চট্টগ্রামে ইমাম গ্রুপের ৮৫০ কোটি টাকার জালিয়াতি
জসীম চৌধুরী সবুজ ও দেলোয়ার হুসেন
প্রকাশ : ০২ আগস্ট, ২০১৪
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে চট্টগ্রামের ইমাম গ্র“প। এর মধ্যে স্বনামে নিয়েছে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ১০০ কোটি টাকা বেনামে। ২৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন শাখা থেকে ঋণ নেয়ার এসব তথ্য জানা গেছে। এসব নিতে যেমন নজিরবিহীন জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তেমনি ঋণ পরিশোধের নামেও করা হয়েছে অভিনব প্রতারণা। গ্র“পটির বিরুদ্ধে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ১২২ কোটি টাকার ৩২টি চেক জালিয়াতির মামলাও করা হয়েছে। পরিশোধ না করায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো গ্রুপের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে। এর মধ্যে অত্যন্ত সহজ শর্তে নেয়া এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট), টিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্ট বা আমদানির জন্য সহজ শর্তের ঋণ), পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট বা ফোর্সড লোন) রয়েছে। এছাড়া গ্র“পের মালিক মোহাম্মদ আলী শেয়ারবাজারেও লভ্যাংশ খেলাপি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সরেজমিন অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, আলোচিত এই ব্যবসায়ীকে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিছু তদন্ত করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত করেনি। অথচ প্রতারণা ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ৮৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নতুন ঋণ না পেয়ে ইমাম গ্র“পের ব্যাংক ঋণনির্ভর আমদানি ব্যবসা প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ। তবে গ্র“পের অন্যান্য ব্যবসা সীমিত আকারে চলছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইমাম গ্র“পের মালিক মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে বলেন, দেশে ব্যবসায়ে মন্দা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার কারণে বড় ধরনের লোকসান হয়েছে। এতে শুধু আমি নই, অনেক ব্যবসায়ীই পথে বসেছে। সয়াবিন তেল ও চিনি আমদানি করে তাদের এই দশা। এতে আমাদের কোনো হাত নেই।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক ঋণ আদায়ে মামলা করছে। অনেক ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছি। অতিরিক্ত জামানত দিয়েছি। অনেকের সঙ্গে আলোচনা করছি। যেভাবেই হোক ব্যাংকের টাকা শোধ করে দেব। আগামী চার বছরের মধ্যে সব নিয়মিত করে ফেলব। এ জন্য কিছু জমি বিক্রি করে দেব।
এখন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি এখন আমার মনে নেই, হিসাব করে দেখতে হবে। ২০০০ সালে ঋণ ছিল মাত্র ২ কোটি টাকা। ২০০৫ থেকে আমি বেশি ঋণ নেয়া শুরু করি।
ইমাম গ্র“পের ঋণ কত : সূত্র জানায়, সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় তদন্ত শুরু করে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ওই সময়ে ইমাম গ্র“পের ঋণ পরিস্থিতি জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক একটি প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়। এর আলোকে ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, দেশের ২৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইমাম গ্র“পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ৬১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ওইসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে বন্ধকি যে সম্পদ রয়েছে সেগুলোর ওই সময়ের বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা।
যদিও মোদাম্মদ আলী দাবি করেছেন, এত ব্যাংকে তার ঋণ নেই। ঋণের পরিমাণের চেয়ে জামানত বেশি। ব্যাংক চাইলে নতুন করে আরও জামানত দিচ্ছেন।
অন্য একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সিআইবির তথ্যে ইমাম গ্র“পের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে বেনামী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কমপক্ষে আরও ১০০ কোটি টাকা ঋণের সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও ঋণ থাকতে পারে বলে জানা গেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশদ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসতে পারে।
