ফকির ইলিয়াসের ‘চৈতন্যের চাষকথা’ অর্ন্তগত কালের কথন
জয়নাল আবেদীন শিবু
আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের বয়স খুব বেশি দিনের নয়। আধুনিক কালেই এর প্রকৃত জন্ম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এর জনক হিশেবে শিরোপা অর্জন করেন। অবশ্য এর পুর্বেও যে গল্প লেখা হয়নি তা নয়, হয়েছে ছোট ছোট গল্প লেখাÑ আধুনিক ছোটগল্পের মননে ও মেজাজে নয়। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক অগ্রজ লেখক স্বর্ণকুমারী ও নগেন্দ্রনাথ যে আঙ্গিকে গল্প লেখেছেন, কিশোর রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের গল্প তা থেকে খুব বেশি ভীন্ন ছিলো না। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকের গল্প ‘ভিখারিনী’, ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ লেখে দেখলেন তাঁর গল্প আর পূর্বজদের গল্পের পার্থক্য নিরূপনে আলাদা কোনো চিহ্নায়ক নেই। তিনি গভীরভাবে সে বিষয়টির দিকে মনোনিবেশ করলেন। গল্প নিয়ে পরীা-নিরীা করলেন। সময় নিলেনÑ প্রস্তুতও হলেন স্বতন্ত্র ভাষা, বিষয় আর আঙ্গিক নিয়ে। এরপর বাংলা গল্প প্রচলিত গল্পধারা থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক ছোটগল্প হয়ে ওঠে। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কথা সাহিত্যে ভাষা-বিষয় পরিবর্তন হয়েছে বেশ এবং হচ্ছে ক্রমশ। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা ছোটগল্প সমাজের বহির্বাস্তবতার সাথে সাথে মানবজীবনের অন্তর্বাস্তবতার জগতেও প্রবেশ করছে। গত শতাব্দির শেষের দিক গল্পভাষার পরীা-নিরীা ও আঙ্গিক পরিবর্তনের এক উল্লেখ্যযোগ্য সময়। ফকির ইলিয়াস সেই উর্বর সময়েরই একজন প্রতিনিধি। স¤প্রতি তাঁর ‘চৈতন্যের চাষকথা’ গ্রন্থটি আমার পড়া হলো। গ্রন্থটিতে এগারোটি গল্প পত্রস্থ হয়েছে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে অনেক জায়গায়ই আমার পরিচিত সুর বেজে ওঠে, আমার কথা বলা হয়ে গেছে, আমার চাওয়ার সাথে ছাপার অরের লেখাগুলো মিলে যায়, সর্বোপরি আমার ঘৃণাবোধের সাথে গল্পে সৃষ্ট চরিত্রের এবং চরিত্র সৃষ্টিকর্তার ঘৃণাবোধের সাদৃশ্যও খুঁজে পাই। গল্প আমাকে টানে, আমিও পৃষ্টার পর পৃষ্টা টানি…। ফকির ইলিয়াসের গল্পে বাহুল্যতা নেইÑ ভাষা সরল; ঝরঝরে। গল্পগুলোর অধিকাংশই মেদহীনÑ কাহিনী ও বর্ণনায়। মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনার অধিকারি ইলিয়াসের গল্পের মধ্যে যেমন রয়েছে সমাজ বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়- অনীতি, নির্যাতন তেমনি রয়েছে মানুষের অন্তর্গত বিষয় প্রেম-বিরহ, ঘৃণা, আত্মবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতি অনুসঙ্গ। অভিবাসী জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-বেদনা, টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এই লেখকের অধিকাংশ গল্পেই বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত সংস্কৃতি, মিশ্র সংস্কৃতি আর অভিবাসী জীবনের কষ্টবোধ ওঠে এসেছে নির্বাচিত কাহিনী আর বর্ণনার মাধ্যমে। লেখক সমান সচেতন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে।
