Saturday, August 2, 2014

অবক্ষয়

অবক্ষয়

Aajkaal: the leading bengali daily newspaper from Kolkata


স্বপন ঘোষ
বিশ্বায়ন কথাটা শুনলেই কেমন যেন ‘কমিউনিস্ট কমিউনিস্ট’ মনে হয়৷‌ অনেকে আবার বলেন, অজ্ঞজনের বি: কথা৷‌ ধারণাটা এমন যেন, এই বিশ্বায়ন কথাটা না বুঝেই বলেন বেশি সংখ্যক মানুষ৷‌ আবার এমনটাও ভাবেন, হয়ত শুনেই বলে ফেলে একটা সংখ্যক লোক৷‌ তারা কারা? সাধারণভাবে বলতে গেলে গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠক, কর্মী, নেতৃত্ব এমন সব মানুষ৷‌ আসলে বিষয়টা বলতে আমরা বুঝি, ফিনান্স– পুঁজির বিশ্বায়ন৷‌ বিশ্বের যে কোনও দেশে অবাধে বাণিজ্য করার স্বাধীনতা তোপ করতে চায় বহুজাতিক পুঁজি, তাই তাদের গলায় বিশ্বায়নের প্রচার৷‌ অভাবনীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নতি হওয়ার ফলে পৃথিবীটাকে এখন পরিচিত বলেই মনে হয়৷‌ দেশ, বিদেশ সবটাকেই এখন জানা যায় অতি সহজেই৷‌ ঘরে বসেই সব কিছু জানা ও পরিচিত হওয়ার যে সুযোগ সবার কাছে তৈরি হয়েছে৷‌ এটাকে বিশ্ব বহুজাতিক ব্যবসায়ী সংস্হাগুলো কাজে লাগাতে চাইছে৷‌ এক্ষেত্রে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট বা আম্তর্জাল ব্যবস্হাপনাকে হাতিয়ার করেছে৷‌ এতেই মনে হয় পৃথিবীটা খুব কাছের, খুব চেনাজানা৷‌

তাছাড়া দ্রুত নগরায়নের ফলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুততার সঙ্গে উন্নত সভ্যতার দিকে৷‌ এই উন্নত আধুনিক সভ্যতা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে এক স্বপ্নময় দুনিয়ার দিকে, যাকে আমি ইচ্ছে করলেই ছুঁতে পারি৷‌ এই আধুনিক সভ্যতার সব আবিষ্কার আমার হাতের নাগালে৷‌ ফলে আমাদের মতো শ্রেণীর মানুষের কাছে আধুনিক প্রাচুর্যপূর্ণ জীবনযাত্রা যেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে৷‌ এই জীবনযাত্রাকে ধরে রাখতে গেলেই যে আর্থিক সচ্ছলতা থাকা দরকার বা আয়ের উৎস থাকা দরকার, সেখানে রয়েছে ঘাটতি৷‌ এই ঘাটতি মেটাতে গিয়েই নানারকম সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে৷‌ প্রতিদিনকার স্বাভাবিক রোজনামচায় আচমকাই ঢুকে পড়ছে এমন অনেক উপাদান, যার প্রয়োজন না উপেক্ষা করা যাচ্ছে, না তাকে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনে প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে৷‌ এ কারণেই আমরা একটু বেশি রকমের স্বার্থপর হয়ে পড়ছি৷‌ ‘তুমি আর আমি আর আমাদের সম্তান এই আমাদের পৃথিবী’ এখানেই রুদ্ধ হয়ে পড়ছি অনেকটা নিজের অজাম্তেই৷‌

সংগ্রামী মানুষ বলেন, ‘জীবন আমার একটাই, স্বাধীনতা তোমাকে দিলাম’৷‌ আর বর্তমান যুগের কর্পোরেট সংস্হার স্লোগান– ‘জীবন তোমার একটাই, এ তুমি ভোগ করো, আনন্দ করো, উল্লাস করো’৷‌ আর এই উল্লাসের জন্য যাবতীয় উপাদানের ডালি সাজিয়ে সে তোমার ভাঙা কুটিরের দুয়ারে উপস্হিত৷‌ স্বপ্নে আচ্ছন্ন আমি আর আমরা হারিয়ে যাই তাদের সাজানো সুইমিং পুলে, যা একসময় গভীর সমুদ্র বলে মনে হবে৷‌ বাঁচতে আর মান রাখতে গিয়ে দায়বদ্ধতার কথা আর খেয়াল থাকে না, কর্তব্য থেকে সরে আসা৷‌ ‘তুমি আর আমি আর আমাদের সম্তান এই আমাদের পৃথিবী’ এখানেই রুদ্ধ হয়ে পড়ছি অনেকটা নিজের অজাম্তেই৷‌

আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের দায়িত্ববোধ, কর্তব্য বা করণীয় যা আমরা আমাদের মা-বাবা, কাকা-কাকিমা কিংবা যে কোনও নিকট আত্মীয়স্বজনকে প্রতিপালন করতে দেখেছি৷‌ এখন বাবা-মায়ের অবস্হান যেন সবচেয়ে কঠিন জায়গায়৷‌ রোজগেরে না হলে তাঁরাই তো দয়া আর করুণার পাত্র৷‌ পেনশনার যদি হন তবে তাঁর উপার্জনের টাকাটার ওপর নির্ভর করে তৈরি হয় সংসারের রূপরেখা৷‌ বৃদ্ধ মা, বাবা যদি পুত্রের ওপর নির্ভরশীল হন, সেই বাবা-মায়ের যদি ছিটেফোঁটা সম্পত্তি থাকে সেটা পাওয়ার জন্য মা-বাবার ওপর চাপ বাড়াতে থাকে৷‌ না পাওয়া পর্যম্ত চলে অত্যাচার৷‌ তাঁরা আজ পরিবারের বোঝা, সমাজের বোঝা! আমাদের দেশের সরকার এখন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে৷‌ সরকার মনে করছে অবাঞ্ছিত খরচ কমানো প্রয়োজন, প্রয়োজন দেশের স্বার্থেই৷‌ আমাদের দেশের সরকার এবং দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল যৌথভাবে সিদ্ধাম্ত নিয়ে দেশের কর্মচারীদের অবসরকালীন সামাজিক নিরাপত্তা শত বছরের প্রাচীন পেনশন ব্যবস্হাকে বেসরকারি হাত তুলে দিয়ে নিজেদের দায় থেকে মুক্ত হয়ে গেল৷‌ তারা মনে করে, এ খরচ অপ্রয়োজনীয়, সরকারের বাড়তি বোঝা৷‌ শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর দরকার পড়ে, সেসব সম্প্রসারিত সুযোগগুলোকে কমিয়ে আনা হচ্ছে৷‌ আমরা জানি, সরকার তো জনগণের অভিভাবক, জনসাধারণের সুখ-দুঃখ দেখার ভার তো সরকারের৷‌ এখন সেসবের বালাই নেই৷‌ আধুনিক বিশ্ব-ব্যবস্হায় মুনাফা লাভ-লোকসান এই হচ্ছে শেষ কথা৷‌ ফলে ভোটের প্রাক্কালে বা ভোটের পরে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বা কোনও কথা রাখার প্রয়োজন পড়ে না৷‌ এই সংস্কার সংক্রামিত হচ্ছে পরিবারে, সমাজে৷‌ যেখানে রোজগার নেই, সেখানে কোনও কর্তব্য পালনের দায় নেই৷‌

আজকাল সংবাদপত্রে এ রকম সংবাদ যেন পাকাপাকি করে স্হান করে নিচ্ছে৷‌ মা-কে রেলস্টেশনে বসতে বলে পাকাপাকিভাবে ফেলে আসা, ঘরের কোনও এক চিলেকোঠায় অপাঙ‍্ক্তেয় করে অবহেলায় ফেলে রাখা, বোনকে বাধ্য করা তার কাছে মা বা বাবাকে রাখতে– এসব ঘটনা আজ আর মনে দাগ কাটে না৷‌ আগরতলার সন্নিকটে সুভাষনগরের সম্প্রতি ঘটে-যাওয়া বৃদ্ধ দম্পতির মৃত্যুকে ঘিরে তেমনই অভিযোগ গ্রামবাসীদের৷‌ আরও অভিযোগ, ছেলে, ছেলের বউ এবং তাদের সম্তান মিলে খুন করেছে বৃদ্ধ মা-বাবাকে! দীর্ঘদিনের চলে আসা তাদের ব্যবহার এ অভিমত প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে গ্রামবাসীদের৷‌ খুন না অন্য কিছু সেটা হয়ত আদালতের বিচার্য বিষয়, কিন্তু মা-বাবার প্রতি তাদের আচরণ যে ভাল ছিল না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷‌

শুনছিলাম আমাদের গর্বের শহর আগরতলার এক বনেদি পরিবারের কথা৷‌ বাড়ি শহরেই৷‌ এখানে বাবা-মায়ের নামে রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়েই সমস্যা৷‌ একমাত্র ভাইয়ের ভয়, চার বোন মা-কে ফুসলিয়ে সম্পত্তির ভাগীদার হয় কি না৷‌ প্রতিপত্তি ও স্ব-উপায়ী আয়ের দিক দিয়ে বোনেরাও যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত বলা যেতে পারে৷‌ কিন্তু একটি মাত্র কারণে মায়ের সঙ্গে মেয়ের সাক্ষাৎ দীর্ঘদিন বন্ধ৷‌ অর্থাৎ বোনেদের বাবার বাড়ি সাবেক ভাইয়ের বাড়িতে প্রবেশাধিকার নেই৷‌ মা শয্যাশায়ী, এ খবরে উদ্বিগ্ন বোনেরা মায়ের সাক্ষাতের জন্য মহিলা কমিশনের পরামর্শ চাইতে গেলে মহিলা কমিশন শহরের একজন সুপরিচিত সমাজসেবীকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের সাক্ষাৎপ্রার্থী হওয়ার পরামর্শ দেন৷‌ অবশেষে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী লিপিকা পাল তাঁদের সঙ্গী হন এবং একবুক যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েরা বহুদিন পর মাকে দেখলেন৷‌ মেয়েরা মা-কে দেখলেন, মা দেখলেন মেয়েদের৷‌ আশ্চর্যের বিষয় হল, এই সেটাই ছিল মা-মেয়ের শেষ দেখা৷‌ কেননা, মা তাঁর পরদিন মারা গেছেন৷‌ এখানেই হয়ত জিতে গেছে অবক্ষয়৷‌

No comments:

Post a Comment