যেসব জালিয়াতি : ব্যাংককে প্রভাবিত করে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ঋণ নেয়া, ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া, ঘন ঘন এলসি লিমিট বাড়ানো, এলটিআর নেয়া ও ঘন ঘন তা নবায়ন করা। এলসি করে পণ্য আমদানির পরও টাকা পরিশোধ না করা। পণ্য রফতানির জন্য প্যাকিং ক্রেডিট (পিসি) ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা। লোন এগেইনস্ট মার্চেন্ডাইজিং (লিম বা এক ধরনের বাণিজ্য ঋণ) নিয়ে তা পরিশোধ না করা। ব্যাংকের ভুয়া অভ্যন্তরীণ বিল কেনাবেচা (আইবিপি) ইস্যু করে টাকা পরিশোধ না করা। পণ্য আমদানি করে টাকা পরিশোধ না করায় পিএডি ঋণ বা ফোর্সড লোন সৃষ্টি। ব্যাংকগুলোতে ভুয়া চেক বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়ার মতো হরেকরকমের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
এছাড়া ঋণের আবেদনপত্র ছাড়াই ঋণ মঞ্জুর, ঋণের পর্যাপ্ত জামানত না থাকা, ভুয়া গ্যারান্টার, ভেজাল সম্পদ বন্ধক রাখার মতো জালিয়াতিও করা হয়েছে।
কে এই মোহাম্মদ আলী : চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মোহাম্মদ আলী এক সময় ‘ফাইভ ফিফটি ফাইভ’ আলী নামে পরিচিত ছিলেন। ’৮০-র দশকে ৫৫৫ ব্র্যান্ডের বিদেশী সিগারেট অবাধে চোরাচালানি হয়ে চট্টগ্রামে আসত জাহাজে। সেই চোরাচালানি ব্যবসায় অর্থনৈতিক সাফল্য এলে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠা পান তিনি। গড়ে তোলেন ইমাম গ্র“প। চট্টগ্রামের টেরিবাজারে পাইকারি কাপড় ব্যবসা, মার্কেট ও হোটেল আল ইমাম দিয়ে তার যাত্রা শুরু। এরপর ইমাম বাটনসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানেও ঝোঁকেন তিনি। ইমাম বাটন শেয়ারবাজার থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা এখন ভালো নয়।
এরপর মোহাম্মদ আলীর মধ্যে ঢুকে পড়ে জমি ও বাড়ি কেনার ঝোঁক। ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন শিল্প-কারখানা বা বাণিজ্যের নামে। কিন্তু ঋণের টাকা শিল্প-কারখানা বা ব্যবসায় না লাগিয়ে কিনেছেন একের পর এক ভেজাল জমি, ভবন। বিশ্বস্ত কাউকে সরকারি পরিত্যক্ত ভবনের মালিক সাজিয়ে তার কাছ থেকে ভুয়া দলিলমূলে নিজে মালিক হয়েছেন। এ নিয়ে মামলায় সরকার পক্ষকে ম্যানেজ করে রায় নিজের অনুকূলে নিয়ে ভবন দখল করেছেন। বেসরকারি কোনো জমি বা ভবন নিয়ে অনেক পক্ষের মধ্যে বিরোধ রয়েছে এ ধরনের জমি বা ভবন তিনি কিনে নিয়েছেন। সেসব জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে আবার বড় অংকের ঋণ নিয়ে তা দিয়ে কিনেছেন নতুন জমি। আগে জমি বা ভবন কেনার দু-চার বছর পর তার মূল্য তিন-চার গুণ বেড়ে যেত। তা বিক্রি করে লাভবান হতেন তিনি। কিন্তু শেয়ারবাজারে ধস, ইউনিপে কেলেংকারিসহ অর্থনীতির বেহাল অবস্থায় জমি ব্যবসায়ও ধস নামে। জমির দাম কমে যায়। ক্রেতার সংকট দেখা দেয়। তখন থেকেই ইমাম গ্র“পের সংকটও তীব্র হতে থাকে। একে একে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপির তালিকায় এ গ্র“পের নাম উঠতে থাকে। খেলাপির কারণে নতুন ঋণ পাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গ্র“পের সংকট ঘনীভূত হয়।
যেসব ব্যাংকে জালিয়াতি : সোনালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। ভিজিলেন্স বিভাগের তদন্তে ওই সময়ে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ূন কবীরকে ‘উপরি’ দিয়ে কোনো নিয়ম-কানুনের প্রতিপালন ছাড়াই ওই টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। নামে-বেনামে এর বেশির ভাগই নিয়েছে ইমাম গ্র“প। গ্র“পের ইমাম ট্রেডার্সকে ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা এলসির বিপরীতে এবং ৭৫ কোটি টাকা এলটিআর।
গ্রাহক ঋণের জন্য ব্যাংকে কোনো আবেদন করেনি অথচ প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ অনুমোদন হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত জামানত নেই, ঋণের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যবহারের ফলে এখন ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।