গ্রন্থটির প্রথম গল্প ‘ছেড়ে আসা বন্দরের ছায়া’ তে লেখক বসনিয়ার দখলদার বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনে কথা বর্ণনা করেছেন যুক্তরাষ্টে অভিবাসীত বসনিয়ার এক মেয়ে ক্যাথরিনের মুখ দিয়ে। ক্যাথরিনদের বাড়িতে অতর্কিত আক্রমণ করে, ভোরবেলা বাড়ি ঘেরাও করে ক্যাথরিনের মা-বাবা দু’জনইে নিয়ে যায় দখলদার বাহিনীর লোকেরা। ছ’বছরের ক্যাথরিন তখন তার চাচাদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। নির্যাতনকারিরা তিন মাস পর ক্যাথরিনের মাকে ফিরিয়ে দেয় দীর্ঘ অভিশাপের ভার কাঁধে দিয়ে।
“এর তিন মাস পর একটি আর্মি জীপ বিকালবেলা আমার মাকে আমাদের বাড়ির সামনে রেখে চলে যায়। বাবা আর ফিরে আসেন নি। মা এসেছিলেন, নির্বাক। সমস্ত শরীর জুড়ে তার অত্যাচারের দাগ। এর কদিন পর দখলদার বাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আমার চাচা-চাচীকেও সপরিবারে হত্যা করে। রেডক্রসের সেবাকর্মীদের সহযোগিতায় রিফিউজ পাসপোর্ট নিয়ে আমরা যুক্তরাষ্টে চলে আসি।”
ক্যাথরিনদের বাড়িঘর পুড়ানো, চাচা-চাচীকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে লেখক মূলত: হাজার হাজার বসনিয়া বাসীর উপর বর্বরোচিত অত্যাচার নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। এসব ঘৃণিত অত্যাচারের প্রতি ধিক্কার জানিয়েই একজন লেখকের কলম মানবতার পে অবস্থান নেয়। ফকির ইলিয়াস তার ব্যতিক্রম নন। শুধু বসনিয়ার জেনোসাইড নয়, ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানী জল্লাদদের পাশবিকতা, চেচনিয়ার শান্তি ভঙ্গ, ফিলিস্তিন আক্রমণ, আফগান ইরাকে মার্কিনী আগ্রাসন নির্যাতনের ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনিটরে। মূল বিষয় একটাইÑ দখলদারদের অত্যাচার। ভৌগলিক পরিবেশ ভেদে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হচ্ছে। স্টাকচার এক, মূল সুর এক।
“এর তিন মাস পর একটি আর্মি জীপ বিকালবেলা আমার মাকে আমাদের বাড়ির সামনে রেখে চলে যায়। বাবা আর ফিরে আসেন নি। মা এসেছিলেন, নির্বাক। সমস্ত শরীর জুড়ে তার অত্যাচারের দাগ। এর কদিন পর দখলদার বাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আমার চাচা-চাচীকেও সপরিবারে হত্যা করে। রেডক্রসের সেবাকর্মীদের সহযোগিতায় রিফিউজ পাসপোর্ট নিয়ে আমরা যুক্তরাষ্টে চলে আসি।”
ক্যাথরিনদের বাড়িঘর পুড়ানো, চাচা-চাচীকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে লেখক মূলত: হাজার হাজার বসনিয়া বাসীর উপর বর্বরোচিত অত্যাচার নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। এসব ঘৃণিত অত্যাচারের প্রতি ধিক্কার জানিয়েই একজন লেখকের কলম মানবতার পে অবস্থান নেয়। ফকির ইলিয়াস তার ব্যতিক্রম নন। শুধু বসনিয়ার জেনোসাইড নয়, ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানী জল্লাদদের পাশবিকতা, চেচনিয়ার শান্তি ভঙ্গ, ফিলিস্তিন আক্রমণ, আফগান ইরাকে মার্কিনী আগ্রাসন নির্যাতনের ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনিটরে। মূল বিষয় একটাইÑ দখলদারদের অত্যাচার। ভৌগলিক পরিবেশ ভেদে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হচ্ছে। স্টাকচার এক, মূল সুর এক।
