রাজ্যে এগিয়ে তৃণমূল, ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ মোদীকার ঝুলিতে কত ভোট, রহস্য সেটাই
সুমন চট্টোপাধ্যায়
হয়তো অত্যুক্তি হবে না, যদি বলি, দেশের নির্বাচনের চেয়েও এ বার পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ভোট অনেক চিত্তাকর্ষক হবে৷ এত দিনে এটা পরিষ্কার, বাকি সব প্রতিপক্ষকে পিছনে ফেলে নরেন্দ্র দামোদর মোদী সাউথ ব্লকে পৌঁছনোর দৌড়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছেন, এ বার শুধু দড়ি ছোঁয়ার প্রতীক্ষা৷ ভোটের পালা সাঙ্গ হলে গরিষ্ঠতার জন্য নতুন কয়েকটি শরিকও সম্ভবত তিনি পেয়ে যাবেন৷
বিজেপি-র আসন সংখ্যা দু'শো-সোয়া দু'শোয় পৌঁছলে আগে কেবা প্রাণ করিবেক দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে জগন-চন্দ্রশেখর-জয়ললিতা-করুণানিধিদের মধ্যে৷ এমনকী কংগ্রেসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত শরিক এনসিপিও যে সেই তালিকায় শেষ মুহূর্তে ঢুকে পড়তে পারে, স্বয়ং শারদ পাওয়ার বারে বারে সেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গায় মোদীকে উপযাচকের মতো ক্লিন-চিট দিয়ে৷ সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে নয়া দিল্লিতে মোদীর নেতৃত্বে পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত৷
তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল কী দাঁড়াবে সেই ছবিটা রীতি মতো অস্পষ্ট৷ সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তৃণমূল কংগ্রেস যে একক বৃহত্তম দল হয়েই উঠে আসবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ প্রশ্ন সেই সাফল্যের বহর নিয়ে৷ ১৯৭৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে বামপন্থীরা লোকসভার ভোটে (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ১৯৮৪-র ভোট, যখন ইন্দিরার প্রতি সহানুভূতির ঝোড়ো হাওয়ায় অবিভক্ত কংগ্রেস অপ্রত্যাশিত ভাবে ১৬টি আসনে জিতে গিয়েছিল) যে রকম নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, একক ক্ষমতায় পারবে কি তৃণমূল তার সমতুল্য ফল করতে? যদি না পারে তা হলে রাজ্য-রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে কতটা? সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলি পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল নিয়ে যে সব জনমত সমীক্ষা করেছে তাতেও প্রতিফলিত হচ্ছে না মতৈক্য৷ কেউ বলছে তৃণমূল পাবে কুড়িটি আসন, কেউ বলছে পঁচিশটি, কেউ আবার বত্রিশটি আসনও তাদের দিয়ে দিয়েছে৷ এর অর্থ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল যে পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটের ফলাফলের চেয়ে খারাপ কিছু করবে না সে ব্যাপারে সব মুনিই এক মত৷ বিভ্রান্তি তার চেয়ে কতটা ভালো ফল করতে পারে তা নিয়ে৷
বিভ্রান্তির সবচেয়ে বড়ো কারণ একক ভাবে কোন শিবিরের ঠিক কত ভোট, তার জেলাওয়াড়ি অথবা কেন্দ্র-ওয়াড়ি বিন্যাসের ছবিটাই বা কী রকম, ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করার পরে বাংলার মাটিতে কখনও তার পরীক্ষা হয়নি৷ এ বারের চতুর্মুখী লড়াইয়ে হবে সেই অদৃষ্টপূর্ব, গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা৷ যে পরিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়ায় সওয়ার হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীদের কাছ থেকে রাজ্যপাট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, তিন বছর পরে এ বার তাঁর সামনে এবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার স্রোত রুখে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ৷ তার চেয়েও বড়ো কথা, তাঁর তিন প্রতিপক্ষের শক্তি সত্যিই কোথায় কতটা এবং তা দিয়ে তারা তৃণমূলের জয়যাত্রা কোথায় কতটা রুখে দিতে পারে সেই ছবিটাও অনেকটাই এলোমেলো৷ কমতে কমতে বামেদের ভোট কোথায় কতটা কমে এসে দাঁড়িয়েছে, সাইনবোর্ড হতে হতেও কোথায় কোথায় কংগ্রেস তৃণমূলের বাড়া ভাতে ছাই ঢালার ক্ষমতা ধরে, কিংবা 'হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী'-র স্লোগানে কে কোথায় কতটা মজে বসে আছে, কোনও সেফোলজিস্টের পক্ষে তার সঠিক সুলুক সন্ধান পাওয়াটা অসম্ভব৷ সেই কারণেই বাংলার ভোট এ বার যতটা রহস্যজনক প্রায় ততটাই মজার৷ আর তাই চার শিবিরের প্রধান কুশীলবেরাই ভোটের পাটিগণিত মেলাতে গিয়ে যে যার মতো করে হিমশিম খাচ্ছেন!
