Saturday, August 16, 2014

আজ ভয়াল ১৭ আগস্ট ॥ জেএমবিসহ নিষিদ্ধ জঙ্গীরা এখনও তৎপর

আজ ভয়াল ১৭ আগস্ট ॥ জেএমবিসহ নিষিদ্ধ জঙ্গীরা এখনও তৎপর
শংকর কুমার দে ॥ আজ ভয়াল সেই দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৭ আগস্ট কলঙ্কময় দিন। কালের পরিক্রমায় দীর্ঘ নয় বছর পর আবারও সেই রক্তমাখা দুঃস্বপ্নের সেই কলঙ্কিত দিনটি ফিরে আসলেও বোমা হামলাকারী নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর জঙ্গী হামলার কোন কোন মামলার তদন্ত শেষ হয়নি, আবার কোন কোন মামলার এজাহারভুক্ত জঙ্গীরা গ্রেফতার হয়নি, কোন কোন সিরিজ বোমা হামলার অদ্যাবদি বিচারকাজ শেষ হয়নি, এমনকি যাদের বিচারে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ২৯ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়নি। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে জেএমবিসহ, হুজি, হিযবুত তাহ্রীর, জেএমজিবি, শাহাদাত-ই-আল হিকমাসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা এতই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, গোটা দেশ জঙ্গীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে ওঠে। এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধরা পড়ছে জেএমবিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা। তবে সেই থেকে এখনও জেএমবিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা থেমে নেই।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার দিন দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ জেলা বাদে) একযোগে ৪শ’ স্থানে ৫ শতাধিক বোমা হামলা চালিয়ে ২ জনকে হত্যা ও ২ শতাধিক জনকে আহত করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। ২০০০ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ায় বোমা হামলার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম প্রকাশ করে জঙ্গী তৎপরতা শুরু করার পর বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারী ও বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ৩৩ জনকে হত্যা ও ৪ শতাধিকজনকে আহত করে। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ২ হাজার ১৮৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। যাচাই-বাছাই করে আসামি করা হয় ১ হাজার ৪৭৮ জনকে। সিরিজ বোমা হামলার দিন ১৫৯টি ও পরবর্তীতে তদন্তপূর্বক সব মিলিয়ে ৩১৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশীট দেয়ার পর বিচারকাজ শেষ হয়েছে ১৬০টি মামলার। এসব মামলার মধ্যে বিচারের রায়ে ফাঁসি হয়েছে ৩৫ জনের। এর মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ ৬ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। এখনও অপর ২৯ জনের ফাঁসির রায় এখনও কার্যকর হয়নি। ফাঁসির দণ্ডাদেশ ছাড়াও ১৩৫ জঙ্গীকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে ২৬৯ জনকে। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দিয়েছে ১৫টি মামলার। বিচারে রায়ে বেকসুর খালাস পেয়েছে ১৭০ জন। পলাতক আছে ১৭৫ আসামি। জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে ৩৫৭ জন। তবে র‌্যাব, সিআইডি ও পুলিশের পরিসংখ্যানের তথ্যে ভিন্নতা আছে।
গত ৯ বছরেও জেএমবির কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও তাদের নির্মূল করা সম্ভবপর হয়নি। আত্মগোপনে থেকে জেএমবি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। নামে-বেনামে, ছদ্মনামে জঙ্গীরা এখনও তৎপরতা চালাচ্ছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হত্যা করে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৩ মৃত্যুদ-সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকে গাজীপুর কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতে নেয়ার সময়ে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় ফিল্মি কায়দায় কমান্ডো স্টাইলে প্রিজনভ্যানে বোমা মেরে গুলি চালিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে সহযোগী জেএমবির জঙ্গীরা। জেএমবির জঙ্গীদের গুলিতে ময়মনসিংহ পুলিশের কনস্টেবল আতিকুল ইসলাম নিহত হয়েছেন। এসআই হাবিব, কনস্টেবল সোহেল এবং প্রিজনভ্যানের চালক সবুজ গুলিবিদ্ধ হন। ২৫ থেকে ৩০ জনের জেএমবির একটি সংঘবদ্ধ দল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজনভ্যানটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। গুলিবর্ষণকারী জেএমবির সদস্যরা হচ্ছে দণ্ড প্রাপ্ত কয়েদিদের সহযোগী। তারা তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেয়ার সময়ে তাদের গুলিতে এসআই হাবিব, কনস্টেবল আতিক ও সোহেল এবং প্রিজনভ্যানের চালক সবুজ গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁদের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে পুলিশ কনস্টেবল আতিক মারা যান। নিহত আতিক (৩৫) গাজীপুর পুলিশ লাইনের কনস্টেবল ছিলেন। এই পুলিশ কনস্টেবল হত্যার বিচারও হয়নি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রকাশ্যে দিবালোকে প্রিজনভ্যানে গুলি চালিয়ে ও বোমা মেরে জঙ্গী মামলার মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয়া জেএমবির ৩ জঙ্গী হচ্ছে রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল, সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তৌহিদ ও মিজান ওরফে বোমা মিজান ওরফে জাহিদুল হাসান সুমন।
ছিনতাই করে নেয়া কয়েদির মধ্যে সালাউদ্দিন ও রাকিব মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও মিজান যাবজ্জীবন দণ্ড প্রাপ্ত। ছিনিয়ে নেয়া তিন দণ্ড প্রাপ্ত কয়েদির মধ্যে একজন সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনের (৩৮) বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায়। সে জেএমবির শূরা সদস্য। তিনি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ছিল। ২০০৬ সালে তাকে জঙ্গী তৎপরতায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয়। ২০১০ সালে তাকে কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়। ১৩ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সে। এর মধ্যে তিনটিতে তার মৃত্যুদ-াদেশ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিচারাধীন আছে আরও ২৪টি মামলা।
মিজানের বাড়ি (৩৫) জামালপুর সদরের শেখেরভিটা এলাকায়। ২১টি মামলা বিচারাধীন আছে তার বিরুদ্ধে। পাঁচটি মামলায় সাজা হয়েছে তার। এর মধ্যে একটি মামলায় তার ৩০ বছরের কারাদ- হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কাশিমপুর কারাগারে আছে সে। জেএমবির প্রথমসারির নেতাদের ফাঁসির পর সংগঠনটি পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মিজান। জেএমবির দুর্র্ধর্ষ নেতা সে। বোমা কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে সংগঠনটিতে রসদ যোগানোর বিষয়ে তৎপর ছিল মিজান।
রাকিব হাসানের (৩৫) বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহের বংশীবেল এলাকায়। জেএমবির শূরা সদস্য সে। ২৯টি মামলা বিচারাধীন আছে তার বিরুদ্ধে। ৪টি মামলায় সাজা হয়েছে তার। এর মধ্যে একটিতে হয়েছে তার মৃত্যুদ-। এর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ফাঁসির আসামি জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শূরা সদস্য দুর্ধর্ষ জঙ্গী রাকিবুল হাসান রাকিব ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল। কিন্তু প্রিজনভ্যান থেকে পালানোর পর সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান এখনও ধরা পড়েনি।
সর্বশেষ গত ৩০ জুলাই রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে জেএমবির শীর্ষ নেতা শামিন মাহফুজ ওরফে সুমন ওরফে ম্যানরিং মুরং (ছদ্মনাম) (৩৮), জাহিদুর রহমান (৩৩) ও ইসমাইল হোসেনকে (৩৯) তৈরিকৃত বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বোমা তৈরির কলাকৌশল সমৃদ্ধ একটি ল্যাপটপসহ গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও সন্ত্রাস দমন আইনে দায়েরকৃত পৃথক দুই মামলায় ৩ দিন করে ৬ দিনের রিমান্ড এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। রিমান্ডে জেএমবি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদকারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, দেশের চারজন ব্যবসায়ী ও পাকিস্তানে অবস্থিত তিন জঙ্গী নেতা বাংলাদেশের জেএমবিকে নানাভাবে সহায়তা করছেন। এর মধ্যে অন্যতম পাকিস্তানে পলাতক থাকা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাবন্দী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই হুজি নেতা মুফতি মাওলানা তাজউদ্দিন। তিনি বাংলাদেশের জেএমবিকে নানাভাবে সহায়তা করছেন। পলাতক থেকেই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবিকে সক্রিয় করছেন তিনি। তার সঙ্গে রয়েছে পাকিস্তানে পলাতক থাকা জঙ্গী নেতা জামায়াতুল মুসলিমীনের আমির মুফতি ইজাজ আহমেদ এবং আফগানিস্তানে পলাতক মুফতি ইমরান। তাজউদ্দিন ও মুফতি ইজাজ পাকিস্তানে থেকে আলকায়েদার সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করিয়ে দিচ্ছেন। আর আফগানিস্তানে থেকে মুফতি ইমরান তালেবানদের বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গে জেএমবির হয়ে যোগাযোগ রাখছেন। এ তিন জনই বাংলাদেশের জেএমবির সঙ্গে আলকায়েদা ও তালেবান জঙ্গী গোষ্ঠীর সম্পর্ক করিয়ে দিচ্ছেন। বিদেশে থেকে তারাও বাংলাদেশে জেএমবির পরিচালনায় কলকাঠি নাড়ছেন।

No comments:

Post a Comment