ফকির ইলিয়াসের গল্প পড়লে দেখা যায় শুধু গল্পের জন্য গল্পকে তিনি প্রলম্বিত করেন নি। সার্থক শিল্পমানের প্রতিও যতœশীল তিনি । আর এ জন্য ক্যাথরিন ‘জেনোসাইড ইন বসনিয়া’ বইটি পড়ে অনেক তথ্য, উপাত্ত, প্রমাণ সংগ্রহ করে আত্মশক্তি ও মনোবলে চরম প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে এবং পিতৃহত্যা ও মাতার সম্ভ্রমহানীর বিচারের প্রস্তুতি নেয়; অন্যায়ভাবে বসনিয়ার শত শত মানুষকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল বিশ্ববাসীকে তা জানাতে চায় ক্যাথরিন। গল্পে লেখক মূলত: প্রতিবাদের শক্ত প্রতীক হিশেবেই ক্যাথরিনকে উপস্থিত করেছেন।
‘ঊনবিংশ উপনিবেশ’ গল্পটি বেশ চমৎকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক লেখক রাজাকার কাজিমুদ্দিনের চরিত্র চিহ্নায়নের মাধ্যমে দেশদ্রোহী, দুস্কৃতিকারিদের কু-কর্ম তুলে ধরেছেনÑ সাধারণের নিন্দাবাদের জন্যই। রাজাকার কাজিমুদ্দিনের ভাবনাজাত বর্ণনা থেকে গল্পটি শুরু হয়ে ধীরে ধীরে প্রলম্বিত হয়। কাজিমুদ্দিন নিজ উদ্যেগেই এলাকায় ‘শান্তি কমিটি’ গঠন সভা সামাবেশ করা, পাক কমাণ্ডার বিগ্রেডিয়ার আয়মানকে খুশি করার জন্য প্রতি সপ্তাহে একজন করে হুর নিয়ে কমাণ্ডারের ডেরায় দেয়ার বর্ণনা যতই এগুতে থাকে, আমাদের থু থু ছিটা পড়ে কু-কর্মীদের মুখে ততই। কাজীমুদ্দিনের জীবনে অনেক কিছূই করেছে, পাকিদের কাছ থেকে এসব বীরত্বের উপাধিও ‘মর্দে ওয়াতান, পাহলোয়ানে পাকিস্তান’ পেয়েছে কিন্তু শেষ জীবনে এসে পারে নি একটা জিনিস; তার স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান নাজিম উদ্দিনের পিতৃত্বের সঠিক পরিচয় দিতে। গল্পাকার খুব সুক্ষ্মভাবে বিজ্ঞানের সত্যতার নিরিখে পিতা পুত্রের রক্তের ভীন্নতা প্রমাণ করেন। খুব দতার সাথে ফকির ইলিয়াস এ কাজটি করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মতায় এসে সকল দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, গডফাদারদের কাঠগড়ায় তুলতে লাগলে রাজাকার কাজিমুদ্দিন শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তার আশঙ্কা আরো বেড়ে যায় যখন বুঝতে পারে এ প্রক্রিয়ায় এক সময় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার কাজ শুরু হবে। ‘দেশে মান-ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারবো না’ বলে কাজিমুদ্দিন মার্কিন প্রবাসী ছেলে নাজিমুদ্দিনকে তাগদা দেয় তাকে তাড়াতাড়ি যুক্তরাষ্টে নিয়ে যাওয়ার প্রসেসিং করতে। দেশের অবস্থা দেখে ছেলেও বাবাকে নিয়ে উৎকণ্ঠায়। তাড়াতাড়ি কাগজপত্র জমা দিয়ে কাজ করতে গেলে ইমিগ্র্যান্ট ভিসা প্রসেসিংয়ের অংশ হিসেবে ইমিগ্র্যাশন বিভাগ পিতা-পুত্রের ডিএনএ টেস্ট চেয়েছে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেলে ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট আসে কজিমুদ্দিনের সাথে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই নাজিমুদ্দিনের। গল্পাকার গল্পের ভেতর এর একটা ইঙ্গিতও দিয়ে গেছেন সচেতনভাবে।
“নিন্দুকেরা নাজিমুদ্দিন সর্দারকে কেন পাক বিগ্রেডিয়ারের সন্তান বলে আখ্যা দেয়, তারও একটা শানে নুযুল আছে। কাজিমুদ্দিন সর্দার প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন ‘হুর’ নিয়ে হাজির হবেন বিগ্রেডিয়ারের ডেরায়। এক সপ্তাহের তার গর হাজিরা দেখে বিগ্রেডিয়ার নিজেই এসে হাজির হন কাজিমুদ্দিন সর্দারের বাড়িতে। তার সদ্য বিয়ে করা নববধূ তখন ঘরে। নিন্দুকেরা আরো বলেন, ঐ পাক জান্তা নাকি সেদিন হামলে পড়েছিল সর্দারের নববধূর উপর। নাজিমুদ্দিন সর্দারের জন্ম বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে। চেহারা-সুরতে মিল না থাকায় কাজিমিুদ্দিন সর্দারের পুত্র নয় বলেও একটা কানাঘুষা চলতে থাকে এলাকায়। কিন্তু সামনা সামনি কেউ কিছু বলার সাহস কখনোই দেখাতে পারেনি।”
“নিন্দুকেরা নাজিমুদ্দিন সর্দারকে কেন পাক বিগ্রেডিয়ারের সন্তান বলে আখ্যা দেয়, তারও একটা শানে নুযুল আছে। কাজিমুদ্দিন সর্দার প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন ‘হুর’ নিয়ে হাজির হবেন বিগ্রেডিয়ারের ডেরায়। এক সপ্তাহের তার গর হাজিরা দেখে বিগ্রেডিয়ার নিজেই এসে হাজির হন কাজিমুদ্দিন সর্দারের বাড়িতে। তার সদ্য বিয়ে করা নববধূ তখন ঘরে। নিন্দুকেরা আরো বলেন, ঐ পাক জান্তা নাকি সেদিন হামলে পড়েছিল সর্দারের নববধূর উপর। নাজিমুদ্দিন সর্দারের জন্ম বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে। চেহারা-সুরতে মিল না থাকায় কাজিমিুদ্দিন সর্দারের পুত্র নয় বলেও একটা কানাঘুষা চলতে থাকে এলাকায়। কিন্তু সামনা সামনি কেউ কিছু বলার সাহস কখনোই দেখাতে পারেনি।”
মাতৃভূমি ত্যাগী একজন লেখকের অভিবাসী জীবনের টানাপোড়েন, দুঃখ, হতাশা নিয়ে রচিত হয়েছে ‘কবি ও নির্বাসন নৈবেদ্য’ গল্পটি। গল্পে সৃষ্ট চরিত্র রীমার মাধ্যমে মূল চরিত্র লেখকের নির্বাসিত অবিবাসী জীবনের গল্প বলা হয়েছে। সামাজিক অনাচার, সামরিক নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় হুমকি-ধমকির মুখে স্বাধীন মত প্রকাশে বাধাগ্রস্থ হয়েই কবি তাঁর নিজ দেশ ত্যাগ করেছিলেন। প্রতিবাদী লোকটি রাষ্ট্রীয় দণ্ডে দণ্ডিতও হয়েছিলেন। অভিবাসী জীবন নিয়ে কিউবায় আশ্রয় নিলে সেখানেও স্বৈরাচারী শাসকের সামরিক গোয়েন্দা দ্বারা নিগৃহীত হতে হয় তাকে। তৃতীয় জীবনের খোঁজে আটলান্টিক পেরিয়ে লেখক আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রে। স্বদেশ-তাড়িত মানবতাবাদী এই লেখককে সম্মান দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘদিন সেখানে অভিবাসী জীবন কাটালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রদত্ত ‘নির্বাসিত লেখক