দু'টি জাতীয় দলের কোনও একটির সঙ্গে জোট বেঁধে ভোট করার অতীতের অভ্যাস থেকে সরে এসে মমতা যে এ বার একলা চলার ঝুঁকি নিয়েছেন তা অনেকটাই পরিকল্পিত৷ স্পষ্টতই এমন একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল দেখেই৷ গ্রামের এই ভোটে একক ভাবে লড়ে তৃণমূল শুধু যে পরের পর জেলা-পরিষদ গঠন করতে পেরেছিল তাই নয়, প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷ এটা এমন সাফল্য যা বাম জমানাতে সিপিএমও পায়নি৷ এই ভোটটা রক্ষা করতে পারলেই অন্তত ২৭-২৮টি লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় এক রকম নিশ্চিত৷ বাকি ৫৬ শতাংশ ভোট তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে, ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোল-এর নিয়মানুসারে তৃণমূলেরই একচেটিয়া আধিপত্য থাকার কথা৷ কোচবিহার থেকে নামখানা, পঞ্চায়েতের এই আশাতীত সাফলকে ধরে রাখাটাই তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ৷
তা হলে সমস্যাটা কোথায়? যে সমস্যাটির কথা তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত আলোচনায় হাসতে হাসতে কবুল করেন অথচ প্রত্যাশিত ভাবেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না তা হল সাফল্যের পাত্রে কতটা দুধ আর কতটা জল তা তাঁরা নিজেরাই ভালো করে জানেন না৷ ফলে ভোটের অংশীদারিত্বের সরকারি অঙ্কটায় নানাবিধ গোঁজামিল তাঁদের দুর্ভাবনা কমাতে পারছে না৷ বরং তাঁদের দুর্ভাবনা বাড়ছে এই কথা ভেবে যে পঞ্চায়েতের মডেলে লোকসভায় ভোট হবে না, হওয়া সম্ভবও নয়৷ সে ক্ষেত্রে কোথাকার জল কোথায় গড়াতে পারে তার আগাম আন্দাজ পাওয়াটাও সম্ভব নয়৷ অবশ্য পঞ্চায়েত ভোটের পরেও দলীয় আধিপত্য আরও সুদূর-প্রসারী করার কাজে তৃণমূল নেতৃত্ব একেবারেই ঢিলে দেননি৷ গত কয়েক মাসে জেলার পর জেলায় যে ভাবে পঞ্চায়েতের প্রায় প্রতিটি স্তরে বামপন্থীরা লাল-ঝাণ্ডা ফেলে দলে দলে ঘাস-ফুলে এসে মিশেছেন, তার সঠিক হিসেব কারও কাছে নেই৷ একই কথা প্রযোজ্য প্রায় সব জেলায় কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রেও৷ পঞ্চায়েত ভোটের পরে নতুন করে এই মিত্র-শক্তির ব্যাপক অনুপ্রবেশ তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে অবশ্যই একটি বড়ো রক্ষা-কবচ৷ তাঁরা আশা করছেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কাজে জেলায় জেলায় তাঁরা এতটাই অগ্রসর হয়ে রয়েছেন যে পঞ্চায়েত ভোটের জল অনেকটাই ছেঁটে ফেলা সম্ভব হয়েছে৷ অনুমানটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এ কথা বলা যাবে না৷ ঠিক যেমন এ কথাও বলা যাবে না কতটি অভ্রান্ত এই অনুমান৷ দুধ কা দুধ আর পানি কা পানি হয়ে যাওয়ার পরে ছবিটা কী দাঁড়াল তা বোঝার জন্য ১৬ মে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই৷
আবার পঞ্চায়েত ভোটের মানদণ্ডেই বিচার করলে কংগ্রেস নামক অবশিষ্ট 'উপদ্রবের' খোঁচাটাও তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব ঠিক মেপে উঠতে পারছেন না৷ কেননা রাজ্যের দশটি জেলায় পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল অনুসারেই কংগ্রেসের সাড়ে পাঁচ শতাংশ থেকে চল্লিশ শতাংশ ভোট এখনও রয়ে গিয়েছে৷ যেমন দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, নদীয়া এবং পুরুলিয়ায় কংগ্রেসের ভোট এখনও চতুর্মুখী লড়াইয়ে শাসকদের বেগ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট৷ বীরভূমে কংগ্রেসের ভোট আছে পনেরো শতাংশ, নদীয়ায় প্রায় পনেরো শতাংশ এবং পুরুলিয়ায় প্রায় তেরো শতাংশ৷ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারেও কংগ্রেসের ভোট রয়ে গিয়েছে যথাক্রমে দশ ও নয় শতাংশ৷ এই অঙ্কের বিচারেই অন্তত আটটি লোকসভা আসনে কংগ্রেসের ভোট প্রধান দুই প্রতিপক্ষের লড়াইটাকে উত্তেজনার উত্তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেই৷ শাসক দলের কাছে এ রাজ্যে কংগ্রেস হল, 'মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী'!