একই শাখা থেকে মনোয়ারা ট্রেডিংয়ের নামে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এটি ইমাম গ্র“পের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বলে সোনালী ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। ব্যাংকের নথিতে এর যে ঠিকানা উল্লেখ আছে, সে ঠিকানায় এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। এরকম আরও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ইমাম গ্র“প ঋণ নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও মোহাম্মদ আলী এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গ্র“পের নামে যখন ঋণ অনুমোদন করা হয় তখন বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল। নিয়ম অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের ঋণ অনুমোদনের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে ছাড়পত্র নিতে হয় যে, তিনি বা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খেলাপি নয়। খেলাপি ঋণ থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া যায় না। ইমাম গ্র“পকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। ফলে খেলাপি হয়েও গ্র“পটি নতুন ঋণ পেয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ইমাম গ্র“প একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আÍসাৎ করেছে। এর মধ্যে ১৪ কোটি টাকা পরিশোধ করার দাবি জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী। তার হিসাবে টাকার অংক আরও কম। ব্যাংক বেশি দেখাচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম (বর্তমানে খাতুনগঞ্জ শাখায় দায়িত্বরত) জানান, মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে ১৪৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যে অর্থঋণ আদালতে একাধিক মামলা করা হয়েছে। ঋণের বিপরীতে মোহাম্মদ আলী যেসব জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখেছেন তার দলিলপত্রে বিস্তর ভেজাল রয়েছে। মোহাম্মদ আলী চট্টগ্রাম শহরে ও গ্রামে প্রচুর জমি-বাড়ি কিনেছেন, মার্কেট বানিয়েছেন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থে। এভাবে প্রচুর সম্পত্তি কিনলেও অধিকাংশ জমি ও বাড়ির দলিলপত্রে ভেজাল থাকায় এবং দাম কমে যাওয়ায় তা এখন বিক্রিও করতে পারছেন না। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকের দেনা শোধ করতে না পেরে তিনি এখন ব্যবসা রেখে মামলা মোকদ্দমাতেই ব্যস্ত।
অগ্রণী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আ ম ম শাহজাহান জানান, মোহাম্মদ আলীর কাছে এখন তাদের পাওনা ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ঋণ ছিল ৩ কোটি টাকা। টাকা আদায়ে ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এদিকে মোহাম্মদ আলীও ব্যাংকের এমডি, ডিএমডিসহ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেছেন। তার অভিযোগ, ব্যাংক তার কাছে অত্যধিক টাকা দাবি করছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক চট্টগ্রামের ষোলোশহর শাখা থেকে ইমাম গ্র“প বিভিন্ন ভাবে আÍসাৎ করেছে ১০২ কোটি টাকা। দুদকের অনুসন্ধানে এ তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এর সঙ্গে ব্যাংকের ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে। গ্র“পের আনিকা এন্টারপ্রাইজ এই শাখা থেকে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ না করায় খেলাপি হয়। পরে তা ১১৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এরপর তা তিনবার নবায়ন করা হয়। এই ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধক দেয়া হয় ৪ দশমিক ২১৮৩ একর জমি। যার মূল্য মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এ জমিতে রয়েছে ভেজাল। দুই একর জমি মোহাম্মদ আলীর নামে নামজারিই হয়নি। মূলত ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এ ঋণ দেয়া হলেও ব্যাংক এই ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো নিয়ম-কানুন মানেনি। এ নিয়ে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলতেও রাজি হননি।
ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকেও আমদানির বিপরীতে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না ইমাম গ্র“প। শর্ত ছিল পণ্য আমদানির পর তা বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করে দেয়া হবে। কিন্তু ইমাম গ্র“প তা শোধ করেনি। ফলে গ্র“পের কাছে ব্যাংক প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি টাকাও পরিশোধ করার জন্য আলোচনা করছে।
এক্সিম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় থাকা ঋণের বিপরীতে মাত্র ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পরিশোধের ব্যাপারে ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
প্রাইম ব্যাংকের আগ্রাবাদ জুবিলী রোড শাখায় ও আগ্রাবাদ শাখায় অর্ধশত কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। মোহাম্মদ আলীর মতে ব্যাংক ঋণের টাকা বেশি দেখাচ্ছে। দুই শাখা বর্তমানে তার কাছে ৪৭ কোটি টাকার মতো পাবে। ওই টাকার বিপরীতে ব্যাংকে তার জামানতের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। এদিকে প্রাইম ব্যাংক সূত্র জানায়, জামানতের পরিমাণ আরও কম।