সম্মানি ভাতা’ চিরকুমার এই লেখককে দেয় জীবনের নিরাপত্তা। গল্পটি পড়তে পড়তে গল্পে বর্ণিত পেরুর অধিবাসী এই সৃজনশীল চরিত্রটি আমাদের দাউদ হায়দার হয়ে বারবার দৃশ্যায়িত হয় আমার চোখের সামনে। কবি শহীদ কাদরী বা কথা সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে বাতাসে। আর এ গল্পের লেখক কি তার থেকে আলাদা? স্বদেশ-তাড়িত না হলেও অভিবাসী জীবনের গ্লানী, বিরহ-বেদনা তিনি কি ব’য়ে বেড়াচ্ছেন না? না হলে বার বার কেনো অভিবাসী (জ্যাকলিন, ক্যাথরিন, ডা সিফত, এ্যারিনা, রাহিদ, জেবিন, হারিস, শায়লা, আদিব, শাদিব, নাভিদ, আইরিনা, আজমাল হোসেন, জুলিয়া) চরিত্র এসে ভীড় করে তাঁর গল্পে? স্বজাতি, স্বভাষার প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ তারই তো পরো প্রকাশ এই গল্প বলার মাধ্যম। বহুজাতিক, বহুভাষিক অভিবাসীর স্থান যুক্তরাষ্টে লেখকও অভিবাসী জীবন যাপন করছেন। ভিন্ন ভাষী, দেশি হলেও অভিবাসীদের মর্মপীড়া একইভাবে অনুরণিত করে সবাকে। সে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা ফকির ইলিয়াসের রয়েছে। আর আছে বলেই তিনি একজনের অন্তরবেদনাকে শ্বাশত অন্তরবেদনা হিশেবে ফুটিয়ে তুলেন পাঠকের কাছে।
“কথ্যভাষা, তা যাই হোক না কেন মানুষের হাসি-কান্না, অনুভূতি, চুম্বন, আলিঙ্গন, বিরহ, বেদনা, মিলনের ভাষা বিশ্ব মানবের একই।”
আধুনিক সাহিত্য তত্ত্ব স্টাকচারিলিজম তো তাই বলে। সাহিত্য তো মানুষের ভাষা-কাঠামোকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়। প্রাচীন যুগে যখন পৃথিবীর এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের মানুষের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিলো না, তখনও প্রায় একই রকম বিষয়-আশয় নিয়ে প্রায় একই কাঠামোর সাহিত্য রচিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এসব সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে নায়ক, নায়িকা, প্রেম, বিরহ, মিলন, বেদনা, সংঘাত, দ্বন্দ্ব, শান্তি, স¤প্রীতিÑ যা বিশ্লেষণ করলে এক ধরণের একটা কাঠামোগত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। ফকির ইলিয়াসের গভীর অন্তর্দৃষ্টি দার্শনিকতা সেদিকেই নিবিষ্ট বলে মনে হয়।
“কথ্যভাষা, তা যাই হোক না কেন মানুষের হাসি-কান্না, অনুভূতি, চুম্বন, আলিঙ্গন, বিরহ, বেদনা, মিলনের ভাষা বিশ্ব মানবের একই।”
আধুনিক সাহিত্য তত্ত্ব স্টাকচারিলিজম তো তাই বলে। সাহিত্য তো মানুষের ভাষা-কাঠামোকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়। প্রাচীন যুগে যখন পৃথিবীর এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের মানুষের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিলো না, তখনও প্রায় একই রকম বিষয়-আশয় নিয়ে প্রায় একই কাঠামোর সাহিত্য রচিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এসব সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে নায়ক, নায়িকা, প্রেম, বিরহ, মিলন, বেদনা, সংঘাত, দ্বন্দ্ব, শান্তি, স¤প্রীতিÑ যা বিশ্লেষণ করলে এক ধরণের একটা কাঠামোগত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। ফকির ইলিয়াসের গভীর অন্তর্দৃষ্টি দার্শনিকতা সেদিকেই নিবিষ্ট বলে মনে হয়।
‘ঘূর্ণিচূর্ণ’ গল্পটিতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনা-প্রবাহ রয়েছে। গল্পের নায়ক রাহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী জীবনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে চাকরি করে। নায়িকা জেবিনও একই প্রতিষ্ঠানে সহকর্মী হিশেবে অনেকদিন কাজ করার ফলে উভয়েরই মধ্যে গভীর চেনাজানা, ভাব বিণিময় হয়। জেবিন পাকিস্তানের মেয়ে হলেও বাব-মার সাথে দীর্ঘদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। জেবিনের বাবা সেখানে একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা। রাহিদ কেবল এতটুকুই জানে। জেবিন রাহিদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লে রাহিদ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেয়। এভাবেই এগিয়ে যায় কাহিনী। দু’জনের ঘনিষ্টতার দূরত্ব ক্রমেই কমতে থাকে। তেমনি এক সময়ে জেবিনের বার্থডে পার্টিতে রাতের কোলাহল কমে গেলে জেবিনের বাবা রাহিদের পারিবারিক নানা প্রসঙ্গ তুললে রাহিদ সহজভাবে গর্বের সাথে পরিচয় দেয় সে বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কথায় কথায় রাহিদ জানতে পারে জেবিনের পিতা মি রামজান পাকিস্তান আর্মির একজন মেজর ছিলেন। রাহিদের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে এবং সেও বিভিন্নভাবে মি রামজানকে প্রশ্ন করে জনতে পারে একাত্তর সালে তিনিই নারায়নগঞ্জ, টঙ্গি, রায়পুরায় পাকিস্তান আর্মির ইনচার্জ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রায়পুরা শব্দটি শুনেই বুকের মধ্যে মুচড়ে ওঠে রাহিদের । কেননা, তার বাবা সেখানেই পাকিস্তানী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অপারেশনে যোগ দিয়েছিলেন। রাহিদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে রায়পুরার লাশের মিছিল, রক্তের নদী, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা পিতার মৃতদেহের চিত্র। গল্পের চরিত্র রাহিদের মাধ্যমে ফকির ইলিয়াস এখানে একটি বিষয় খুব খোলাসা করে তুলেছেন।
“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেছে রাহিদ। সে জানে তিরানব্বই হাজার পরাজিত পাকসেনা, যারা ষোলই ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে আত্মসমর্পণ করেছিল Ñ তাদের কাউকেই আর সামরিক বাহিনীতে নেয় নি পাকিস্তান সরকার। এদের একটি বৃহৎ অংশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরি দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর চতুর পরাজিত অনেক অফিসাররা স্টুরিস্ট হয়ে সপরিবারে চলে আসে ইউরোপে, উত্তর আমেরিকায়। এদের সবাই-ই খোলস পাল্টে এখন বিভিন্ন উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। ব্যাংকার আরিফ রামাজানের অতীত পরিচয় এখন আর ক’জন জানে!”
যেভাবে ঘৃণায় রি রি করে ওঠে রাহিদ চরিত্রের শরীর, এমন কহিনী পড়ে আমরা আবারো থু থু ছিটাই ঘাতকদের মুখে। যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে আপসহীন গল্পাকার চরম বিদ্রোহ প্রকাশ করেন তাঁর কলমের খোঁচায়। জেবিনের বর্থডে পার্টি থেকে রাতে বাসায় ফিরলেও রাহিদের ঘৃণা, ােভ, অভিমানের বিদ্রোহী ভাবনার প্রকাশ ঘটে।
“নাৎসিদের সহায়তা করার জন্য প্রাক্তন কর্ণেল, মেজর, জেনারেলদের বিভিন্ন দেশ থেকে খুঁজে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রেই খোলস পাল্টে মিলিয়নার হয়েছে একাত্তরের পরাজিত পাক অফিসাররা! ‘ওয়ার ক্্িরমিনাল’Ñ এসব পাক অফিসারদের বিরুদ্ধে কি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রিমিনাল কোর্টে মামলা করা যায় না? ভাবনাগুলো ক্রমশঃ ঘুরপাক খেতে থাকে রাহিদের মনে।”
“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেছে রাহিদ। সে জানে তিরানব্বই হাজার পরাজিত পাকসেনা, যারা ষোলই ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে আত্মসমর্পণ করেছিল Ñ তাদের কাউকেই আর সামরিক বাহিনীতে নেয় নি পাকিস্তান সরকার। এদের একটি বৃহৎ অংশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরি দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর চতুর পরাজিত অনেক অফিসাররা স্টুরিস্ট হয়ে সপরিবারে চলে আসে ইউরোপে, উত্তর আমেরিকায়। এদের সবাই-ই খোলস পাল্টে এখন বিভিন্ন উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। ব্যাংকার আরিফ রামাজানের অতীত পরিচয় এখন আর ক’জন জানে!”
যেভাবে ঘৃণায় রি রি করে ওঠে রাহিদ চরিত্রের শরীর, এমন কহিনী পড়ে আমরা আবারো থু থু ছিটাই ঘাতকদের মুখে। যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে আপসহীন গল্পাকার চরম বিদ্রোহ প্রকাশ করেন তাঁর কলমের খোঁচায়। জেবিনের বর্থডে পার্টি থেকে রাতে বাসায় ফিরলেও রাহিদের ঘৃণা, ােভ, অভিমানের বিদ্রোহী ভাবনার প্রকাশ ঘটে।
“নাৎসিদের সহায়তা করার জন্য প্রাক্তন কর্ণেল, মেজর, জেনারেলদের বিভিন্ন দেশ থেকে খুঁজে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রেই খোলস পাল্টে মিলিয়নার হয়েছে একাত্তরের পরাজিত পাক অফিসাররা! ‘ওয়ার ক্্িরমিনাল’Ñ এসব পাক অফিসারদের বিরুদ্ধে কি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রিমিনাল কোর্টে মামলা করা যায় না? ভাবনাগুলো ক্রমশঃ ঘুরপাক খেতে থাকে রাহিদের মনে।”
পরদিন অফিসের লাঞ্চের সময় জেবিন একসাথে লাঞ্চ করার অফার করলেও রাহিদের মধ্যে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য খুঁজে পায় না। লাঞ্চ শেষে জেবিন তার আবেগের রাশ টেনে ধরতে পারেনি; ‘আই লাভ ইউ রাহিদ’ বলে রাহিদের দুটি হাত চেপে ধরতে চাইলে রাহিদ দ্রুত নিজের হাত সরিয়ে নেয়। এখানেই গল্পের সফলতা। মানবীর প্রেমের চেয়েও দেশপ্রেমের কতো গভীরতা তা পরিমাপযোগ্য নয়, কেবল অনুভবযোগ্য। আর রাহিদের শরীরে তো তখন মুক্তিযোদ্ধার পবিত্র রক্ত টগবগ করে প্রবাহিত হচ্ছে।
