হাল্লাজ এবং দ্রৌপদীর বিলাপ
মনসূর হাল্লাজের বিলাপ
আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে মরুপথের যাত্রী, কিন্তু তাদের যাত্রাপথের কোনো চিহ্ন নেই কিংবা জল সিঞ্চনের জন্য নেই কোনো কুয়া, যেন বিলুপ্ত নগরী ইরাম ! অতঃপর পদদলিত হয়েছে পরিত্যক্ত জনতা; যেন পশুর মতো অন্ধ, যেন মাদি-উটের থেকেও অন্ধতর। হে আল্লাহ্, আপনাকে ভালোবেসে আমাকে হতে হয়েছে অবরুদ্ধ, কারাবাসপ্রাপ্ত, বেত্রাঘাতপ্রাপ্ত; ফাঁসির রজ্জুতে উত্তোলিত হবার আগে কর্তিত হয়েছে আমার পা, আমার হাত । আমার নিঃসাড় দেহকে করা হয়েছে ভস্মীভূত; আমার দেহভস্ম এখনও উড়ছে মরুভুমির বাতাসে এবং অসংখ্যবার দোল খেয়ে চলছে সাগরের লোনা জলে। হে খোদা- যে পাপী, আপনি তাকেও দিয়েছেন অনুগ্রহ, কিন্তু আমার দেহভস্ম, আমার শরীরের এই ছাই, ঘৃতকুমারীর মতো যা প্রশংসায় ধাবিত হয়েছে আপনার দিকে, কিন্তু আপনি থেকেছেন নিস্ক্রিয়, নিঃশ্চুপ। আমার দেহের এই রূপান্তর, হয়তো, এই পৃথিবীতে রেখে যাবে স্থায়ী ছাপ, যা পাহাড়ের থেকেও হবে দৃঢ় !
হে আমার আত্মার মাধুর্যের কবি, বিপুল তরঙ্গের গর্জনশীল নদী, তাইগ্রীসের মতো আপনি এখনও প্রবাদপ্রতীম, নিজস্ব অস্তিত্বে দীপ্যমান, আপনার বিলাপ এখনও শ্রুতিগোচর। আপনি তো চেয়েছিলেন সকল গন্তব্যের বাইরে গিয়ে শাশ্বতের সাক্ষ্য দিতে, কিন্তু আপনার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আমরা হয়ে উঠি ক্রন্দনশীল, আমাদের হৃদয় ভারাতুর। দেখেছি আপনাকে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের শীর্ষবিন্দুতে, যেভাবে সুউচ্চ পাহাড় থেকে দেখি আমরা এই জগতকে, কিন্তু আপনার আত্মার সত্য আজো হয়নি উদ্ভাসিত, যেভাবে আল্লাহ্কে বুঝিনি আমরা ; আমাদের অলস কলিজায় ফুটে উঠে না আল্লাহ্র শতাধিক নাম। পৃথিবীর বুকে শুধু কুয়াশাই জেগে আছে।
সুফি কবি, আপনার মৃত্যুর কারণ একাধিক! প্রথমত, আপনি তো মাতা মেরীর সন্তানের মতো মৃত্যুই আকাঙ্ক্ষা করেছেন। আরাফাতের ময়দানে অনেক পাপীদের শাস্তির পরিবর্তে চেয়েছেন নিজের বলিদান, সুতরাং আজ আর ক্রন্দন নয়; দ্বিতীয়ত, আপনি বলেছেন, মক্কা নগরীর বাহিরেও হজ্জ সম্ভব, সুতরাং আজ আপনার ক্রন্দন অর্থহীন। তৃতীয়ত, জেনেছি কোনো কোনো সুফিসাধক হয়েছে আপনার বিরুদ্ধগামী। সকল সংঘই বিরোধকে করে আভাষিত, তাঁকে করে উচ্চকিত। হে সুফি কবি, আপনি আপনার মৃত্যুকে ত্বরাণ্বিত করেছেন; সুতরাং, নিরর্থক এই ক্রন্দন । চতুর্থ, আল্লাহ্র একটি নামের মাধুর্যকে আপনি কোনো এক অলৌকিকতায় নিজের করে নিয়েছেন! আল্লাহ্ হয়েছেন ক্রুদ্ধ; বোধকরি, তিনি নন দয়ালু । শেষাবধি, আপনি বলেছেন, “আমি সত্য ; আমিই ঈশ্বর!” হে আমার প্রিয় কবি, কেউ জানেনি ঈশ্বরকে; কিন্তু সবাই নিয়েছেন তাঁর মালিকানা। তাই এতো প্রফেট, তাই এতো ধর্মযুদ্ধ । ধর্মযুদ্ধের মতো আপনার মৃত্যুকেও আমি স্বাভাবিক জেনেছি।
প্রবহমান তাইগ্রীসের মতো আজও আপনি গর্জনশীল, আর আমি শুধু তার ক্ষীয়মাণ দূরাগত ধ্বনি!
দ্রৌপদীর বিলাপ
এই জীবন নয় হস্তিনাপূরের রাজসভায় দ্যূতক্রীড়া; কিংবা নয় যাজ্ঞসেনী ধ্রূপদকণ্যার বিলাপ! তবু মহাকালব্যাপী রৌদ্র আর মেঘ জুড়ে মঞ্চস্থ হতে থাকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ব্যর্থ পালা আর কিশোর-যোদ্ধা-অভিমন্যুর বীরগাথা। পৃথিবীর সব নারীদের অশ্রু ঝরে পড়ার মধ্যে যে বিষাদগাথা, তাকে আমি ‘দ্রৌপদীর বিলাপ’ নামে জেনেছি!
“আমাকে স্পর্শ করবেন না, রাজমাতা কুন্তী! আমি মলিন হয়ে যাব। এখন আমি আর আপনার পুত্রবধূ নই, আপনার পুত্রদের পত্নী নই, কুরুবংশের কুলবধূ নই। এখন আমি নামহীন, পতিহীন, এবং বংশহীন হয়ে গেছি। আমি তো মানুষ নই, আমি বনবাসির উনুনে জ্বলা আগুন; স্বয়ং শুদ্ধ আমি কিন্তু পৃথিবীর সব অশুদ্ধির উপরে আমার বাস!” [১]
অশ্রুনদীর ভিতরে, বোধকরি, এই জীবনের উদ্বোধন, আর জীবনব্যাপী যেন তারই ব্যাপ্তি। মানুষ কি মানুষকে কাঁদায় না কি এই কান্না নির্দেশ করে সময়ের সাথে মানুষের অনিঃশেষ দ্বৈরথ, যেখানে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে জলমগ্ন হবার স্মৃতি, উদ্বাস্তু মানুষের স্বদেশভূমি প্রস্থান, জীবনের বৃত্তে আমাদের অপমান তবু জীবনচক্রে পুনারপি ফিরে আসা, আর মনে রাখা মৃতের তালিকা, যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে! দেশান্তরী নৌকা যত দূরগামী হয়, জীবনের গল্প যেন তত পল্লবিত হয়ে উঠে! তবু ভাবি, জীবনের দীর্ঘসূত্রিতা আর কান্না কি আবর্তনশীল জলের মতো ঘুরে ঘুরে আসে ?
আমার সকল শরীর কেবল ক্রন্দন হয়ে জেগে উঠে, কিন্তু আমি তার অর্থ বুঝি না। নশ্বর ফুলের মতো এই জীবন, তাই হৃদয় ঈশ্বরমুখ-দর্শন-অভিলাষী ! বনবাসী, প্রান্তিক মানুষ আমি। রাতের গভীরে উনুনের আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকি; দেখি আগুন গভীরতর ঐক্যে বাঁধছে এই আকাশ আর এই মাটিকে। মনে পড়ছে পিতৃমুখ, মনে পড়ছে পূর্ব-জন্মের-স্মৃতি, মনে পড়ছে যুদ্ধ হয়েছিল এই বাংলায় ।
এখন মধ্যরাত । শান্ত দীঘির জলে, ঈশ্বরের মুখ নয়, নিতান্তই আকাশের ছায়া পরিদৃশ্যমান, যেখানে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পালা আর কিশোর-যোদ্ধা-অভিমন্যুর বীরগাথা !
[১] হস্তিনাপূরের রাজসভায় পাশাখেলা শেষে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে ব্যর্থ দুঃশাসন যখন ক্লান্ত, তখন রাজমাতা কুন্তী এবং মহারাণী গান্ধারীর প্রবেশ, ঠিক তখন সন্ত্রস্থ এবং উন্মাদিনী যাজ্ঞসেনী ধ্রূপদকণ্যা দ্রৌপদী বিলাপ শেষে রাজসভায় উপস্থিত সকলের প্রতি তিনি অভিশাপ দিতে উদ্যত। ‘ষ্টার জলসায়’ বর্তমানে সম্প্রচারিত হচ্ছে মহাকাব্য, ‘মহাভারত !’
No comments:
Post a Comment