বৈরী কিন্তু চেনা৷ সিপিএম অথবা কংগ্রেসকে কী ভাবে ঠেকাতে হয় এত দিনে তা বিলক্ষণ শিখে গিয়েছে তৃণমূল৷ কিন্তু এ বারের লোকসভা ভোটে তো নরেন্দ্র মোদী নামের এক অচেনা বৈরী ছায়া ফেলেছে এ রাজ্যের ভোটের উপরেও৷ যত দিন যাচ্ছে সেই ছায়া রাজ্যের অনেক জেলায় দীর্ঘ থেকে হচ্ছে দীর্ঘতর৷ এ ল্যাঠা গত লোকসভা অথবা বিধানসভা ভোটে ছিল না, ছিল না পঞ্চায়েত ভোটেও৷ কেন্দ্রে বিজেপির সরকার গড়ার সম্ভাবনাই বাকি সকলের চেয়ে অনেক বেশি এই প্রচার ক্রমশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে অনেক বঙ্গজনের কাছেই৷ এক গুজরাতি সন্তানের আবেদনকেও আর অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না কিছুতেই৷ একের পর এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মতো খরচের খাতায় থাকা রাজ্যেও পনেরো-ষোলো শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ভোট পেতে পারে৷ তার মানে এ যাবত্ সর্বোচ্চ৷ গেরুয়া শিবিরের পৌষ মাসে কোথায় কার কতটা সর্বনাশ অনেকটা যেন তার উপরেই নির্ভর করছে এ রাজ্যে লোকসভা ভোটের গতি-প্রকৃতি৷ বাজপেয়ীর জমানায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে এ রাজ্যে দু'টি লোকসভা আসনে জিতেছিল বিজেপি৷ এ বার একক ভাবে লড়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাজ্যের তেরোটি জেলায় অন্তত ১৮টি আসনে এ দল বাকিদের অঙ্ক এবার গুলিয়ে দিতে পারে৷ এই আসনগুলি যে সব জেলায় আছে সেগুলি হল জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম এবং বাঁকুড়া৷ এ ছাড়া উত্তর কলকাতা কেন্দ্রেও বিজেপির ভোট শেষ পর্যন্ত নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ সব কিছুর ঊর্ধ্বে মোদীর জয়ধবনিকে পাথেয় করে বিজেপি এ বার যতটা কোমর বেঁধে, নানা কেন্দ্রে তারকা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে বাংলায় শিকড়ের সন্ধানে নেমেছে অতীতে কখনও কোনও নির্বাচনে তাদের এই তত্পরতা চোখে পড়েনি৷ নরেন্দ্র মোদীর লাড্ডুর প্ররোচনায় তৃণমূল নেত্রী পা দেবেন না পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরে বিজেপিও মনে করছে 'হাম কিসিসে কম নেহি!' এ বারের ভোটে তার মানে মোদীই হয়ে উঠতে পারেন এক্স ফ্যাক্টর৷ হ্যাঁ, এই দুর্জয় ঘাঁটি, বাংলার মাটিতেও৷
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-edit-by-suman-chatterjee/articleshow/32286818.cms
সুমন চট্টোপাধ্যায়
হয়তো অত্যুক্তি হবে না, যদি বলি, দেশের নির্বাচনের চেয়েও এ বার পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ভোট অনেক চিত্তাকর্ষক হবে৷ এত দিনে এটা পরিষ্কার, বাকি সব প্রতিপক্ষকে পিছনে ফেলে নরেন্দ্র দামোদর মোদী সাউথ ব্লকে পৌঁছনোর দৌড়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছেন, এ বার শুধু দড়ি ছোঁয়ার প্রতীক্ষা৷ ভোটের পালা সাঙ্গ হলে গরিষ্ঠতার জন্য নতুন কয়েকটি শরিকও সম্ভবত তিনি পেয়ে যাবেন৷
বিজেপি-র আসন সংখ্যা দু'শো-সোয়া দু'শোয় পৌঁছলে আগে কেবা প্রাণ করিবেক দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে জগন-চন্দ্রশেখর-জয়ললিতা-করুণানিধিদের মধ্যে৷ এমনকী কংগ্রেসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত শরিক এনসিপিও যে সেই তালিকায় শেষ মুহূর্তে ঢুকে পড়তে পারে, স্বয়ং শারদ পাওয়ার বারে বারে সেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গায় মোদীকে উপযাচকের মতো ক্লিন-চিট দিয়ে৷ সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে নয়া দিল্লিতে মোদীর নেতৃত্বে পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত৷
তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল কী দাঁড়াবে সেই ছবিটা রীতি মতো অস্পষ্ট৷ সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তৃণমূল কংগ্রেস যে একক বৃহত্তম দল হয়েই উঠে আসবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ প্রশ্ন সেই সাফল্যের বহর নিয়ে৷ ১৯৭৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে বামপন্থীরা লোকসভার ভোটে (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ১৯৮৪-র ভোট, যখন ইন্দিরার প্রতি সহানুভূতির ঝোড়ো হাওয়ায় অবিভক্ত কংগ্রেস অপ্রত্যাশিত ভাবে ১৬টি আসনে জিতে গিয়েছিল) যে রকম নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, একক ক্ষমতায় পারবে কি তৃণমূল তার সমতুল্য ফল করতে? যদি না পারে তা হলে রাজ্য-রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে কতটা? সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলি পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল নিয়ে যে সব জনমত সমীক্ষা করেছে তাতেও প্রতিফলিত হচ্ছে না মতৈক্য৷ কেউ বলছে তৃণমূল পাবে কুড়িটি আসন, কেউ বলছে পঁচিশটি, কেউ আবার বত্রিশটি আসনও তাদের দিয়ে দিয়েছে৷ এর অর্থ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল যে পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটের ফলাফলের চেয়ে খারাপ কিছু করবে না সে ব্যাপারে সব মুনিই এক মত৷ বিভ্রান্তি তার চেয়ে কতটা ভালো ফল করতে পারে তা নিয়ে৷
বিভ্রান্তির সবচেয়ে বড়ো কারণ একক ভাবে কোন শিবিরের ঠিক কত ভোট, তার জেলাওয়াড়ি অথবা কেন্দ্র-ওয়াড়ি বিন্যাসের ছবিটাই বা কী রকম, ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করার পরে বাংলার মাটিতে কখনও তার পরীক্ষা হয়নি৷ এ বারের চতুর্মুখী লড়াইয়ে হবে সেই অদৃষ্টপূর্ব, গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা৷ যে পরিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়ায় সওয়ার হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীদের কাছ থেকে রাজ্যপাট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, তিন বছর পরে এ বার তাঁর সামনে এবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার স্রোত রুখে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ৷ তার চেয়েও বড়ো কথা, তাঁর তিন প্রতিপক্ষের শক্তি সত্যিই কোথায় কতটা এবং তা দিয়ে তারা তৃণমূলের জয়যাত্রা কোথায় কতটা রুখে দিতে পারে সেই ছবিটাও অনেকটাই এলোমেলো৷ কমতে কমতে বামেদের ভোট কোথায় কতটা কমে এসে দাঁড়িয়েছে, সাইনবোর্ড হতে হতেও কোথায় কোথায় কংগ্রেস তৃণমূলের বাড়া ভাতে ছাই ঢালার ক্ষমতা ধরে, কিংবা 'হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী'-র স্লোগানে কে কোথায় কতটা মজে বসে আছে, কোনও সেফোলজিস্টের পক্ষে তার সঠিক সুলুক সন্ধান পাওয়াটা অসম্ভব৷ সেই কারণেই বাংলার ভোট এ বার যতটা রহস্যজনক প্রায় ততটাই মজার৷ আর তাই চার শিবিরের প্রধান কুশীলবেরাই ভোটের পাটিগণিত মেলাতে গিয়ে যে যার মতো করে হিমশিম খাচ্ছেন!
