Friday, August 15, 2014

মুজিব হত্যার নেপথ্যে সরদার সিরাজুল ইসলাম

মুজিব হত্যার নেপথ্যে
সরদার সিরাজুল ইসলাম
যিশুখ্রিস্টকে হত্যার পাপের বোঝা ইহুদীরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে। শেখ মুজিব যিশু ছিলেন না, ছিলেন মানুষ। তাঁর পরিবারের শিশুরা, ছেলেরা, মেয়েরা সবাই মানুষ ছিল, ছিল আদম সন্তান। সম্ভবত এটি এ যুগের বৃহত্তম ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। এমন হৃদয়হীন নির্মমতার নজির অন্যত্র মিলবে কিনা সন্দেহ...। ১৫ আগস্টের ভোর রাত্রির নির্মমতা কারবালার নির্মমতাকে যেন ছেড়ে গেছে। কারবালায় দু’পক্ষের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দন্দ্বী। আর সে হত্যা কোন অর্থেই ঠাণ্ডা রক্তে ছিল না। ... মেয়েদের হত্যার কথা তো মুসলমান সৈনিক ভাবতেই পারে না। অথচ গত ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের বাড়িতেই তাই ঘটেছে। এ দিনের অপরাধ আর পাপ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে আমাদের আতঙ্কটা বেশি। কারণ বৃহৎ অপরাধ, বৃহৎ পাপ বিনা দণ্ডে যায় না। বাংলার মানুষকে সে দণ্ড একদিন একভাবে ভোগ করতেই হবে। এটিও আমার এক বড় রকমের আতঙ্ক।”
মুক্ত বিবেকের কণ্ঠস্বর প্রয়াত মনীষী আবুল ফজল এই হত্যাকা-কে ১৫ আগস্ট ’৭৫ তারিখের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন এমনিভাবে। (শেখ মুজিবকে যেমন দেখেছি পৃঃ ৭৬) :
শত্রুরা সেদিন কেবল একজন মুজিবকে হত্যা করেনি, তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। মুজিবকে কোন গুপ্তঘাতক হত্যা করেনি। ঘাতকরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক পর্যন্ত নিয়ে বেরিয়েছিল। পুরো রাজধানী কর্তৃত্ব রেখে রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাঁর দুই নিকট আত্মীয়-সহকর্মীর বাসভবনে আক্রমণ চালায় এবং একেবারে বিনা বাধায় হত্যাকা- চালায়।
বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন সময় সতর্ক ছিলেন না। থাকেননি গণভবনে। রয়েছেন সাদামাটা নিজ বাড়িতে, নিয়োজিত ছিল ক’জন পুলিশ। রক্ষী বা সেনাবাহিনী ছিল না। ক্ষমতালিপ্সু পাপীরাই সবসময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকে। বাংলাদেশের কেউ মুজিবকে হত্যা করবে একথা তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন না। কেননা জনগণের মঙ্গল কামনায় মুজিবের কোন তুলনা নেই। আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ককে আততায়ীরা অতর্কিতে হত্যা করেছে। কিন্তু মুজিব হত্যা সেসব হত্যাকান্ডের চাইতেও নির্মম।
বস্তুত মুজিবের সফলতা সম্ভাবনাই তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিব সময় পেয়েছেন মাত্র ৩ বছর সাড়ে ৭ মাস। এই সময়ে রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে কতটুকু দেয়া যায় একক প্রচেষ্টায়। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠালেন। নিজস্ব প্রচেষ্টায় দেশকে পুনঃগঠনে ব্রতী হলেন। অথচ গণচীনের মতো দেশকে ১১ বছর সরাসরি সহযোগিতা নিতে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং তা বর্ডার খোলা রেখে। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীন উভয় দেশেই দুর্ভিক্ষে যথাক্রমে ৩ ও ৪ কোটি লোক মারা যায়। বাংলাদেশে অত বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে মুজিবের নেতৃত্বে।
তৃতীয় বিশ্বের একজন রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে কেন ঘটল বিশ্বের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড? হত্যাকারীরা অজুহাত দাঁড় করায় রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা-একদলীয় শাসন-ভারতের কাছে দেশ বিক্রি ইত্যাদি। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা বা একদলীয় শাসনের অজুহাতে কোন রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করা হয়েছে ইতিহাসে তো এমন কোন নজির নেই। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার মধ্যে বাংলাদেশের জন্ম। প্রতিষ্ঠাতা মুজিব যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপোস করতেন তাহলে জীবন দিতে হতো না। ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের এক সপ্তাহ পরে মুজিব জাতিসংঘে যে ভাষণ (বাংলায়) দেন তাতে তৃতীয় বিশ্বকে ‘শর্তযুক্ত ঋণ’ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে একই সফরে (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪) নিজের দেশের অবস্থান মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফোর্ডকে জানানোর পরে মার্কিনীরা কি তাঁকে ছেড়ে দেবে? যে নীলনকশা প্রণীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তা বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, ওরা ভেবেছিল মুজিব ভারতবিদ্বেষী। দ্বিতীয়ত, মুজিবকে দিয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হবে। মুজিবকে ভারত যে গ্রাস করতে পারেনি সেজন্য তাঁকে সরিয়ে দেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয় সাড়ে তিন বছর। মার্কিন স্বার্থ রক্ষা মুজিবকে দিয়ে হলো না বরং মুজিব সমাজতন্ত্রের দিকে, সমর্থন দেয় মার্কিন প্রতিপক্ষ ভিয়েতনামের মুক্তিকামী মানুষকে, পাট চুক্তি করে কিউবার সঙ্গে-তখন আর তাঁকে বাঁচতে দেয়া যায় না।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন কি তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করবে যে মুজিব ভারত, মার্কিন, সোভিয়েতপন্থী ছিলেন না। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী। বাঙালীরা এই ভূখ-ের মালিক, বাঙালী জনগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্রক্ষমতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তা বাঙালীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে। এমনি জাতীয়তাবাদী নেতাকে বিশ্ব মোড়লদের সহ্য হয় না। তাই কাট টু সাইজ রাখার লক্ষ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে মুজিবকে দুর্বল করার জন্য প্রথমেই যে মিলিট্যান্ট টগবগে তরুণ, যারা মুজিবের অতি ভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনী নাম ধারণ করেছিল তাদের বড় একটি অংশ এবং সেনাবাহিনীর কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে মুজিবকে প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড় করাতে শত্রুরা সক্ষম হয়েছিল। ৭২-৭৫ সালে জাসদের এবং সন্তোষে মওলানা ভাসানীর আশ্রয়ে ছিল চৈনিক-রাজাকার-আলবদর বাহিনীসহ মুসলিম লীগের ধনিক শ্রেণী। আওয়ামী লীগের অন্তত ৪ জন গণপরিষদ সদস্যসহ প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, এমনকি ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেছে। এদের মুখপত্র গণকণ্ঠ রাষ্ট্র, সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক মিথ্যা খবর ছাপাত নিয়মিতভাবে।
জাসদ সৃষ্টির পরেও আওয়ামী লীগ-এর অবস্থা ভালই ছিল। তবে ডানপন্থীরা সুবিধা পায়। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পরীক্ষিত বন্ধুদের দূরে সরিয়ে রাখার কাজেও শত্রুরা সফল হয়। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধকে মাত্র ৯ মাসে সফলতা দানে সক্ষম হয়েছিলেন। দুর্দিনের সেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আসলে কারা সক্রিয় ছিল? খোন্দকার মোশতাকরা না অন্য কেউ? দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল তাজউদ্দীন আহমদের। শোনা যায়, মন্ত্রিসভা থেকে বিদায়ের পর বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদ কোন এক সময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। তাই দেখা যায়, জাসদ সৃষ্টি এবং পরে তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরে শত্রুরা মুজিবের ওপর সরাসরি আক্রমণ চালায় এবং সফল হয়।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, মোনেম খানের প্রশাসনযন্ত্রকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুকে প্রশাসন চালাতে হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ৭১ দেশ স্বাধীন হলেও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্য সদস্যরা ঢাকায় আসেন ২২ ডিসেম্বর। পরে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন ১০ই জানুয়ারি। তখন আইনশৃঙ্খলার অবস্থা কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলে শাহাদতবরণ করে জাতির জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কিন্তু বিজয় অর্জনের পরে সুসংগঠিত বাহিনী হিসেবে তাদের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। এদের যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারা বাদে অধিকাংশ পুলিশ স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে পাকবাহিনীর সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে থানার দায়িত্বেও তারাই ছিল। সাবেক ইপিআর-এর অবস্থাও ছিল একই রকম। সে সময় পরিস্থিতি মোকাবেলার পর্যাপ্ত শক্তি তাদের ছিল না। সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল আরও খারাপ। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নগণ্য সংখ্যক সৈনিক নিয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর পুনর্গঠন শুরু হয়। পাকিস্তানে আটকেপড়া সৈনিকরা দেশে ফেরেন দুই বছর পরে। তবে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