ব্যাংক এশিয়ার আগ্রাবাদ শাখায় ইমাম গ্র“পের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ১৮ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে ব্যাংক মামলা করেছে। মোহাম্মদ আলীর দাবি ব্যাংক তার কাছে পাবে ১৪ কোটি টাকা।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় বকেয়ার পরিমাণ ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করার ব্যাপারে তিনি ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে যুগান্তরকে জানান।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। ব্যাংকে জামানত দিয়েছেন প্রায় ৭১ কোটি টাকার। ব্যাংকের দাবি জামানতের পরিমাণ কম। ঋণের টাকা আরও বেশি।
মোহাম্মদ আলীর হিসাবে ঢাকা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ৭ কোটি টাকা বকেয়ার মধ্যে ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য আলোচনা করছেন।
এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ ও জুবলি রোড শাখায় দুটি ঋণ রয়েছে ইমাম গ্র“পের। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ ব্যাংক এই দাবি করছে। মোহাম্মদ আলী দাবি করেছেন, এবি ব্যাংক তার কাছে পাবে প্রায় ১৩ কোটি টাকার মতো।
উত্তরা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় গ্র“পের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৪৫ কোটি টাকা। গ্রাহক ৪০ কোটি টাকা চার বছরে পরিশোধ করতে সম্মত। ব্যাংক সুদসহ চাইছে ৪৩ কোটি টাকা। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) জুবলি রোড শাখা পাবে ২০ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে ব্যাংক ইতিমধ্যেই মামলা করেছে।
এর আগে বেসরকারি খাতের এনসিসি, ন্যাশনাল ও ওয়ান ব্যাংকে ওম প্রকাশ আগারওয়াল ও গিরিধারী লাল মোদির ঋণ কেলেংকারির ঘটনায় ৩০০ কোটি টাকা আÍসাৎ করা হয়েছিল। ওই ঘটনার সঙ্গেও মোহাম্মদ আলীর যোগসূত্র ছিল। তখন তিনি এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তিনি পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এখন এনসিসি ব্যাংকে তার শেয়ার তার ছেলের নামে রয়েছে।
- See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/08/02/129261#sthash.qVweIpHW.dpuf
জসীম চৌধুরী সবুজ ও দেলোয়ার হুসেন
প্রকাশ : ০২ আগস্ট, ২০১৪
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে চট্টগ্রামের ইমাম গ্র“প। এর মধ্যে স্বনামে নিয়েছে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ১০০ কোটি টাকা বেনামে। ২৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন শাখা থেকে ঋণ নেয়ার এসব তথ্য জানা গেছে। এসব নিতে যেমন নজিরবিহীন জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তেমনি ঋণ পরিশোধের নামেও করা হয়েছে অভিনব প্রতারণা। গ্র“পটির বিরুদ্ধে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ১২২ কোটি টাকার ৩২টি চেক জালিয়াতির মামলাও করা হয়েছে। পরিশোধ না করায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো গ্রুপের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে। এর মধ্যে অত্যন্ত সহজ শর্তে নেয়া এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট), টিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্ট বা আমদানির জন্য সহজ শর্তের ঋণ), পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট বা ফোর্সড লোন) রয়েছে। এছাড়া গ্র“পের মালিক মোহাম্মদ আলী শেয়ারবাজারেও লভ্যাংশ খেলাপি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সরেজমিন অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, আলোচিত এই ব্যবসায়ীকে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিছু তদন্ত করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত করেনি। অথচ প্রতারণা ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ৮৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নতুন ঋণ না পেয়ে ইমাম গ্র“পের ব্যাংক ঋণনির্ভর আমদানি ব্যবসা প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ। তবে গ্র“পের অন্যান্য ব্যবসা সীমিত আকারে চলছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইমাম গ্র“পের মালিক মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে বলেন, দেশে ব্যবসায়ে মন্দা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার কারণে বড় ধরনের লোকসান হয়েছে। এতে শুধু আমি নই, অনেক ব্যবসায়ীই পথে বসেছে। সয়াবিন তেল ও চিনি আমদানি করে তাদের এই দশা। এতে আমাদের কোনো হাত নেই।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক ঋণ আদায়ে মামলা করছে। অনেক ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছি। অতিরিক্ত জামানত দিয়েছি। অনেকের সঙ্গে আলোচনা করছি। যেভাবেই হোক ব্যাংকের টাকা শোধ করে দেব। আগামী চার বছরের মধ্যে সব নিয়মিত করে ফেলব। এ জন্য কিছু জমি বিক্রি করে দেব।
এখন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি এখন আমার মনে নেই, হিসাব করে দেখতে হবে। ২০০০ সালে ঋণ ছিল মাত্র ২ কোটি টাকা। ২০০৫ থেকে আমি বেশি ঋণ নেয়া শুরু করি।
ইমাম গ্র“পের ঋণ কত : সূত্র জানায়, সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় তদন্ত শুরু করে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ওই সময়ে ইমাম গ্র“পের ঋণ পরিস্থিতি জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক একটি প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়। এর আলোকে ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, দেশের ২৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইমাম গ্র“পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ৬১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ওইসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে বন্ধকি যে সম্পদ রয়েছে সেগুলোর ওই সময়ের বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা।
যদিও মোদাম্মদ আলী দাবি করেছেন, এত ব্যাংকে তার ঋণ নেই। ঋণের পরিমাণের চেয়ে জামানত বেশি। ব্যাংক চাইলে নতুন করে আরও জামানত দিচ্ছেন।
অন্য একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সিআইবির তথ্যে ইমাম গ্র“পের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে বেনামী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কমপক্ষে আরও ১০০ কোটি টাকা ঋণের সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও ঋণ থাকতে পারে বলে জানা গেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশদ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসতে পারে।
যেসব জালিয়াতি : ব্যাংককে প্রভাবিত করে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ঋণ নেয়া, ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া, ঘন ঘন এলসি লিমিট বাড়ানো, এলটিআর নেয়া ও ঘন ঘন তা নবায়ন করা। এলসি করে পণ্য আমদানির পরও টাকা পরিশোধ না করা। পণ্য রফতানির জন্য প্যাকিং ক্রেডিট (পিসি) ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা। লোন এগেইনস্ট মার্চেন্ডাইজিং (লিম বা এক ধরনের বাণিজ্য ঋণ) নিয়ে তা পরিশোধ না করা। ব্যাংকের ভুয়া অভ্যন্তরীণ বিল কেনাবেচা (আইবিপি) ইস্যু করে টাকা পরিশোধ না করা। পণ্য আমদানি করে টাকা পরিশোধ না করায় পিএডি ঋণ বা ফোর্সড লোন সৃষ্টি। ব্যাংকগুলোতে ভুয়া চেক বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়ার মতো হরেকরকমের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
এছাড়া ঋণের আবেদনপত্র ছাড়াই ঋণ মঞ্জুর, ঋণের পর্যাপ্ত জামানত না থাকা, ভুয়া গ্যারান্টার, ভেজাল সম্পদ বন্ধক রাখার মতো জালিয়াতিও করা হয়েছে।
কে এই মোহাম্মদ আলী : চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মোহাম্মদ আলী এক সময় ‘ফাইভ ফিফটি ফাইভ’ আলী নামে পরিচিত ছিলেন। ’৮০-র দশকে ৫৫৫ ব্র্যান্ডের বিদেশী সিগারেট অবাধে চোরাচালানি হয়ে চট্টগ্রামে আসত জাহাজে। সেই চোরাচালানি ব্যবসায় অর্থনৈতিক সাফল্য এলে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠা পান তিনি। গড়ে তোলেন ইমাম গ্র“প। চট্টগ্রামের টেরিবাজারে পাইকারি কাপড় ব্যবসা, মার্কেট ও হোটেল আল ইমাম দিয়ে তার যাত্রা শুরু। এরপর ইমাম বাটনসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানেও ঝোঁকেন তিনি। ইমাম বাটন শেয়ারবাজার থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা এখন ভালো নয়।
এরপর মোহাম্মদ আলীর মধ্যে ঢুকে পড়ে জমি ও বাড়ি কেনার ঝোঁক। ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন শিল্প-কারখানা বা বাণিজ্যের নামে। কিন্তু ঋণের টাকা শিল্প-কারখানা বা ব্যবসায় না লাগিয়ে কিনেছেন একের পর এক ভেজাল জমি, ভবন। বিশ্বস্ত কাউকে সরকারি পরিত্যক্ত ভবনের মালিক সাজিয়ে তার কাছ থেকে ভুয়া দলিলমূলে নিজে মালিক হয়েছেন। এ নিয়ে মামলায় সরকার পক্ষকে ম্যানেজ করে রায় নিজের অনুকূলে নিয়ে ভবন দখল করেছেন। বেসরকারি কোনো জমি বা ভবন নিয়ে অনেক পক্ষের মধ্যে বিরোধ রয়েছে এ ধরনের জমি বা ভবন তিনি কিনে নিয়েছেন। সেসব জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে আবার বড় অংকের ঋণ নিয়ে তা দিয়ে কিনেছেন নতুন জমি। আগে জমি বা ভবন কেনার দু-চার বছর পর তার মূল্য তিন-চার গুণ বেড়ে যেত। তা বিক্রি করে লাভবান হতেন তিনি। কিন্তু শেয়ারবাজারে ধস, ইউনিপে কেলেংকারিসহ অর্থনীতির বেহাল অবস্থায় জমি ব্যবসায়ও ধস নামে। জমির দাম কমে যায়। ক্রেতার সংকট দেখা দেয়। তখন থেকেই ইমাম গ্র“পের সংকটও তীব্র হতে থাকে। একে একে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপির তালিকায় এ গ্র“পের নাম উঠতে থাকে। খেলাপির কারণে নতুন ঋণ পাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গ্র“পের সংকট ঘনীভূত হয়।
যেসব ব্যাংকে জালিয়াতি : সোনালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। ভিজিলেন্স বিভাগের তদন্তে ওই সময়ে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ূন কবীরকে ‘উপরি’ দিয়ে কোনো নিয়ম-কানুনের প্রতিপালন ছাড়াই ওই টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। নামে-বেনামে এর বেশির ভাগই নিয়েছে ইমাম গ্র“প। গ্র“পের ইমাম ট্রেডার্সকে ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা এলসির বিপরীতে এবং ৭৫ কোটি টাকা এলটিআর।
গ্রাহক ঋণের জন্য ব্যাংকে কোনো আবেদন করেনি অথচ প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ অনুমোদন হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত জামানত নেই, ঋণের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যবহারের ফলে এখন ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।
একই শাখা থেকে মনোয়ারা ট্রেডিংয়ের নামে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এটি ইমাম গ্র“পের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বলে সোনালী ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। ব্যাংকের নথিতে এর যে ঠিকানা উল্লেখ আছে, সে ঠিকানায় এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। এরকম আরও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ইমাম গ্র“প ঋণ নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও মোহাম্মদ আলী এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গ্র“পের নামে যখন ঋণ অনুমোদন করা হয় তখন বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল। নিয়ম অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের ঋণ অনুমোদনের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে ছাড়পত্র নিতে হয় যে, তিনি বা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খেলাপি নয়। খেলাপি ঋণ থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া যায় না। ইমাম গ্র“পকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। ফলে খেলাপি হয়েও গ্র“পটি নতুন ঋণ পেয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ইমাম গ্র“প একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আÍসাৎ করেছে। এর মধ্যে ১৪ কোটি টাকা পরিশোধ করার দাবি জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী। তার হিসাবে টাকার অংক আরও কম। ব্যাংক বেশি দেখাচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম (বর্তমানে খাতুনগঞ্জ শাখায় দায়িত্বরত) জানান, মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে ১৪৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যে অর্থঋণ আদালতে একাধিক মামলা করা হয়েছে। ঋণের বিপরীতে মোহাম্মদ আলী যেসব জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখেছেন তার দলিলপত্রে বিস্তর ভেজাল রয়েছে। মোহাম্মদ আলী চট্টগ্রাম শহরে ও গ্রামে প্রচুর জমি-বাড়ি কিনেছেন, মার্কেট বানিয়েছেন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থে। এভাবে প্রচুর সম্পত্তি কিনলেও অধিকাংশ জমি ও বাড়ির দলিলপত্রে ভেজাল থাকায় এবং দাম কমে যাওয়ায় তা এখন বিক্রিও করতে পারছেন না। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকের দেনা শোধ করতে না পেরে তিনি এখন ব্যবসা রেখে মামলা মোকদ্দমাতেই ব্যস্ত।
অগ্রণী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আ ম ম শাহজাহান জানান, মোহাম্মদ আলীর কাছে এখন তাদের পাওনা ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ঋণ ছিল ৩ কোটি টাকা। টাকা আদায়ে ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এদিকে মোহাম্মদ আলীও ব্যাংকের এমডি, ডিএমডিসহ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেছেন। তার অভিযোগ, ব্যাংক তার কাছে অত্যধিক টাকা দাবি করছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক চট্টগ্রামের ষোলোশহর শাখা থেকে ইমাম গ্র“প বিভিন্ন ভাবে আÍসাৎ করেছে ১০২ কোটি টাকা। দুদকের অনুসন্ধানে এ তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এর সঙ্গে ব্যাংকের ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে। গ্র“পের আনিকা এন্টারপ্রাইজ এই শাখা থেকে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ না করায় খেলাপি হয়। পরে তা ১১৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এরপর তা তিনবার নবায়ন করা হয়। এই ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধক দেয়া হয় ৪ দশমিক ২১৮৩ একর জমি। যার মূল্য মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এ জমিতে রয়েছে ভেজাল। দুই একর জমি মোহাম্মদ আলীর নামে নামজারিই হয়নি। মূলত ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এ ঋণ দেয়া হলেও ব্যাংক এই ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো নিয়ম-কানুন মানেনি। এ নিয়ে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলতেও রাজি হননি।
ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকেও আমদানির বিপরীতে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না ইমাম গ্র“প। শর্ত ছিল পণ্য আমদানির পর তা বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করে দেয়া হবে। কিন্তু ইমাম গ্র“প তা শোধ করেনি। ফলে গ্র“পের কাছে ব্যাংক প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি টাকাও পরিশোধ করার জন্য আলোচনা করছে।
এক্সিম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় থাকা ঋণের বিপরীতে মাত্র ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পরিশোধের ব্যাপারে ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
প্রাইম ব্যাংকের আগ্রাবাদ জুবিলী রোড শাখায় ও আগ্রাবাদ শাখায় অর্ধশত কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। মোহাম্মদ আলীর মতে ব্যাংক ঋণের টাকা বেশি দেখাচ্ছে। দুই শাখা বর্তমানে তার কাছে ৪৭ কোটি টাকার মতো পাবে। ওই টাকার বিপরীতে ব্যাংকে তার জামানতের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। এদিকে প্রাইম ব্যাংক সূত্র জানায়, জামানতের পরিমাণ আরও কম।
ব্যাংক এশিয়ার আগ্রাবাদ শাখায় ইমাম গ্র“পের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ১৮ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে ব্যাংক মামলা করেছে। মোহাম্মদ আলীর দাবি ব্যাংক তার কাছে পাবে ১৪ কোটি টাকা।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় বকেয়ার পরিমাণ ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করার ব্যাপারে তিনি ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে যুগান্তরকে জানান।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। ব্যাংকে জামানত দিয়েছেন প্রায় ৭১ কোটি টাকার। ব্যাংকের দাবি জামানতের পরিমাণ কম। ঋণের টাকা আরও বেশি।
মোহাম্মদ আলীর হিসাবে ঢাকা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ৭ কোটি টাকা বকেয়ার মধ্যে ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য আলোচনা করছেন।
এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ ও জুবলি রোড শাখায় দুটি ঋণ রয়েছে ইমাম গ্র“পের। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ ব্যাংক এই দাবি করছে। মোহাম্মদ আলী দাবি করেছেন, এবি ব্যাংক তার কাছে পাবে প্রায় ১৩ কোটি টাকার মতো।
উত্তরা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় গ্র“পের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৪৫ কোটি টাকা। গ্রাহক ৪০ কোটি টাকা চার বছরে পরিশোধ করতে সম্মত। ব্যাংক সুদসহ চাইছে ৪৩ কোটি টাকা। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) জুবলি রোড শাখা পাবে ২০ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে ব্যাংক ইতিমধ্যেই মামলা করেছে।
এর আগে বেসরকারি খাতের এনসিসি, ন্যাশনাল ও ওয়ান ব্যাংকে ওম প্রকাশ আগারওয়াল ও গিরিধারী লাল মোদির ঋণ কেলেংকারির ঘটনায় ৩০০ কোটি টাকা আÍসাৎ করা হয়েছিল। ওই ঘটনার সঙ্গেও মোহাম্মদ আলীর যোগসূত্র ছিল। তখন তিনি এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তিনি পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এখন এনসিসি ব্যাংকে তার শেয়ার তার ছেলের নামে রয়েছে।
No comments:
Post a Comment