দু'টি জাতীয় দলের কোনও একটির সঙ্গে জোট বেঁধে ভোট করার অতীতের অভ্যাস থেকে সরে এসে মমতা যে এ বার একলা চলার ঝুঁকি নিয়েছেন তা অনেকটাই পরিকল্পিত৷ স্পষ্টতই এমন একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল দেখেই৷ গ্রামের এই ভোটে একক ভাবে লড়ে তৃণমূল শুধু যে পরের পর জেলা-পরিষদ গঠন করতে পেরেছিল তাই নয়, প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷ এটা এমন সাফল্য যা বাম জমানাতে সিপিএমও পায়নি৷ এই ভোটটা রক্ষা করতে পারলেই অন্তত ২৭-২৮টি লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় এক রকম নিশ্চিত৷ বাকি ৫৬ শতাংশ ভোট তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে, ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোল-এর নিয়মানুসারে তৃণমূলেরই একচেটিয়া আধিপত্য থাকার কথা৷ কোচবিহার থেকে নামখানা, পঞ্চায়েতের এই আশাতীত সাফলকে ধরে রাখাটাই তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ৷
তা হলে সমস্যাটা কোথায়? যে সমস্যাটির কথা তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত আলোচনায় হাসতে হাসতে কবুল করেন অথচ প্রত্যাশিত ভাবেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না তা হল সাফল্যের পাত্রে কতটা দুধ আর কতটা জল তা তাঁরা নিজেরাই ভালো করে জানেন না৷ ফলে ভোটের অংশীদারিত্বের সরকারি অঙ্কটায় নানাবিধ গোঁজামিল তাঁদের দুর্ভাবনা কমাতে পারছে না৷ বরং তাঁদের দুর্ভাবনা বাড়ছে এই কথা ভেবে যে পঞ্চায়েতের মডেলে লোকসভায় ভোট হবে না, হওয়া সম্ভবও নয়৷ সে ক্ষেত্রে কোথাকার জল কোথায় গড়াতে পারে তার আগাম আন্দাজ পাওয়াটাও সম্ভব নয়৷ অবশ্য পঞ্চায়েত ভোটের পরেও দলীয় আধিপত্য আরও সুদূর-প্রসারী করার কাজে তৃণমূল নেতৃত্ব একেবারেই ঢিলে দেননি৷ গত কয়েক মাসে জেলার পর জেলায় যে ভাবে পঞ্চায়েতের প্রায় প্রতিটি স্তরে বামপন্থীরা লাল-ঝাণ্ডা ফেলে দলে দলে ঘাস-ফুলে এসে মিশেছেন, তার সঠিক হিসেব কারও কাছে নেই৷ একই কথা প্রযোজ্য প্রায় সব জেলায় কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রেও৷ পঞ্চায়েত ভোটের পরে নতুন করে এই মিত্র-শক্তির ব্যাপক অনুপ্রবেশ তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে অবশ্যই একটি বড়ো রক্ষা-কবচ৷ তাঁরা আশা করছেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কাজে জেলায় জেলায় তাঁরা এতটাই অগ্রসর হয়ে রয়েছেন যে পঞ্চায়েত ভোটের জল অনেকটাই ছেঁটে ফেলা সম্ভব হয়েছে৷ অনুমানটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এ কথা বলা যাবে না৷ ঠিক যেমন এ কথাও বলা যাবে না কতটি অভ্রান্ত এই অনুমান৷ দুধ কা দুধ আর পানি কা পানি হয়ে যাওয়ার পরে ছবিটা কী দাঁড়াল তা বোঝার জন্য ১৬ মে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই৷
আবার পঞ্চায়েত ভোটের মানদণ্ডেই বিচার করলে কংগ্রেস নামক অবশিষ্ট 'উপদ্রবের' খোঁচাটাও তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব ঠিক মেপে উঠতে পারছেন না৷ কেননা রাজ্যের দশটি জেলায় পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল অনুসারেই কংগ্রেসের সাড়ে পাঁচ শতাংশ থেকে চল্লিশ শতাংশ ভোট এখনও রয়ে গিয়েছে৷ যেমন দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, নদীয়া এবং পুরুলিয়ায় কংগ্রেসের ভোট এখনও চতুর্মুখী লড়াইয়ে শাসকদের বেগ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট৷ বীরভূমে কংগ্রেসের ভোট আছে পনেরো শতাংশ, নদীয়ায় প্রায় পনেরো শতাংশ এবং পুরুলিয়ায় প্রায় তেরো শতাংশ৷ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারেও কংগ্রেসের ভোট রয়ে গিয়েছে যথাক্রমে দশ ও নয় শতাংশ৷ এই অঙ্কের বিচারেই অন্তত আটটি লোকসভা আসনে কংগ্রেসের ভোট প্রধান দুই প্রতিপক্ষের লড়াইটাকে উত্তেজনার উত্তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেই৷ শাসক দলের কাছে এ রাজ্যে কংগ্রেস হল, 'মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী'!
বৈরী কিন্তু চেনা৷ সিপিএম অথবা কংগ্রেসকে কী ভাবে ঠেকাতে হয় এত দিনে তা বিলক্ষণ শিখে গিয়েছে তৃণমূল৷ কিন্তু এ বারের লোকসভা ভোটে তো নরেন্দ্র মোদী নামের এক অচেনা বৈরী ছায়া ফেলেছে এ রাজ্যের ভোটের উপরেও৷ যত দিন যাচ্ছে সেই ছায়া রাজ্যের অনেক জেলায় দীর্ঘ থেকে হচ্ছে দীর্ঘতর৷ এ ল্যাঠা গত লোকসভা অথবা বিধানসভা ভোটে ছিল না, ছিল না পঞ্চায়েত ভোটেও৷ কেন্দ্রে বিজেপির সরকার গড়ার সম্ভাবনাই বাকি সকলের চেয়ে অনেক বেশি এই প্রচার ক্রমশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে অনেক বঙ্গজনের কাছেই৷ এক গুজরাতি সন্তানের আবেদনকেও আর অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না কিছুতেই৷ একের পর এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মতো খরচের খাতায় থাকা রাজ্যেও পনেরো-ষোলো শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ভোট পেতে পারে৷ তার মানে এ যাবত্ সর্বোচ্চ৷ গেরুয়া শিবিরের পৌষ মাসে কোথায় কার কতটা সর্বনাশ অনেকটা যেন তার উপরেই নির্ভর করছে এ রাজ্যে লোকসভা ভোটের গতি-প্রকৃতি৷ বাজপেয়ীর জমানায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে এ রাজ্যে দু'টি লোকসভা আসনে জিতেছিল বিজেপি৷ এ বার একক ভাবে লড়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাজ্যের তেরোটি জেলায় অন্তত ১৮টি আসনে এ দল বাকিদের অঙ্ক এবার গুলিয়ে দিতে পারে৷ এই আসনগুলি যে সব জেলায় আছে সেগুলি হল জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম এবং বাঁকুড়া৷ এ ছাড়া উত্তর কলকাতা কেন্দ্রেও বিজেপির ভোট শেষ পর্যন্ত নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ সব কিছুর ঊর্ধ্বে মোদীর জয়ধবনিকে পাথেয় করে বিজেপি এ বার যতটা কোমর বেঁধে, নানা কেন্দ্রে তারকা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে বাংলায় শিকড়ের সন্ধানে নেমেছে অতীতে কখনও কোনও নির্বাচনে তাদের এই তত্পরতা চোখে পড়েনি৷ নরেন্দ্র মোদীর লাড্ডুর প্ররোচনায় তৃণমূল নেত্রী পা দেবেন না পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরে বিজেপিও মনে করছে 'হাম কিসিসে কম নেহি!' এ বারের ভোটে তার মানে মোদীই হয়ে উঠতে পারেন এক্স ফ্যাক্টর৷ হ্যাঁ, এই দুর্জয় ঘাঁটি, বাংলার মাটিতেও৷
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-edit-by-suman-chatterjee/articleshow/32286818.cms
No comments:
Post a Comment