বঙ্গবন্ধু ১৪ জানুয়ারি ৭২ তারিখে এক বিবৃতিতে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র সমর্পণ করতে নির্দেশ দিলেও (ক) যে সব চোর ডাকাত ২৫ মার্চ এবং তৎপরবর্তীকালে জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল, (খ) ষোড়শ বাহিনী এবং (গ) অতি উচ্চাভিলাষী যারা পরবর্তীতে জাসদে যোগ দিয়েছিল তারা অস্ত্রসমর্পণ করেনি। এছাড়া অনেক রাজাকার-আলবদর অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বহারা পার্টিতে আত্মগোপন করে। এমনি এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ৭২ সালে এক ঘোষণায় রক্ষীবাহিনী গঠন করেন।
রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর চাইতে উচ্চতর সুযোগ সুবিধা দেয়ার যে অপপ্রচার চালানো হয় তাও বস্তুনিষ্ঠ নয়। কেননা রক্ষীবাহিনী যেহেতু একটি নতুন বাহিনী, তাদের জন্য নতুন অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ দিতে হয়েছিল। বস্তুত বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষীবাহিনীর (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে) চাইতে অনেক বেশি দিয়েছিলেন। সীমিত সম্পদের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত সেনানিবাসগুলোকে পুনর্গঠন, নতুন করে নৌ ও বিমান ঘাঁটি স্থাপন করেন। তাদের সুযোগ-সুবিধাও যথারীতি অব্যাহত ছিল। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার করা হোক না কেন ক্ষেত্র বিশেষে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বাড়াবাড়ি হয়েছে হয়ত; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেউ কোনদিন আনতে পারেনি এবং বঙ্গবন্ধু-পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান তাদের সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত পদমর্যাদায় আত্তীকরণ অনুষ্ঠানে বলেন, রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার হয়েছে তা সত্য নয়। এখন দেখছি তাদের গাড়ি, পোশাক, অস্ত্র সেনাবাহিনীর চেয়ে ভাল ছিল না। বেতনও বেশি ছিল না (চিত্র বাংলা, ২১-২৭ মে, ১৯৯২)।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় ভারতের ভূমিকা কি ছিল তা ইতিহাসের গবেষণার বিষয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকার দুটি দৈনিকে প্রকাশিত লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। আজকের কাগজ ২ জানুয়ারি ৯২ তারিখ সংখ্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও জাতীয় রাজনীতি নিবন্ধে রইস উদ্দিন আরিফ লিখেছেন- ‘আমরা একদল সিরাজ সিকদার হত্যা, আরেক দল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য বছরের পর বছর মাথা কুটে মরছি। এ দুটো হত্যাকাণ্ডের বিচারের ভার যদি আমাকে দেয়া হয় তাহলে নির্ঘাত আমি জোড়া খুনের ফাঁসির দড়িটি ঝুলাব ‘র’-এর গলায়। আমার বিচারের রায় শুনে অনেকেই ঠাট্টা বিদ্রূপ করবেন, কেউ কেউ গাঁজাখুরি বলে হেসে উড়িয়ে দেবেন, কেউ আবার রায় শোনার আগেই দৌড়ে পালাবেন, যেমনটি কলকাতায় দৌড়ে পালিয়েছেন চিত্তরঞ্জন সুতার বঙ্গবন্ধু হত্যার দুদিন আগেই।’ এ ধরনের বক্তব্যের ভিত্তি কি তা লেখকই জানেন। তবে তৎকালীন ইন্দিরা সরকারকে সম্পৃক্ত করার মতো বস্তুনিষ্ঠ কোন তথ্য শোনা না গেলেও সেখানকার প্রতিক্রিয়াশীলরা এদেশকে ভারতের ভোগ্যপণ্য বাজার দখলের প্রধান অন্তরায় মুজিবকে সরিয়ে দিতে তৎপর ছিল তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর ১২ আগস্ট ৯৭ তারিখের দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পদধ্বনি কি আগে শোনা যায়নি?’ শিরোনামে নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করেছেন। জনাব চৌধুরী ছিলেন লন্ডন প্রবাসী। দেশে এসেছিলেন ১৪ জুন এবং লন্ডন ফেরেন ২৪ জুলাই ৭৫। উল্লেখিত সময়ে ঢাকায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্র ধরে বাংলাদেশে মুজিব সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত সম্পর্কে জনাব চৌধুরী তার উৎকণ্ঠার কথা ভারতীয় দূতাবাস প্রধান সমর সেন এবং প্রেস কাউন্সিলর অশোক দাশগুপ্তকে জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, অশোক দাশগুপ্ত বিক্রমাদিত্য ছদ্মনামে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ওপর কনফিডেনসিয়াল ডায়েরি নামের একটি বই লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে তাকে এ দেশ থেকে ৩ দিনের মধ্যে বহিষ্কার করা হয়। উক্ত প্রেস কাউন্সিলর অশোক দাশগুপ্ত পরবর্তীতে প্যারিসে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের পূর্বে হিথরো বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতির সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েকদিন পরে টেলিফোনে জানান, জনাব চৌধুরী যে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন তা সমর সেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সরাসরি জানিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সেটা খোয়া গেছে, ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছেনি।
বঙ্গবন্ধু যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তাঁর দুঃখী সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিনের লালিত সংগ্রামের ফসল সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রবর্তন করেছিলেন তা ছিল সমাজ বিবর্তনে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার লক্ষ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন (ট্রানজিশন পিরিয়ড) সময়ের জন্য। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনীর ভাষা থেকে। জাতীয় দল গঠনের অভিপ্রায় ব্যক্ত উক্ত সংশোধনীতে (ধারা ১১৭-এ) বলা হয় : “রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে অনুচ্ছেদ-২এ বর্ণিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার (চার মূলনীতি) যে কোন একটি পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তা হলে তিনি একটি মাত্র জাতীয় দল গঠনের নির্দেশ প্রদান করবেন।
সংশোধনীর এই ভাষা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি জাতীয় দল গঠনে ব্রতী হন। উল্লেখ্য, সমাজতন্ত্রী দেশে একটি মাত্র দল থাকে। তবে রাষ্ট্র মৌলিক প্রয়োজনের দায়িত্ব নেয়। লক্ষণীয়, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন তাহলে একদল করার ক্ষমতা তাকে দেয়া হলেও ভবিষ্যতে নির্ধারিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পরে আবার তিনি যখন মনে করবেন যে একদলের আর প্রয়োজন নেই তখন একাধিক দল গঠনের নির্দেশও তিনি প্রদান করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা এবং জাতীয় দল গঠন করেছিলেন জনগণের নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এবং এতে দলে দলে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল। ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে ৭জন বাদে সবাই বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন (পূর্বকোণ ২৯ জুন, ১৯৯১)। জিয়া শুধু বাকশালে যোগই দেননি বরং বাকশাল ডিজিগণের গভর্নরদের লিখিত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন (১৯ জুলাই, ৭৫ তারিখে পাবনার অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে লেখা পত্র ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-, পৃষ্ঠা ২৫৭ দ্রষ্টব্য)। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিং, হাজী দানেশ বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আগস্ট ৭৫- এর তৃতীয় সপ্তাহে কমরেড তোহার বাকশালে যোগদানের কথা ছিল (তারকালোক ১৫-৩০ ডিসেম্বর ৮৭)। বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক এনায়েতুল্লাহ খান শুধু বাকশালে যোগ দেননি বরং প্রেস সংক্রান্ত ব্যবস্থাবলী (পত্রিকা নিয়ন্ত্রণসহ) প্রণয়ণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ৪টি পত্রিকা রেখে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বেকার করে দেন বলে যে অপপ্রচার চালানো হয় তা বস্তুনিষ্ঠ নয়। কেননা এদের সবাইকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসনে চাকরির ব্যবস্থা করেন এবং সে সুবাদে অনেকেরই কপাল খুলে যায়।
একমাত্র শেখ মুজিবই এদেশের অসহায় দুঃখী মানুষের ভাত কাপড়ের জন্য নিজের জনপ্রিয়তার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শোষণের প্রক্রিয়াকে যতখানি ভাঙতে চেয়েছিলেন তার কিছুটা ভেঙ্গেছেন, তবে দিয়েছিলেন প্রচ- ঝাঁকুনি। কি করতে পেরেছেন, যদিও তুলনামূলকভাবে তা অসামান্য নয় তবে সেটাই বড় কথা নয়। গভীর দৃষ্টি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় এনে দেখতে হবে তিনি কি করতে চেয়েছিলেন। তা কার্যকর করতে পারেননি সময়ের অভাবে। তাঁর আন্তরিকতার সন্দেহ পোষণ করা হবে বড় ধরনের পাপ।
প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সদ্য প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম যথার্থই বলেছেন, ‘শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। সবদিকে বড়, তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালবাসায় এবং দুর্বলতায়। সবদিকে এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈশিতের স্থান দখল করা যায় না।’
তাইতো এই ভূখণ্ডে মুজিবের স্থায়ী অবস্থান মধ্য গগনে এবং তাঁর নাম শুনে শোষকের সিংহাসন কাঁপে।
লেখক : গবেষক
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment