রাখাকে অগ্রাধিকার হিসৈবে মনে করেন।’
গত বছর মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশীর জন্য মালয়েশিয়া সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। এর আগে মালয়েশিয়া সরকারের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগকারী। দেশ থেকে বিদেশে কোন টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোন অনুমোদন দেয়া হয় না। তারপরও বাংলাদেশ কিভাবে মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হলো।
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পের সুযোগ নিয়েছেন এমন একজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বাংলাদেশীদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই দেশে সেকেন্ড হোম করার সুযোগ-সুবিধা অনেক সহজ। একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করলেই এ সুযোগ দেয়া হয়। এ সুযোগটিই নিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলারা।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন এমন বাংলাদেশীদের সংখ্যা কম করে হলেও পাঁচ লাখ হবে। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার সেখানে ফ্ল্যাট কিনে নিজের আবাসন গড়ে তুলেছেন। কারণ সেকেন্ড হোম সুযোগ নিলে খুব অল্প সুদে মালয়েশিয়ান ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করে থাকে।’
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. মইনুল হোসেন জানান, ‘নিশ্চিত ওই সব টাকা পাচার করা হয়েছে। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন অনুমোদন নেই মালয়েশিয়ায় টাকা নেয়ার। তারপরও টাকা গেছে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, এই টাকা পাচার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘টাকা পাচারের পাশাপাশি বিদেশে সেকেন্ড হোম করার প্রবণতা বাড়ছে। রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই কালো টাকার মালিকদের মধ্যে এ প্রবণতা বাড়ছে।’
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘টাকা না পাচার হলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলো কিভাবে? রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় দুর্নীতিবাজরা দেশে টাকা রাখছেন না। দেশের দুর্যোগের সময় তাঁরা যাতে আরও ভাল থাকতে পারেন সে জন্য দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে রাখছেন।’
এক/এগারোর কেয়ারটেকার সরকারের আমলে কালো টাকার মালিকদের তালিকা ছাপা হয়েছে। এই তালিকায় নাম এসেছে সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে অফিসের পিয়ন এমনকি দালাল পর্যন্ত। বালিশের ভেতর টাকা, চালের ড্রামে টাকা, বস্তায় টাকা, গাড়িতে টাকা। ওসমান গনি থেকে শুরু করে অফিস পিয়নের বাগানবাড়ি, হরিণ বিহার, অট্টালিকা, গাড়ি বিলাস কত কাহিনী তখন বেরিয়ে আসে। ওই সময় নেয়া উদ্যোগের পর একমাত্র দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র কোকোর সিঙ্গাপুরে পাচার করা তিন দফায় প্রায় ২০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেশে এসেছে।
ব্রিটেনের সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ডইয়ার্ডের একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে পাঠানো হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কয়েক রাজনৈতিক নেতার নামে সে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমা রয়েছে। এ ব্যাপারে ওই সময়ে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন তা একেবারে থেমে আছে। থাইল্যান্ডে কয়েক রাজনৈতিক নেতা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে। অনেক দেশ পাচার করা টাকা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না করলেও মালয়েশিয়া ও সুইজ্যারল্যান্ড এসব তথ্য প্রকাশ করছে।
বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা বিদেশে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। সেখানে তাঁরা ব্যবসায়ের বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠান খুলছেন। বাংলাদেশী এক্সিকিউটিভরা বিদেশী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, এমনকি অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীর বসতি বাড়ছে। এই বাংলাদেশী বসতি স্থাপনকারীরা সবাই যে যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা কানাডার নাগরিক বা ওই দেশের পাসপোর্ট হোল্ডার, তা কিন্তু নন। তাঁদের অনেকেই ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে, অনেকেই পার্মানেন্ট রেসিডেন্স নিয়ে অথবা স্পেশাল এ্যাপ্রুভাল নিয়ে ওইসব দেশে বসবাস বা চাকরি করছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সিঙ্গাপুরে অতি সহজেই বাংলাদেশী মালিকানাধীন ব্যক্তিদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলা যায় এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খুলতে পারলেই সামান্য টাকায় একজন বিদেশী পার্টনারকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করলে সেখানে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সের বিপরীতে ওয়ার্ক ভিসাও পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের যে টাকা বাইরে রয়েছে, ৩৭ কোটি ২০ লাখ সুইস ফ্রাংকের চেয়েও অনেকগুণ বেশি। বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীরা বিভিন্ন দেশে তথা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দুবাই এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত হিসেবে রেখেছেন। এই টাকার একটি বড় অংশই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ব্যবসার শুরুতে বাংলাদেশ থেকে পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন।
বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল বাংলাদেশের রাজনীতি। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশীদের কালো টাকা উদ্ধারে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নেবে বলে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরই নতুন মোড় নিয়েছে ‘পদ্মা পাড়ের রাজনীতি।’ প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই ‘সন্দেহজনক’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিরোধী দল বিএনপি। যা দেখে আওয়ামী লীগের কটাক্ষ, ‘সুইস ব্যাংকের টাকা নিয়ে বিএনপির এত ভয় কেন? এ যেন, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের বেআইনী অর্থ উদ্ধার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। শুধু আন্তর্জাতিক তদন্তেই অর্থ পাচারকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব বলে দাবি করেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই সঙ্গে বিএনপির কোন নেতার বিদেশী ব্যাংকে বেআইনী টাকা নেই বলেও দাবি করেন তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আগ বাড়িয়ে করা এই মন্তব্যের মধ্যেই ‘অন্য গন্ধ’ পাচ্ছেন শেখ হাসিনার দল। রাজধানী ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে লীগ সমর্থক গোষ্ঠীর এক সভায় এ সম্পর্কে দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সুইস ব্যাংকে ১৫ হাজার কোটি বাংলাদেশী টাকা পাচার করা হয়েছে। এ কথা ইউএনডিপির তথ্যেও প্রকাশিত হয়েছে। তবে তারা তো বলেনি যে এই টাকা রাজনীতিবিদদের। এটা তো অসাধু ব্যবসায়ীদেরও হতে পারে। তাহলে বিএনপি এত আতঙ্কিত কেন?’ এর পরই তাঁর সংযোজন, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’
বাংলাদেশের টাকা পাচারকারীরা এখনও মনে করে সুইজারল্যান্ডের অন্যতম সরকারী ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে টাকা জমা রাখা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। তাদের এ ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে সম্প্রতি সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাবেও। সুইস ব্যাংকে অনেক দেশের আমানত যেখানে গত ২০১৩ সালে কমেছে, সেখানে বাংলাদেশীদের আমানত এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০১৩ সালে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটি ২০ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় তিন হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে কোন বাংলাদেশী তাঁর নাগরিকত্ব গোপন রেখে আমানত রেখেছেন তা এ প্রতিবেদনে আসেনি।
তবে এটা কেবল সুইস ব্যাংকের হিসাব। কিন্তু বেআইনী অর্থ ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে রাখার নিরিখে সুইস ব্যাংকগুলোর মৌরসীপাট্টায় এখন ভাগ বসাচ্ছে মোনাকো, কেমেন দীপপুঞ্জ, মরিসাস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন দীপপুঞ্জ, লুক্সেমবার্গ, লিচেনস্টাইন, আইল অব ম্যান, গ্রিস প্রভৃতি দেশের ব্যাংকগুলোও। এসব দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশীদের কত টাকা আছে তার হিসাবে কিন্তু প্রকাশিত হয়নি।
বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী এ দেশের কোন নাগরিকের বিদেশে টাকা নিতে হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে বিদেশে যাঁরা আয় করেন তাঁদের সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে বাংলাদেশের আইনে কোন সমস্যা নেই। তবে তিনি যদি আয়কর দিয়ে থাকেন এবং প্রবাসী কোটায় কোন সুবিধা নিয়ে থাকেন সেই ক্ষেত্রে এই তথ্য সরকারকে জানাতে হবে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা বিদেশের কোন ব্যাংকে টাকা জমা রাখার অনুমোদন দেয়া হয়নি। কোন প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে, তিনি সুইস ব্যাংকে বা অন্য কোন ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ থেকে যেমন টাকা পাচার বেড়েছে, তেমনি দেশে টাকা জমা রাখতে অনেকে নিরাপদ বোধ করছেন না। ফলে দেশের কালো টাকার একটি অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এর আগেও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে টাকা পাচারের বিষয়টি পরিষ্কার। কারণ এই রিপোর্ট সুইস ব্যাংক প্রকাশের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি।’
তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকে খাদ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এটি অস্বাভাবিক। কারণ, একদিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হবে, অন্যদিকে আমদানি বাড়বে এটা হতে পারে না। এছাড়া বিনিয়োগ একেবারে শূন্যের কোঠায়। এরপর মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়তে পারে না। এর অর্থ হলো ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে।’
অর্থ পাচারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রথম সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০০৬ সালে, যার পরিমাণ ২৭৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে তা সামান্য কমে হয় ২৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তা অবশ্য আরও কমে আসে যথাক্রমে ৮৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ও ৬৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। কিন্তু ২০১০ সালে এসে তা আবার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। ওই বছর অর্থ পাচার হয় ২৩৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ বছর অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানি। এই বিদ্যুত কেন্দ্রের যন্ত্রাদি আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং করে সে সময় অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণে উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। তাছাড়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও কর ফাঁকি দিতে নিজেদের মধ্যে পণ্য ও সেবার লেনদেনের মূল্য কম করে দেখিয়ে অর্থ পাচার করে।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, পাচার হয়ে যাওয়া এসব অর্থ জমা হয়েছে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এবং করের সুখস্বর্গ (ট্যাক্সেস হেভেন) বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অথচ আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে রফতানি, আমদানি, হুন্ডি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈধ ও অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং পাচারকৃত দেশে বেশি মুনাফার সুযোগ থাকার কারণে। সরকারী সম্পত্তি তছরুপ, চুরি, দুর্নীতি ও বাণিজ্যে মিথ্যা মূল্য দেখানোর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব অর্থ কখনই দেশে ফিরে আসে না বলে এতে বলা হয়েছে।
অর্থ পাচারের মূল উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বাণিজ্য ভারসাম্য) দুর্বলতা, রফতানিতে কম মূল্য দেখানো, আমদানিতে বেশি মূল্য দেখানো, অবৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স আসা। বাণিজ্যের পরিসংখ্যান সংগ্রহে দুর্বলতা, যা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের উপাত্তকে প্রভাবিত করে। ৫৮ শতাংশ পাচার আমদানি-রফতানিতে অবমূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে পাচারের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এটা বিনিয়োগের লাভ খেয়ে ফেলে। তাই বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হন না। দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০০৮ সালে এটা ১০ শতাংশের ওপরে চলে গিয়েছিল। বর্তমানেই এই হার ৭ শতাংশের ওপরে। সাধারণত, বিনিয়োগকারীরা ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীততে স্বস্তি বোধ করেন। উচ্চ বাজেট ঘাটতি ও উচ্চ করকেও দায়ী করা হয়েছে পাচারের জন্য।
বিনিয়োগে বেশি লাভ না হওয়াকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে ব্যক্তি বিনিয়োগ করলে অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম লাভ করতে পারে। এ জন্য বেশি লাভের আশায় অর্থ পাচার করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক এবং সুশাসনের পরিবেশকেও বড়ভাবে দায়ী করা হয়েছে পাচারের জন্য। প্রায় সময়েই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগ জটিলতা বাংলাদেশে বিদ্যমান থাকায় অর্থ পাচার হয়ে যায়। সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থ পাচার কয়েকগুণ বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থ পাচার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, পাচার রোধের ব্যবস্থা কেন কার্যকর হচ্ছে না সেটা প্রশ্ন। টাকা পাচার হবেই- সব দেশেই হয়, এটা আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো ফিগার নয়। তবে দেশে রাখতে পারলে অর্থনীতির অনেক উপকার হতো বলে মত দেন তিনি। অর্থ পাচারের মূল কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অতিমূল্যায়ন, অবমূল্যায়ন, বাণিজ্য ভারসাম্যে দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে দায়ী করেন এ গবেষক। তিনি বলেন, ‘অনেকেরই টাকা আছে। তবে দেশে টাকা রাখতে তারা ভরসা পান না। আবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকেই অবৈধ আয় করেন। এসব অর্থ রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়ে যায়। কালো টাকা হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এ জন্য চলে যায়।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘রফতানিতে মূল্য কম দেখিয়ে আর আমদানিতে বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এছাড়া রফতানি অর্থ যথাসময়ে দেশে ফেরত না এনে অনেক ক্ষেত্রে বাইরে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।’
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment