Friday, August 1, 2014

অভয়নগরে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ

অভয়নগরে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ
মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু, নওয়াপাড়া (যশোর) থেকে
প্রকাশ : ০২ আগস্ট, ২০১৪

‘শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভূই, বাকি সব গেছে ঋণে। বাবু কহিলেন বুঝেছো উপেন, এ জমি লইবো কিনে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার ‘উপেন’-এর খোঁজ মিলেছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সড়াডাঙ্গায়। সমিতি থেকে নেয়া দাদনের টাকা শোধ করতে গিয়ে যিনি তার শেষ সম্বল দুই বিঘা জমিও হারিয়েছেন। এখন ভিটে-মাটির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে সমিতির আড়ালে গজিয়ে ওঠা দাদন ব্যবসায়ীদের। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপেন এখন চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন। মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু হারানোর চিন্তায় তিনি কংকালসার হয়ে পড়েছেন।
উপেনের মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। যারা দাদন ব্যবসার শিকার। অভয়নগর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন এনজিও এবং সাহায্য সংস্থার বাইরে গজিয়ে উঠা এসব সমিতি স্বনির্ভরতার প্রণোদনা দেয়ার মহত্ত্বের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে দাদন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর অভাবগ্রস্ত শত শত মানুষ এসব সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে সুদের টাকার জোগান দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। অনেকে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সংসার-ধর্ম ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছেন। সমিতির আড়ালে সমাজে প্রভাবশালী এই দাদন ব্যবসায়ীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেন না।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত এনজিও এবং সাহায্য সংস্থা ছাড়াও শতাধিক সমিতি রয়েছে। এলাকাভিত্তিক এসব সমিতি বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় আদায় করে থাকে। এসব সমিতি আবার অভাবগ্রস্তদের মাঝে উচ্চসুদে ঋণ দেয়। ঋণ দেয়া এবং সুদের টাকা উঠানোর জন্য এসব সমিতির রয়েছে আলাদা ক্যাডার বাহিনী।
ভুক্তভোগীরা বলেছেন, সমিতির বেতনভুক্ত ক্যাডাররা সব সময় এলাকায় অভাবগ্রস্ত এবং বিপদে পড়া লোকজনের খবর রাখে। কেউ বিপদে পড়লে কয়েক দিন তার আশপাশে ঘুরে ঘুরে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। ভালো ভালো কথা বলে। এক পর্যায়ে সমিতি থেকে কম সুদে টাকা পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে জালে জড়িয়ে নেয়। পরে আড়াইশ’ টাকার সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়ে টাকা দেয়। সঙ্গে বন্ধক নেয় জমি কিংবা বাড়ির দলিল। নির্ধারিত তারিখে সুদের টাকা দিতে না পারলেই শুরু হয় নানাভাবে নির্যাতন। সাদা স্ট্যাম্পে সুবিধামতো লিখে নিয়ে বসতবাড়ি কিংবা ধানী জমির দখল নিয়ে নেয়। এভাবেই অভয়নগরে সমিতির নামে দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়ন চলছে বছরের পর বছর। ভুক্তরা বলেছেন, এসব সমিতির ক্যাডাররা আসলের পরিবর্তে সুদের টাকা আদায়ে বেশি তৎপর।
সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, অভয়নগর উপজেলার পশ্চিমাংশে হিন্দু অধ্যুষিত ৯৬ গ্রামের অভাবগ্রস্ত বসিন্দাদের ঘিরেই সমিতির নামে দাদন ব্যবসায়ীদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এ ৯৬ গ্রামের একটি সড়াডাঙ্গা। এখানে বংশ পরম্পরায় বসবাস উপেন পালের। শুক্রবার পার্শ্ববর্তী সুন্দলি বাজারে উপেনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। উপেন পাল জানান, চার বছর আগে তার বড় ছেলে শম্ভু পাল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার-কবিরাজ কিছুতেই তাকে সুস্থ করা যাচ্ছিল না। নওয়াপাড়া হাসপাতালের এক ডাক্তার তার ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু টাকা না থাকায় তিনি ছেলের চিকিৎসা করানোর জন্য ঢাকায় নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারছিলেন না। এ সময় পরিচিত এক লোক তাকে পার্শ্ববর্তী ধোপাদি গ্রামের একটি সমিতিতে নিয়ে যায়।
উপেন জানান, পৈতৃক ভিটে ছাড়াও তার তিন বিঘা জমি ছিল। তাও আবার বছরের বেশির ভাগ সময় ওই জমি থাকে পানির নিচে। ওই জমি চাষাবাদ আর মাছ ধরে কোনো মতে তিনি চার ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে ছিলেন। উপেন বলেন, একবিঘা জমির দলিল বন্ধক রেখে সাদা স্ট্যাম্পে সই দিয়ে তিনি ওই সমিতির কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন হওয়ায় পরে আরও এক লাখ টাকা তিনি ঋণ নেন। কিন্তু ওই টাকা আর শোধ দিতে পারেননি। সুদে-আসলে ওই টাকা এখন ১০ লাখের ওপরে দাঁড়িয়েছে। উপেন জানান, চাপে পড়ে প্রথমে তিনি সমিতির নামে এক বিঘা জমি লিখে দিতে বাধ্য হন। প্রায় দুই বছর আগে বাকি দুই বিঘাও লিখে দিয়েছেন। সমিতি এখন তার বসতবাড়ি চায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে উপেন এ প্রতিবেদককে জানান, এত কিছুর পরও তিনি তার ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। এখন সব কিছু হারিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে না খেয়ে মরার অবস্থা।
একই অবস্থা নওয়াপাড়া গুয়াখোলা গ্রামের ক্লিনিকপাড়ার বাসিন্দা গরিব ট্রাকচালক আফজাল হোসেনের। আফজাল হোসেনের স্ত্রী মোমেনা বেগম শুক্রবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তার স্বামীর আয়ে সংসার ভালোভাবে চলে না। তার পর দুই মেয়ে শারমিন আর রাহানা আক্তারকে শিক্ষিত করে তুলতে গিয়ে তিনি গুয়াখোলা সমাজ কল্যাণ এবং নওয়াপড়া বাজারের শক্তি সমিতি থেকে বিভিন্ন সময়ে এক লাখ টাকা লোন গ্রহণ করেন। ওই টাকা সুদে আসল এখন সাড়ে চার লাখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এত টাকা দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।
তিনি বলেন, ঘরে তার দুটি বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে। বড় মেয়ে খুলনার বয়রা মহিলা কলেজে অনার্স পড়ছে। আর ছোটটা এ বছর এইচএসসি দিয়েছে। এদিকে টাকার জন্য সমিতির লোকজন সব সময় তার বাসায় বসে থাকে। মোমেনা বেগম বলেন, এখন তার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভয়নগরে বিভিন্ন সমিতি ও ক্লাবের নামে দাদন ব্যবসা শুরু হয় নব্বই দশকে। প্রত্যন্ত এলাকায় অনটনগ্রস্তদের টার্গেট করে একশ্রেণীর অসাধু মানুষ সমিতি ও ক্লাবের নামে এ দাদন ব্যবসায় নামে। কয়েক দশকে তারা ফুলেফেঁপে উঠেছেন।
জানা গেছে, অভয়নগর উপজেলায় এলাকাভিত্তিক সমিতির নামে যে সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাদন ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ধোপাদি যুব উন্নয়ন সমিতি, তরুণ উন্নয়ন সমিতি, রাজঘাট বন্ধু কল্যাণ সমিতি, বন্ধু কল্যাণ সংস্থা, গুয়াখোলা একতা সমাজ কল্যাণ সমিতি, গুয়াখোলা যুব উন্নয়ন সমিতি, সবুজ সাথী ক্লাব, বন্ধন ৮৬ সমিতি, ভাটবিলা শাপলা ক্লাব সমিতি, সড়াডাঙ্গা স্টার ক্লাব, সড়খোলা সমিতি, শংকরপাশা গ্রামে জনপ্রিয় সমবায় সমিতি, শংকরপাশা ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, চলিশিয়া পশ্চিমপাড়া সানমুন ক্লাব, মহাখালী বণিক সমিতি, চেঙ্গুটিয়া শাপলা সমিতি, চেঙ্গুটিয়া বণিক সমিতি, সম্মিলনী যুব সংঘ, সনাতন সংঘ, নওয়াপাড়া বাজারের আলোকিত সঞ্চয় সমিতি, নবদিগন্ত সংস্থা ও পল্লী ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অন্যতম। এর বাইরে অভয়নগর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অর্ধশতাধিক ক্লাব ও সমিতি রয়েছে যারা মূলত দাদন ব্যবসা করছে। আর এসব সমিতি ও ক্লাব থেকে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন এলাকার হাজার হাজার মানুষ। এসব সমিতি ও ক্লাবের নামে দাদন ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় নতুন প্রজন্মও এ ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
যেখানে-সেখানে গজিয়ে উঠছে সমিতি ও ক্লাব। সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন এসব দাদন ব্যবসায়ীদের দেখেও না দেখার ভান করে।
- See more at: http://www.jugantor.com/last-page/2014/08/02/129270#sthash.WzXfW3DN.dpuf

No comments:

Post a Comment