আবারও শুরু হয়েছে গোপন দেশবিরোধী চক্রান্ত
মুহম্মদ শফিকুর রহমান
খ্যাতিমান কলামিস্ট গবেষক ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুনতাসীর মামুন তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ‘সব সম্ভবের দেশ এই বাংলাদেশ।’ মাত্র ৫টি শব্দে আমাদের চরিত্রের যথার্থ মূল্যায়নটি করেছেন। তাঁর মূল্যায়নটি নাগরিকদের জন্য লজ্জার হতে পারে, অমর্যাদারও হতে পারে; কিন্তু ভিত্তিহীন নয়।
পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যার নাগরিকদের একটি সচেতন অংশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে! করতে পারে! তাদের খারাপ লাগে না, লজ্জাও হয় না, অপরাধবোধও জন্ম নেয় না। এই শ্রেণীর নাগরিকদের নাম সুশীল সমাজ বা পরারষ ংড়পরবঃু. এঁরা পেশাজীবীÑ কেউ সাংবাদিক, কেউ শিক্ষক, কেউ মানবাধিকার কর্মী (যঁসধহ ৎরমযঃ ধপঃরারংঃ), কেউবা সাবেক কূটনীতিক। আবার কেউ আইনজীবী। সচেতন বলতে এই ভদ্রলোকদের বোঝানো যাবে এঁরা পদাধিকারবলে বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের সদস্য। এঁদের প্রেমের গ্রন্থি যে কোথায় তা দীর্ঘদিন অজানা থাকলেও এখন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কিংবা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কোথায় যে শেকড় তা কেবল তাঁরাই জানেন। তবে কখনও কখনও তাদের প্রেম রাষ্ট্রকে সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দেয়। যেমন এদের প্রেমে আমাদের জিএসপি সুবিধা আজ হাতছাড়া। তারপরও বাংলাদেশ থেমে নেই।
বিগত কয়েকদিনে বাংলাদেশে তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে ঃ
॥ এক ॥
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হার্ভে লেসুয়াস (ঐবৎাব খধফংঁধং) বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। তাঁর সফরের একটি উল্লেখ করার মতো ঘটনা হলো গত ২৪ জুলাই বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটি অংশের কয়েক সদস্য তাঁর সঙ্গে হোটেল শেরাটনে দেখা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান, একটি ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদক ও টিভি চ্যানেলের প্রিয় মুখ নূরুল কবির, একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক ও টিভি ব্যক্তিত্ব মতিউর রহমান চৌধুরী, ছিলেন বিএনপি নেতা সাবেক কূটনীতিক রিয়াজ রহমান এবং ইত্তেফাক পরিচয় দিয়ে জনৈকা ফাহিমা সিদ্দিক। এঁদের পেছনের লেজও অনেক লম্বা। বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে, তাতে বলা যায় তাঁদের আলোচনা প্রধানত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হয়েছিল। সুশীল সদস্যগণ বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে হার্ভে সাহেবকে ব্রিফ করতে গিয়ে এমন সব ইস্যু উপস্থাপন করেছেন যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতীর শামিল। এই যেমন র্যাব (জঅই : জধঢ়রফ ধপঃরড়হ নধঃধষরড়হ) বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো মানবতাবিরোধী কাজ করছে। যে সেনা সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত করেছে বা করছে, সেই সেনাবাহিনীর লোকই এই র্যাবে।
দুই.
হার্ভে সাহেবের বাংলাদেশ সফরের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং তাঁর স্থলে আসছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী কূটনীতিক মার্সিয়া বার্নিকাট। ড্যান মজেনাকে বলা হতো বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (আচরণগত) আর মার্সিয়া বার্নিকাটও বাংলাদেশে পা রাখার আগেই বিএনপির ঢোল পেটাতে শুরু করেছেন। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি, তথাকথিত সচেতন নাগরিকদের মতো সংলাপ সংলাপ উচ্চারণ করলেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারে (ফরঢ়ষড়সধঃরপ হড়ৎসং) তা শোভন কি-না বা পোস্টিংয়ের আগেই এ ধরনের একপেশে মন্তব্য করতে পারেন কিনা, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁকেই দিতে হবে। বস্তুত ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিকরা কূটনীতির চেয়ে রাজনীতিটাই বড় বেশি করেন বলে মনে হয়। এর আগেও মোটা শরীরের আরেক কৃষ্ণাঙ্গ কূটনীতিক বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে জঙ্গী জামায়াতকে ‘সড়ফবৎধঃব ফবসড়পৎধঃরপ ওংষধসরপ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃু’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। এদের কার মনে কী আছে আমরা জানি না, তবে যে কথাটি বিশেষ এবং ব্যাপকভাবে শ্রুত যে, এরাই জামায়াত-শিবির, হিযবুত তাহ্রীর, হিজবুল মুজাহিদীন বানায়, এরাই লাদেন, তালেবান, মুসলিম ব্রাদারহুড বানায়, এরাই একদিকে মোসাদ বানায় আরেকদিকে হামাস বানায় এবং তাদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোতে অশান্তির বিষবৃক্ষ রোপণ করে। এরা বাংলাদেশের মতো শান্তিপ্রিয় দেশে এসে রাজনীতি করে অথচ ফিলিস্তিনে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে সেখানে যায় না, গেলেও শান্তির বদলে অশান্তির কথা বলে। যে মুহূর্তে জায়নবাদী ইসরাইলের বোমা হামলা, ট্যাঙ্ক-বিমানের আক্রমণে হাজার শিশু ও নারী মৃত্যুবরণ করছে, বোমার স্পিøন্টারের আঘাতÑ নির্গত রক্তের ওপর ভাসছে ২ মাস-৫ মাসের শিশু, মাথায় শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা শিশুসন্তানকে নিয়ে মা দৌড়াচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, তখনও বার্নিকাটদের নিয়োগদাতা ওবামা প্রশাসন বলছে ইসরাইলেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে। হ্যাঁ, যে কোন মানুষেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে; কিন্তু এর মাধ্যমে নারী-শিশু হত্যার বা মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করার অধিকার জন্মায় না। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ ভোলেনি, কোনদিন ভুলবেও না।
তিন.
উল্লেখিত ঘটনা দুটি এমন একসময় ঘটল যখন হেজাবি (হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি) চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুললেন। এই দাবির পেছনে তারও যুক্তি হলো র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। র্যাবে যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশই সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সদস্য সেহেতু এই দাবির পেছনে রয়েছে তাদের উস্কানি প্রদান। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির মুহূর্ত থেকে শুরু করে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত খালেদা জিয়া সশস্ত্র জামায়াত-শিবির রাজপথে নামিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, বাস-ট্রেন, টেম্পো-অটোরিক্সায় আগুন দিয়ে নিরীহ বাসচালক বা কাভার্ডভ্যান চালকের কিশোর পুত্রকে (মনির) পুড়িয়ে অঙ্গার করে, পুলিশকে পিটিয়ে মারে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী ঘটনা ঘটিয়েও যখন সরকারের ভিত নাড়ানো গেল না তখন হেফাজতকে নামিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো, পবিত্র কোরান-হাদিস পোড়ানো হলো এবং এমনকি যুদ্ধাপরাধী রাজাকার সাঈদীকে চাঁদে তোলা হলো, পবিত্র কাবা শরীফে নেয়া হলো (খবরের কাগজের পাতায়), তারপরও খালি ডুলা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হলো। মাছ শিকার হলো না। ঘরে বসে হুমকি-ধমকি দিতে থাকলেন, তাঁর মিথ্যার লাউড স্পীকার মির্জা ফখরুল বা রিজভী-গয়েশ্বররা নির্জলা মিথ্যা দিয়ে তা প্রচার করতে থাকলেন আর মিডিয়াগুলো নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠান না চালাতে পারলেও (বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া) কোথায় কে কত বেশি মিথ্যে বলতে পারছে তাদের পেছনে বুম (ডা-া) নিয়ে দৌড়াতে বেশি ভালবাসে।
৮ মাস পর খালেদা জিয়া এখন আবার আন্দোলন করবেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করছেন। ক’দিন আগে পবিত্র ওমরা হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গিয়ে মহা-দুর্নীতি ও মহা-মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত লন্ডনে পলাতক (ভঁমরঃরাব) পুত্র তারেক রহমানকে ডেকে এনে বৈঠক করেন। শোনা যায়, আন্দোলনের কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর কর্মপন্থা মানে তো সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা। শোনা যাচ্ছে ঐ বৈঠকে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার সাঈদীর পুত্রও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ঘোষণা দিয়েছেন ঈদ-উল-ফিতরের পর সরকার পতনের কঠোর আন্দোলন করবেন। অবশ্য তার মিথ্যার লাউড স্পীকার মির্জা ফখরুল আরেক পা বাড়িয়ে বললেন, এমন কঠিন-কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে যার তোড়ে সরকার খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে। আন্দোলন করবেন ভাল কথা, আন্দোলন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটা পদ্ধতি। তবে খালেদা জিয়ার প্রতি আমার একটা পরামর্শ আছেÑ নিজের বুদ্ধিতে আন্দোলন করুন, ভাল হবে, পলাতক পুত্র কিংবা জামায়াত কিংবা গয়েশ্বর বাবুদের পরামর্শ শুনলে ডুববেন। এমনিতেই অনেক ডুবে আছেন, এবার তলানিতে পড়বেন।
আসল উদ্দেশ্য
এবার টঘ আন্ডার সেক্রেটারি হার্ভে লেসুয়াস এবং আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকদের (?) মধ্যকার বৈঠকের ওপর থোড়া আলোকপাত করতে চাই। বস্তুত তাদের এই বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য দেশাত্মঘাতী। তারা র্যাবকে বিতর্কিত করে মূলত সশস্ত্রবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে চায়। তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে (টঘচকগ-টহরঃবফ ঘধঃরড়হং চবধপবশববঢ়রহম গরংংরড়হ) আমাদের সেনা সদস্যদের আর নেয়া হবে না। এভাবে সেনাবাহিনীকে বর্তমান সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে। খালেদা জিয়ার আন্দোলন যত অকার্যকরই (টহধভভবপঃবফ) হোক না কেন কিছু আসে যায় না, একটা কোন জিগির তোলা গেলে সেনাবাহিনীর ক্ষোভটাকে কাজে লাগানো যাবে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্তির দাবি উত্থাপন করেছেন (যদিও তিনিই র্যাব গঠন করেছিলেন ক্ষমতায় থাকতে)। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে সচেতন (?) নাগরিকদের কেউ কেউ র্যাব সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে একবার যদি বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় তখন বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্য সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন। এই ক্ষোভেরই সুযোগ তারা নিতে চান। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক সুশীল বাবুরা।
এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা কেবল দুঃখজনকই নয়, আত্মঘাতীও বটে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালনে যেমন সম্মান আছে তেমনি প্রাপ্তি যোগও কম নয়। এতে একজন সৈনিক বছরে ১০ লাখ টাকা, একজন অফিসার বছরে ৪০ লাখ টাকা এবং একজন পর্যবেক্ষক (ঙনংবৎাবৎ) বছরে ৫০ লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারেন। কেননা, সৈনিকগণ এখানে বেতন যাই পান না কেন যে মুহূর্তে জাতিসংঘের চাকরিতে যোগদান করেন ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি আন্তর্জাতিক বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাড়ে ৮ হাজার সদস্য শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত আছেন। তাঁদের বাৎসরিক আয় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ৪০টি শান্তিরক্ষী মিশনে এক লাখ সাত হাজার ৪৮৭ বাংলাদেশের সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁদের মোট আয় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ঝুঁকিও কম নয়। সাধারণত রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দেশগুলোতেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং দায়িত্ব পালনকালে এ পর্যন্ত ৯১ সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৩৯ জন। পুলিশের সদস্যরাও সুনামের সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছেন, এ মুহূর্তে ২ হাজার ৫৩ জন কর্মরত আছেন, এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন (পুলিশ) মোট ৭ হাজার ৫২২ জন।
আমাদের শান্তিরক্ষীরা শত ঝুঁকির মধ্যেও সুনামের সঙ্গে অবদান রাখছেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক সঙ্কটাপন্ন আফ্রিকার দেশে দেশে তাঁদের সুনাম অর্জন ক্রিকেটের মতোই আমাদের জন্য কার্যকর কূটনৈতিক সাফল্য এনে দিচ্ছেন। লাইবেরিয়ার একটি গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ‘বাংলাদেশ’ বলে শুনেছি।
আমাদের সেনাসদস্যদের আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার মানুষ এখন বাংলা শিখছে, বাংলায় কথা বলছে। আইভরিকোস্টের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর গোলযোগপূর্ণ আবিদজান, ডালোয়া, মান এবং বহুল আলোচিত গালফ হোটেলে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট আলাসান ওয়াতার নিরাপত্তার নিশ্চয়তার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছেন। এমনকি আবিদজানে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অর্ধশত কূটনীতিককে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি বা দুর্যোগ মোকাবেলায় সাফল্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে টঘচকগ-এ আমাদের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা যা বাংলাদেশকে ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। কেবল শান্তিরক্ষী নয়, এ মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৯০ লাখ কর্মী কাজ করছে, রয়েছে তৈরি পোশাক খাতে উত্তরোত্তর অগ্রগতি। এই সবই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, একশ্রেণীর তথাকথিত সুশীল সমাজের সদস্যের দেশবিরোধী ভূমিকা কখনও কখনও জাতিকে শঙ্কিত করে তোলে। যেমন দেশে-বিদেশে নেতিবাচক প্রচারণা এবং ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা জিএসপি সুবিধা হারিয়েছি। আমরা তবুও জিএসপির সুযোগ ছাড়া এগিয়ে যাচ্ছি এটা সত্যি। কিন্তু জিএসপি সুবিধা থাকলে অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। ঠিক তেমনিভাবে টঘচকগ-এ আমাদের নিয়োগ (খোদা না-খাস্তা) বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতিটা হবে জাতীয়ভাবেÑ কোন ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর নয়।
সবশেষে একটি কথা বলতে চাই, জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল হার্ভে সাহেব এমন একটি সময়ে বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এলেন যখন ফিলিস্তিনের শান্তি রক্তাক্ত মেঝে-পথে-বাড়ির ভগ্নস্তূপে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাজারো নারী-শিশু জায়নবাদী সন্ত্রাসী ইসরাইলের ট্যাঙ্ক-কামান-বিমান-বোমা হামলায় নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে হাজার হাজার, এ পর্যন্ত অনুমান নিরাপদ আশ্রয় অর্থাৎ জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরবাড়ি ছেড়েছেন দেড় লক্ষাধিক। হার্ভে সাহেব কিংবা নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কৃষ্ণাঙ্গ মার্সিয়া বার্নিকাট কি দেখেন না এসব? প্রতিদিন কত শিশু কিভাবে মৃত্যুবরণ করছে? তাঁরা কি খবরের কাগজ, টেলিভিশন দেখেন না? দেখেন; কিন্তু তাঁদের কাছে গুরুত্ব হচ্ছে আমাদের মতো শান্তিপূর্ণ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে নিজেদের পৌরোহিত্য বজায় রাখা।
কিন্তু অনেক তো হলো। বাংলাদেশকে কেউ পেছনে ঠেলতে পারেনি সত্য; কিন্তু কখনও কখনও দেশের অগ্রগতির পথে বাধার সৃষ্টি তো করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, মার্শাল ল’ দিয়ে দেশকে পেছনে না ঠেললে আরও এগিয়ে যেত। কাজেই সরকার, রাজনৈতিক শক্তিসহ সকল নাগরিককে যে কোন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে সরকার এবং আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভুললে চলবে না যে, ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেননা তিনিই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।
ঢাকা ৩০ জুলাই ২০১৪
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যার নাগরিকদের একটি সচেতন অংশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে! করতে পারে! তাদের খারাপ লাগে না, লজ্জাও হয় না, অপরাধবোধও জন্ম নেয় না। এই শ্রেণীর নাগরিকদের নাম সুশীল সমাজ বা পরারষ ংড়পরবঃু. এঁরা পেশাজীবীÑ কেউ সাংবাদিক, কেউ শিক্ষক, কেউ মানবাধিকার কর্মী (যঁসধহ ৎরমযঃ ধপঃরারংঃ), কেউবা সাবেক কূটনীতিক। আবার কেউ আইনজীবী। সচেতন বলতে এই ভদ্রলোকদের বোঝানো যাবে এঁরা পদাধিকারবলে বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের সদস্য। এঁদের প্রেমের গ্রন্থি যে কোথায় তা দীর্ঘদিন অজানা থাকলেও এখন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কিংবা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কোথায় যে শেকড় তা কেবল তাঁরাই জানেন। তবে কখনও কখনও তাদের প্রেম রাষ্ট্রকে সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দেয়। যেমন এদের প্রেমে আমাদের জিএসপি সুবিধা আজ হাতছাড়া। তারপরও বাংলাদেশ থেমে নেই।
বিগত কয়েকদিনে বাংলাদেশে তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে ঃ
॥ এক ॥
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হার্ভে লেসুয়াস (ঐবৎাব খধফংঁধং) বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। তাঁর সফরের একটি উল্লেখ করার মতো ঘটনা হলো গত ২৪ জুলাই বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটি অংশের কয়েক সদস্য তাঁর সঙ্গে হোটেল শেরাটনে দেখা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান, একটি ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদক ও টিভি চ্যানেলের প্রিয় মুখ নূরুল কবির, একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক ও টিভি ব্যক্তিত্ব মতিউর রহমান চৌধুরী, ছিলেন বিএনপি নেতা সাবেক কূটনীতিক রিয়াজ রহমান এবং ইত্তেফাক পরিচয় দিয়ে জনৈকা ফাহিমা সিদ্দিক। এঁদের পেছনের লেজও অনেক লম্বা। বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে, তাতে বলা যায় তাঁদের আলোচনা প্রধানত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হয়েছিল। সুশীল সদস্যগণ বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে হার্ভে সাহেবকে ব্রিফ করতে গিয়ে এমন সব ইস্যু উপস্থাপন করেছেন যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতীর শামিল। এই যেমন র্যাব (জঅই : জধঢ়রফ ধপঃরড়হ নধঃধষরড়হ) বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো মানবতাবিরোধী কাজ করছে। যে সেনা সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত করেছে বা করছে, সেই সেনাবাহিনীর লোকই এই র্যাবে।
দুই.
হার্ভে সাহেবের বাংলাদেশ সফরের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং তাঁর স্থলে আসছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী কূটনীতিক মার্সিয়া বার্নিকাট। ড্যান মজেনাকে বলা হতো বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (আচরণগত) আর মার্সিয়া বার্নিকাটও বাংলাদেশে পা রাখার আগেই বিএনপির ঢোল পেটাতে শুরু করেছেন। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি, তথাকথিত সচেতন নাগরিকদের মতো সংলাপ সংলাপ উচ্চারণ করলেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারে (ফরঢ়ষড়সধঃরপ হড়ৎসং) তা শোভন কি-না বা পোস্টিংয়ের আগেই এ ধরনের একপেশে মন্তব্য করতে পারেন কিনা, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁকেই দিতে হবে। বস্তুত ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিকরা কূটনীতির চেয়ে রাজনীতিটাই বড় বেশি করেন বলে মনে হয়। এর আগেও মোটা শরীরের আরেক কৃষ্ণাঙ্গ কূটনীতিক বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে জঙ্গী জামায়াতকে ‘সড়ফবৎধঃব ফবসড়পৎধঃরপ ওংষধসরপ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃু’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। এদের কার মনে কী আছে আমরা জানি না, তবে যে কথাটি বিশেষ এবং ব্যাপকভাবে শ্রুত যে, এরাই জামায়াত-শিবির, হিযবুত তাহ্রীর, হিজবুল মুজাহিদীন বানায়, এরাই লাদেন, তালেবান, মুসলিম ব্রাদারহুড বানায়, এরাই একদিকে মোসাদ বানায় আরেকদিকে হামাস বানায় এবং তাদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোতে অশান্তির বিষবৃক্ষ রোপণ করে। এরা বাংলাদেশের মতো শান্তিপ্রিয় দেশে এসে রাজনীতি করে অথচ ফিলিস্তিনে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে সেখানে যায় না, গেলেও শান্তির বদলে অশান্তির কথা বলে। যে মুহূর্তে জায়নবাদী ইসরাইলের বোমা হামলা, ট্যাঙ্ক-বিমানের আক্রমণে হাজার শিশু ও নারী মৃত্যুবরণ করছে, বোমার স্পিøন্টারের আঘাতÑ নির্গত রক্তের ওপর ভাসছে ২ মাস-৫ মাসের শিশু, মাথায় শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা শিশুসন্তানকে নিয়ে মা দৌড়াচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, তখনও বার্নিকাটদের নিয়োগদাতা ওবামা প্রশাসন বলছে ইসরাইলেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে। হ্যাঁ, যে কোন মানুষেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে; কিন্তু এর মাধ্যমে নারী-শিশু হত্যার বা মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করার অধিকার জন্মায় না। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ ভোলেনি, কোনদিন ভুলবেও না।
তিন.
উল্লেখিত ঘটনা দুটি এমন একসময় ঘটল যখন হেজাবি (হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি) চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুললেন। এই দাবির পেছনে তারও যুক্তি হলো র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। র্যাবে যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশই সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সদস্য সেহেতু এই দাবির পেছনে রয়েছে তাদের উস্কানি প্রদান। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির মুহূর্ত থেকে শুরু করে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত খালেদা জিয়া সশস্ত্র জামায়াত-শিবির রাজপথে নামিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, বাস-ট্রেন, টেম্পো-অটোরিক্সায় আগুন দিয়ে নিরীহ বাসচালক বা কাভার্ডভ্যান চালকের কিশোর পুত্রকে (মনির) পুড়িয়ে অঙ্গার করে, পুলিশকে পিটিয়ে মারে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী ঘটনা ঘটিয়েও যখন সরকারের ভিত নাড়ানো গেল না তখন হেফাজতকে নামিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো, পবিত্র কোরান-হাদিস পোড়ানো হলো এবং এমনকি যুদ্ধাপরাধী রাজাকার সাঈদীকে চাঁদে তোলা হলো, পবিত্র কাবা শরীফে নেয়া হলো (খবরের কাগজের পাতায়), তারপরও খালি ডুলা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হলো। মাছ শিকার হলো না। ঘরে বসে হুমকি-ধমকি দিতে থাকলেন, তাঁর মিথ্যার লাউড স্পীকার মির্জা ফখরুল বা রিজভী-গয়েশ্বররা নির্জলা মিথ্যা দিয়ে তা প্রচার করতে থাকলেন আর মিডিয়াগুলো নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠান না চালাতে পারলেও (বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া) কোথায় কে কত বেশি মিথ্যে বলতে পারছে তাদের পেছনে বুম (ডা-া) নিয়ে দৌড়াতে বেশি ভালবাসে।
৮ মাস পর খালেদা জিয়া এখন আবার আন্দোলন করবেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করছেন। ক’দিন আগে পবিত্র ওমরা হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গিয়ে মহা-দুর্নীতি ও মহা-মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত লন্ডনে পলাতক (ভঁমরঃরাব) পুত্র তারেক রহমানকে ডেকে এনে বৈঠক করেন। শোনা যায়, আন্দোলনের কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর কর্মপন্থা মানে তো সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা। শোনা যাচ্ছে ঐ বৈঠকে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার সাঈদীর পুত্রও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ঘোষণা দিয়েছেন ঈদ-উল-ফিতরের পর সরকার পতনের কঠোর আন্দোলন করবেন। অবশ্য তার মিথ্যার লাউড স্পীকার মির্জা ফখরুল আরেক পা বাড়িয়ে বললেন, এমন কঠিন-কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে যার তোড়ে সরকার খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে। আন্দোলন করবেন ভাল কথা, আন্দোলন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটা পদ্ধতি। তবে খালেদা জিয়ার প্রতি আমার একটা পরামর্শ আছেÑ নিজের বুদ্ধিতে আন্দোলন করুন, ভাল হবে, পলাতক পুত্র কিংবা জামায়াত কিংবা গয়েশ্বর বাবুদের পরামর্শ শুনলে ডুববেন। এমনিতেই অনেক ডুবে আছেন, এবার তলানিতে পড়বেন।
আসল উদ্দেশ্য
এবার টঘ আন্ডার সেক্রেটারি হার্ভে লেসুয়াস এবং আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকদের (?) মধ্যকার বৈঠকের ওপর থোড়া আলোকপাত করতে চাই। বস্তুত তাদের এই বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য দেশাত্মঘাতী। তারা র্যাবকে বিতর্কিত করে মূলত সশস্ত্রবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে চায়। তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে (টঘচকগ-টহরঃবফ ঘধঃরড়হং চবধপবশববঢ়রহম গরংংরড়হ) আমাদের সেনা সদস্যদের আর নেয়া হবে না। এভাবে সেনাবাহিনীকে বর্তমান সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে। খালেদা জিয়ার আন্দোলন যত অকার্যকরই (টহধভভবপঃবফ) হোক না কেন কিছু আসে যায় না, একটা কোন জিগির তোলা গেলে সেনাবাহিনীর ক্ষোভটাকে কাজে লাগানো যাবে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্তির দাবি উত্থাপন করেছেন (যদিও তিনিই র্যাব গঠন করেছিলেন ক্ষমতায় থাকতে)। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে সচেতন (?) নাগরিকদের কেউ কেউ র্যাব সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে একবার যদি বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় তখন বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্য সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন। এই ক্ষোভেরই সুযোগ তারা নিতে চান। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক সুশীল বাবুরা।
এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা কেবল দুঃখজনকই নয়, আত্মঘাতীও বটে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালনে যেমন সম্মান আছে তেমনি প্রাপ্তি যোগও কম নয়। এতে একজন সৈনিক বছরে ১০ লাখ টাকা, একজন অফিসার বছরে ৪০ লাখ টাকা এবং একজন পর্যবেক্ষক (ঙনংবৎাবৎ) বছরে ৫০ লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারেন। কেননা, সৈনিকগণ এখানে বেতন যাই পান না কেন যে মুহূর্তে জাতিসংঘের চাকরিতে যোগদান করেন ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি আন্তর্জাতিক বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাড়ে ৮ হাজার সদস্য শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত আছেন। তাঁদের বাৎসরিক আয় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ৪০টি শান্তিরক্ষী মিশনে এক লাখ সাত হাজার ৪৮৭ বাংলাদেশের সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁদের মোট আয় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ঝুঁকিও কম নয়। সাধারণত রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দেশগুলোতেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং দায়িত্ব পালনকালে এ পর্যন্ত ৯১ সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৩৯ জন। পুলিশের সদস্যরাও সুনামের সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছেন, এ মুহূর্তে ২ হাজার ৫৩ জন কর্মরত আছেন, এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন (পুলিশ) মোট ৭ হাজার ৫২২ জন।
আমাদের শান্তিরক্ষীরা শত ঝুঁকির মধ্যেও সুনামের সঙ্গে অবদান রাখছেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক সঙ্কটাপন্ন আফ্রিকার দেশে দেশে তাঁদের সুনাম অর্জন ক্রিকেটের মতোই আমাদের জন্য কার্যকর কূটনৈতিক সাফল্য এনে দিচ্ছেন। লাইবেরিয়ার একটি গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ‘বাংলাদেশ’ বলে শুনেছি।
আমাদের সেনাসদস্যদের আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার মানুষ এখন বাংলা শিখছে, বাংলায় কথা বলছে। আইভরিকোস্টের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর গোলযোগপূর্ণ আবিদজান, ডালোয়া, মান এবং বহুল আলোচিত গালফ হোটেলে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট আলাসান ওয়াতার নিরাপত্তার নিশ্চয়তার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছেন। এমনকি আবিদজানে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অর্ধশত কূটনীতিককে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি বা দুর্যোগ মোকাবেলায় সাফল্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে টঘচকগ-এ আমাদের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা যা বাংলাদেশকে ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। কেবল শান্তিরক্ষী নয়, এ মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৯০ লাখ কর্মী কাজ করছে, রয়েছে তৈরি পোশাক খাতে উত্তরোত্তর অগ্রগতি। এই সবই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, একশ্রেণীর তথাকথিত সুশীল সমাজের সদস্যের দেশবিরোধী ভূমিকা কখনও কখনও জাতিকে শঙ্কিত করে তোলে। যেমন দেশে-বিদেশে নেতিবাচক প্রচারণা এবং ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা জিএসপি সুবিধা হারিয়েছি। আমরা তবুও জিএসপির সুযোগ ছাড়া এগিয়ে যাচ্ছি এটা সত্যি। কিন্তু জিএসপি সুবিধা থাকলে অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। ঠিক তেমনিভাবে টঘচকগ-এ আমাদের নিয়োগ (খোদা না-খাস্তা) বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতিটা হবে জাতীয়ভাবেÑ কোন ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর নয়।
সবশেষে একটি কথা বলতে চাই, জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল হার্ভে সাহেব এমন একটি সময়ে বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এলেন যখন ফিলিস্তিনের শান্তি রক্তাক্ত মেঝে-পথে-বাড়ির ভগ্নস্তূপে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাজারো নারী-শিশু জায়নবাদী সন্ত্রাসী ইসরাইলের ট্যাঙ্ক-কামান-বিমান-বোমা হামলায় নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে হাজার হাজার, এ পর্যন্ত অনুমান নিরাপদ আশ্রয় অর্থাৎ জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরবাড়ি ছেড়েছেন দেড় লক্ষাধিক। হার্ভে সাহেব কিংবা নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কৃষ্ণাঙ্গ মার্সিয়া বার্নিকাট কি দেখেন না এসব? প্রতিদিন কত শিশু কিভাবে মৃত্যুবরণ করছে? তাঁরা কি খবরের কাগজ, টেলিভিশন দেখেন না? দেখেন; কিন্তু তাঁদের কাছে গুরুত্ব হচ্ছে আমাদের মতো শান্তিপূর্ণ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে নিজেদের পৌরোহিত্য বজায় রাখা।
কিন্তু অনেক তো হলো। বাংলাদেশকে কেউ পেছনে ঠেলতে পারেনি সত্য; কিন্তু কখনও কখনও দেশের অগ্রগতির পথে বাধার সৃষ্টি তো করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, মার্শাল ল’ দিয়ে দেশকে পেছনে না ঠেললে আরও এগিয়ে যেত। কাজেই সরকার, রাজনৈতিক শক্তিসহ সকল নাগরিককে যে কোন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে সরকার এবং আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভুললে চলবে না যে, ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেননা তিনিই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।
ঢাকা ৩০ জুলাই ২০১৪
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/
No comments:
Post a Comment