Saturday, August 16, 2014

সাগর থেকে অনেকেই ফিরছেন শূন্য হাতে, হারিয়ে যাচ্ছে ইলিশ! বৈশ্বিক উষ্ণতা ও মানুষের সৃষ্ট কারণের বিরূপ প্রভাব

সাগর থেকে অনেকেই ফিরছেন শূন্য হাতে, হারিয়ে যাচ্ছে ইলিশ!
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও মানুষের সৃষ্ট কারণের বিরূপ প্রভাব
শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে ॥ বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলেও পড়েছে এর প্রভাব। এরই মধ্যে ঋতুর ধরন পাল্টে গেছে। কমে গেছে বর্ষা। বেড়েছে উষ্ণতা। ঘন ঘন ঘটছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একই কারণে বঙ্গোপসাগরেও নানাভাবে পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। সাগরের মৎস্য সম্পদও বিরূপ প্রভাবের বাইরে থাকছে না। বিশেষ করে চলতি মৌসুমে সাগরে ইলিশ সঙ্কট জেলে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। মৌসুমের দেড় মাস কেটে গেলেও আগের মতো ইলিশের দেখা পাওয়া যায়নি। সাগর খা খা করছে অনেকটা ইলিশ শূন্যতায়। বজ্র নেই। বৃষ্টি নেই। নেই দখিনা বাতাসের দাপট। উপকূল ভাগের গভীরতা বিলীন হয়ে গেছে ডুবোচরের দাপটে। ইলিশ হারিয়ে ফেলছে গতিপথ। প্রজননক্ষেত্রে মিষ্টি পানির অভাব তীব্র আকার নিয়েছে। সাগর তলদেশে ইলিশের খাবার নিয়ে চলছে টানাটানি। পুষ্টির অভাবে ইলিশ ফিরে পাচ্ছে না আগের সেই রূপ এবং আকার। মানুষের সৃষ্ট কিছু অনিষ্টকর কারণেও ইলিশের অস্তিত্ব নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। পটুয়াখালীর সাগরপাড়ের কয়েকটি এলাকা সরেজমিন অনুসন্ধান আর জেলে এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এমনই আভাস পাওয়া গেছে।
সরকারীভাবে প্রতিবছর ১ জুন থেকে ইলিশের মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু এবার একমাস পিছিয়ে ১ জুলাই থেকে করা হয়েছে। সরকারী এ নিয়মের কোনই প্রভাব পড়েনি সাগরে। বরং এবার ইলিশের মৌসুম কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেছে। পাল্টে গেছে ইলিশ নিয়ে উপকূলের চিরায়ত দৃশ্যপট। পরিবর্তন ঘটেছে ইলিশের ধরন ধারনে। দিন দিন অধরা হয়ে উঠছে গভীর পানির ইলিশ। সাগরপাড়ের জেলেরা এমনটাই মনে করছেন। জুলাই-আগস্ট মাসের বেশ কয়েকদিন সাগরপাড়ে ঘুরে দেখা গেছে, এখনও ইলিশ তেমন ধরা পড়ছে না। দুই বছর আগেও মৌসুমের এ সময়টাতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়েছে। জেলেরা ইলিশ গুনেছে ‘আশিটি মাছে এক কাহন’ হিসাবে। কিন্তু এ বছর মৌসুমের দেড় মাস কেটে গেলেও ‘চারটি ইলিশে এক হালি’ হিসেবেও গুনতে পারেনি বহু জেলে। সাগর থেকে অনেকেই ফিরে আসছেন শূন্য হাতে। আবার একেবারেই ইলিশের ‘খরা’ চলছে, তেমনটাও বহু জেলে মনে করছেন না। মাঝে মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশও ধরা পড়ছে, তবে তা মাসের বিশেষ দু’চার দিনে। বিশেষ করে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার আগে পড়ে কয়েকদিন সাগরে ‘জো’ হয়। অর্থাৎ সাগর ফুলেফেপে ওঠে। জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যায়। ‘জো’ এর এ সময়টাতে কিছু মাছ ধরা পড়ছে। বাকি সময়ে ইলিশের তেমন দেখা মিলছে না। পটুয়াখালীর সাগরপাড়ের অন্যতম বৃহত্তম মৎস্যকেন্দ্র চরমোন্তাজে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে শ’য়ে শ’য়ে জেলে তাদের ট্রলার ও নৌকার বহর নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ জাল- নৌকা জোড়াতালি দিয়ে সময় পাড় করছেন আর কেবল বাড়িয়ে চলছেন দেনার বোঝা।
সাগরে ইলিশ সঙ্কটের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জেলেদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। অভিজ্ঞ জেলেদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়টির সঙ্গে খুঁজে পেয়েছেন বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাযুজ্য। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের রূপ পাল্টে গেছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে ইলিশের স্বাভাবিক আচরণে।
কয়েক জেলে জানিয়েছেন, অন্য বছর বর্ষায় সাগর যে রূদ্র রূপ ধারণ করে; এবার প্রথম থেকে সাগরের সে রূপ নেই। বরং সাগর যেন অনেকটা নিষ্প্রাণ। বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামের ৪০ বছরের অভিজ্ঞ ইলিশ শিকারি জেলে আবদুর রহমান বেপারি জানান, সাগরে ইলিশের গতিপথ তার নখদর্পণে। প্রতিবছর মৌসুমে তিনি বড় নৌকা নিয়ে পটুয়াখালীর চর মোন্তাজে অবস্থান করে ইলিশ ধরেন। কিন্তু এবার মৌসুমের শুরু থেকে তেমন ইলিশের দেখা পাননি। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঝড় তুফান বজ্রবৃষ্টিতে ইলিশ ঝাঁক বেঁধে উপকূলে আসে। একেকটি ঝাঁকে কয়েক লাখ পর্যন্ত ইলিশ থাকে। কিন্তু এবার আশ্চর্যজনকভাবে ঝড় বৃষ্টি তুফান অনেক কম। গত বছরেও সাগর যেভাবে ফুলেফেপে উঠেছিল এবার তার কিছুই নেই। যে কারণে ইলিশ উপকূলে আসছে না।’ প্রায় একই অভিমত দিলেন চর মোন্তাজের ইলিশ জেলে রুহুল আমিন গাজী। তিনিও প্রায় ৩০ বছর ধরে সাগরে ইলিশ ধরেন। রুহল গাজীর মতে, এবার সাগরে দখিনা বাতাসের প্রবাহ অনেক কম। দখিনা বাতাস না হলে সাগর উত্থাল হয় না। আর সাগর উত্তাল-পাতাল না হলে ইলিশ ধরা পড়ে না। তিনি আরও বলেন, ‘কেবলমাত্র অমাবস্যা-পূর্ণিমায় সাগর কিছুটা উত্তাল হলে তবেই কিছু মাছ মেলে। অন্যথায় মাছের আশায় বসে থাকতে হয়।’
বরিশালের গঙ্গাপুর গ্রামের ইলিশ জেলে হাইদুল কাজী (৬০) নিজ অভিজ্ঞতার নিরিখে জানান, গত কয়েক বছরে সাগরে অসংখ্য ডুবো চর জেগেছে। প্রতিবছর বাড়ছে ডুবো চরের সংখ্যা। ডুবো চরের কারণে ইলিশের গতিপথ পাল্টে গেছে, এটি স্বাভাবিক। আর এ কারণেই তিনি ধারণা করছেন ইলিশ তার গতিপথ পাল্টে পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমারের দিকে চলে যাচ্ছে।
পটুয়াখালীর আর পাঙ্গাশিয়া গ্রামের জেলে জয়নব আলী জানান, ইলিশ ডিম ছাড়ে মিষ্টি পানিতে। যখন ডিম ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসে, তখন ইলিশ ঝাঁক বেঁধে উপকূলের মিষ্টি পানিতে চলে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলে মিষ্টি পানির আঁধার হিসেবে যে সব নদ-নদী পরিচিত ছিল, সেগুলো এখন আর আগের অবস্থায় নেই। সব নদ-নদী লবণ পানির প্রকট বেড়েছে। পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের আকাল লেগেছে অনেক আগেই। এখন উপকূলেও মিষ্টি পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো লবণাক্ত পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে ইলিশ ডিম ছাড়তে আসে না।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment