সিঙ্গাপুরেও অধরা সোনার হরিণ
আকতার ফারুক শাহিন, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে
প্রকাশ : ০২ আগস্ট, ২০১৪পরিচয় বাঙালি এলাকা হিসেবে। বহু বাংলাদেশীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। প্রতি রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সেরাঙ্গুন আর ডেসকার রোডসহ এর আশপাশে ভিড় জমায় হাজার হাজার বাঙালি। সুখ-দুঃখের আলাপন আর হাসি-
সেরাঙ্গুন রোড। সিঙ্গাপুরের পরিচিত একটি এলাকা। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে ‘সেরাঙ্গুন রোডের’ ঠাট্টায় পুরো এলাকাটি তখন যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। ৬ জুলাই রোববার ভোর সাড়ে ৫টা। সেরাঙ্গুনের পাশেই ডেসকার রোডের বাঙালি হোটেল খানা বাসমতির বারান্দায় বসে আছেন ৩ তরুণ। বেশভূষা আর কথাবার্তায় বোঝা গেল বাংলাদেশী। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা গেল দু’জনার বাড়ি ভোলা এবং একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা। কাজের সন্ধানে এসেছেন স্বপ্নের সিঙ্গাপুর। বসে থাকা এই ৩ জনের পাশ দিয়ে তখন হেঁটে যাচ্ছে অনেক বাঙালি। সাধারণত দেশ থেকে সদ্য বিদেশে আসা কোনো বাংলাদেশীর দেখা পেলে প্রবাসীদের মধ্যে নানা কৌতূহল সৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এদের প্রতি কোনো বাঙালিরই তেমন আগ্রহ নেই। সিঙ্গাপুরে কর্মরত বরিশালের বাবুগঞ্জের বাসিন্দা দীলিপ দত্ত বলেন, ‘এটা তো ডেসকার রোডের নিয়মিত দৃশ্য। প্রতিদিন কম করে হলেও দু’আড়াইশ’ বাংলাদেশী আসছে সিঙ্গাপুর। মাথাপিছু ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করে সোনার হরিণ ধরতে আসে এরা। এরপর কঠিন বাস্ততায় গুমরে গুমরে কাঁদে।
বারান্দায় বসে থাকা ভোলার ছেলে রশিদুল তখন খুঁজছে একটি মোবাইল ফোনের দোকান। বাড়িতে ফোন করে মাকে জানাবে তার পৌঁছার কথা। নিজের সেলফোনটা এগিয়ে দিই। সে কথা বলে বাবা-মায়ের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলে জানায়, বিদেশে আসতে তার প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দেশে প্রথমে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে। সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে গিয়ে পরীক্ষা নেয়া সিঙ্গাপুরিয়ান পরীক্ষকের কাছে পাস করার পর মিলেছে সিঙ্গাপুরের চাকরি। অনেকটা দিনমজুরির চুক্তিতে। দৈনিক বেতন ১৬ সিঙ্গাপুরি ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ মাত্র ১ হাজার ১০৪ টাকা। রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ নেই। বেতনও নেই। কথা বলতে বলতেই সেখানে পৌঁছল ৩ বাংলাদেশীকে নিতে আসা তাদের চাকরি প্রদানকারী কোম্পানির গাড়ি। আরও অনেক বাংলাদেশী তাতে বসা। সবাইকে নিয়ে গাড়িটি চলে গেল তাদের গন্তব্যে।
সিঙ্গাপুরে একটি ওয়ার্কার্স হাউসের ডরমেটরির দায়িত্বে থাকা বরিশালের বাসিন্দা হামিদুর রহমান শিপন জানান, ‘হোটেল কিংবা মেস, যেভাবেই হোক না কেন মাসে এখানে একজনের খাওয়ায় খরচ হয় কমপক্ষে পৌনে ২শ’ ডলার। এক খাটে দু’জন কিংবা ছোট্ট একটি রুমে ৪ জন থাকাসহ অন্যান্য মিলিয়ে এই খরচ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২২৫ ডলারে। অন্যসব বাদ দিয়ে কেবল বেঁচে থাকার জন্য হলেও এই পরিমাণ ডলার খরচ করতে হয় একজনকে। দৈনিক ১৬ ডলার বেতন হিসেবে এই টাকা খরচ হওয়ার পর একজনের বাঁচে মাত্র মাসে ১৯১ ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমান দাড়ায় ১৩ হাজার টাকার কিছু বেশি। একজন লোক যদি ৬ লাখ টাকা খরচ করে এখানে আসে তবে এই হিসাবে এক বছরে সে দেশে পাঠাতে পারে মাত্র ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, প্রথমবার ১ বছরের জন্য ওয়ার্ক পারমিট দেয় অধিকংশ সিঙ্গাপুরি কোম্পানি। মেয়াদ শেষ হলে তা নবায়ন করতে হয়। এই নবায়নের সময় আবার ২ হাজার ডলার পর্যন্ত নবায়ন ফি নেয় কোম্পানিগুলো। অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ টাকার ধাক্কা। জায়গাজমি বিক্রি আর ধারদেনা করে সিঙ্গাপুরে এসে এভাবে আরেক দফা সর্বশান্ত হয় বাংলাদেশীরা। দেশ থেকে লোক নেয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানির মালিকদের রাজি করায় সেখানে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা। মালিক রাজি হলে শুরু হয় দালালের মাধ্যমে লোক আনার প্রক্রিয়া। দু’তিন ধাপে এই দালালরাই নিয়ে নেয় ৪/৫ লাখ টাকা। এর বাইরে বিমান ভাড়াসহ খরচ পড়ে আরও প্রায় ১ লাখ টাকা। মূলত এভাবে শুরুতে মোটা অংকের টাকা দিয়েই পিছিয়ে পরে বাংলাদেশীরা। এরপর সিঙ্গাপুরে এসে শুরু হয় খেয়ে না খেয়ে ওভারটাইম আর ছুটির দিনে অন্য কাজ করে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা। অবশ্য এক্ষেত্রে ঝুঁকিও রয়েছে। নির্ধারিত কোম্পানির বাইরে অন্য কোনো কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে সিঙ্গাপুরের আইনে জেল-জরিমানা এমনকি দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে অনেকে করে পার্টটাইম কাজ। দেনা শোধ আর দেশে পরিবার-পরিজনের মুখে হাসি ফোটাতে। কেননা তারা তো জানে যে ছেলে বিদেশে প্রচুর টাকা রোজগার করছে। কিন্তু ছেলের যে কি করুণ অবস্থা তা চোখে না দেখলে তাদের বিশ্বাস করানো যাবে না।’
ডেসকার রোডের বাসিন্দা বাংলাদেশী নাগরিক জহিরুল ইসলাম জানান, ‘বহু বছর আগে থেকেই ১৪ থেকে ১৬ ডলার মজুরির চুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আসছে সিঙ্গাপুরে। আগে দালালদের এই মধ্যস্বত্ব যেমন ছিল না, তেমনি জিনিসপত্রে দামও ছিল কম। ১ থেকে দেড়শ’ ডলারে থাকা-খাওয়া হয়ে যেত একজনের। এখন দেশে যেমন জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া তেমনি সিঙ্গাপুরে আসার ধাক্কা। সবকিছু মিলিয়েই হতাশ সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশীরা। এসবের পাশাপাশি রয়েছে সিঙ্গাপুর সরকারের নানা ট্যাক্সের ঝামেলা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন এসব বিষয় নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে দেশের লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করে তখন একেবারেই চুপচাপ বাংলাদেশ। স্থানীয় প্রবাসীদের নানা সমস্যার ব্যাপারে দূতাবাসকে জানিয়ে কোনো লাভ হয় না। সরাসরি তারা ফিরিয়ে দেন আমাদের। এমনকি পাসপোর্ট নবায়ন কিংবা নতুন চালু হওয়া মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) করতে অ্যাম্বাসিতে গিয়েও হয়রানির শিকার হতে হয়।
এসব বিষয়ে খোঁজ নিতে সিঙ্গাপুরের মিডল রোডে সাংসাইং প্লাজার ৬ষ্ঠ তলায় বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে চোখে পড়ে কয়েকশ’ বাংলাদেশীর ভিড়। নানা প্রয়োজনে এসেছেন সবাই। ওয়েলফেয়ার সেকশনের সামনে ছোট্ট ওয়েটিং রুমেও বসা বেশ কয়েকজন। প্রত্যেকের চেহারাতেই ক্ষোভ। সিঙ্গাপুরে একদিন কাজ কামাই মানে বেতন বন্ধ। এদের একজন শিপইয়ার্ডের কর্মচারী আমির মোহাম্মদ জানান, ‘পাসপোর্ট ইস্যুতে এবার নিয়ে ৬ দিন এসেছেন দূতাবাসে। আরও ক’বার আসতে হবে তার নিশ্চয়তা নেই।’ চাঁদপুরের বাসিন্দা শরিফুল বলেন, ‘এমনিতেই ছোট্ট একটি জায়গা নিয়ে এই বাংলাদেশ দূতাবাস। তার ওপর মাঝের বড় রুমে কাউন্টারের সামনে বাগান তৈরি করেছেন এখানকার কর্মকর্তারা। উদ্দেশ্য ভালো, কিন্তু যেখানে দাঁড়ানো কিংবা বসার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই সেখানে এই বাগান করে আরও ঝামেলায় ফেলা হয়েছে আমাদের। এখন প্রয়োজনে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারি না আমরা। এখানে বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত শ্রমিকরা নানাভাবে হয়রানি আর জটিলতার শিকার হয়। সেসব ব্যাপারে জানালেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না আমাদের এই দূতাবাস।’ পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, সিঙ্গাপুরে দেড় লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশী বাস করে। এদের সব রকম সার্ভিস দিতে আমরা কর্মচারী রয়েছি মাত্র ১২-১৩ জন। তার মধ্যে আবার বড় একটি অংশ সিঙ্গাপুরি। ফলে সবার চাহিদামতো সার্ভিস দেয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজগুলো হয় ঢাকায়। তারা যদি দেরি করে তাহলে আমাদের কি করার আছে? তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি যাতে কাউকে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।’ এসব বিষয়ে কথা বলতে হাইকমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও অফিসে না থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
No comments:
Post a Comment