নিউইয়র্ক শহরের পরিবেশ, পোপট, উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে এমনি একটি গল্প ‘শুমারতত্ত্বের যোগ-বিয়োগ’। গল্পাকার প্রবাস জীবনের চলতি ঘটনা নিয়ে লেখলেও স্বদেশ চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন নন। গল্পের চরিত্র হারিসের স্মৃতি রোমন্থনে উঠে আসে সুরমার ভাঙ্গনে নায়লাদের মতো আরো বিশটি পরিবারের গৃহীন হয়ে পড়ার চিত্রকল্প। নিউইয়র্ক শহরের গৃহহীনদের সুখ-দুঃখের সাথে সুরমা নদীর ভাঙ্গনে নায়লাদের সুখ-দুঃখেরও একটা কাঠামোগত মিল রয়েছ। হারিস নিউইয়র্ক শহরে নকল গৃহহীন সেজে রাতের বেলায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কখনো গভীর জীবন ঘনিষ্ট ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। রাতের এই অবসর সময়টাই তার কছে স্মৃতি রোমন্থনের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয়। ভাবের বাউল হারিস চরিত্র নিউইয়র্ক শহরের ক্যানেল স্ট্রিটে রাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের হাওরের থৈ থৈ জলে ভাসতে থাকে, জলের কোমল স্পর্শে তার যে শিহরণ লাগে তাতে রাধারমণ, হাসন রাজার গানের কলি আওড়ায়Ñ
“ ‘ও মন যাইবায় রে ছাড়িয়া/ দালান পাকা জমিদারী থাকবেরে পড়িয়া..’ গানটি গেয়ে গেয়ে একটি প্রচ্ছন্ন ঘোরজালে আটকা পড়ে হারিস। আসলে মানুষ মাত্রই তো উদ্বাস্তু, মানুষ মাত্রই তো গৃহহীন! তারপরও মোহ, প্রেম, কাম, বিত্ত, বৈভব, চাতুরী, মিথ্যাচার শঠতা সবই ঘিরে রাখে মানুষের জীবন।”
আমি মনে করি গল্পের নেপথ্যে ফুটে ওঠেছে গল্পাকারের জীবন দর্শন। একজন লেখক তো নিজেকে প্রকাশ করে যান তার লেখনির মাধ্যমে। ফকির ইলিয়াসও তার বাইরে নয়। তবে এ গল্পের ভেতরে তিনি অনেক উপগল্পও বলে ফেলছেন। গল্পের কাহিনী একমুখি হলেও বর্ণনা বিভিন্ন শাখায় প্রশাখায় লম্বিত হয়েছে। বিশেষ করে শায়লার স্বামী যিনি বাংলাদেশের একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ফুলটাইম কোনো চাকরিও পাচ্ছেন না, আর যেনো তেনো কোনো কাজ করাও তার পছন্দ নয়Ñ তাকে টেনে আনা ঘটনার ঘনঘটাই মনে হবে। এদিকে শায়লা ব্যয়বহুল আমেরিকার জীবনকে টেনে নিতে বাধ্য হয়ে ডাবল শিফটের চাকরি চালিয়ে যেতে হয়। শায়লা দীর্ঘ সময়ের কাজের ধকল সইতে সইতে এক সময় জটিল ব্যাধি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের সংসার ও দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। প্রবাস জীবনে যন্ত্র মানবের ব্যস্ত সময়, জীবনযাত্রার মানের সাথে পাল্লা দিয়ে নির্ঘুম রাতের ফেরি করা শ্রমের কথা দিয়েই সাজাতে পারতেন একটি পূর্ণগল্পÑ যে গল্পে লণ্ডন আমেরিকার প্রতি বাঙালী প্রবণতা একটু হলেও জীবন বাস্তবাত বুঝার সুযোগ পেতো। অবশ্য গল্পাকারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় শুমার কাজে নিয়োজিত কর্মীদের পরিসংখ্যানে গাফিলতি, দায়িত্বে অবহেলা ও সর্বোপরি যেনোতেনোভাবে একটা রিপোর্ট তৈরি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা। গল্পের চরিত্র হারিস নিজেই গৃহহীন সেজে পরিসংখ্যান রিপোর্টটি ভূয়া প্রমাণ করেছে। গৃহহীনদের শুমারি করার জন্য সে রাতে দুই হাজার কর্মীর বিশাল এক বহিনী নিউইয়র্ক শহরে নিয়োজিত করা হয় এবং শুমারি কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিটি কর্তৃপ দুইশ পঞ্চাশজন স্বোচ্ছাসেবককে গৃহহীনের বেশভূষা পরিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় পুরো নিউইয়র্ক শহরে। হারিসও এই স্বেচ্ছাসেবকদের একজন। ক্যানেল স্ট্রিট স্টেশনে নকল গৃহহীন হারিস জগৎ, জীবন, মরণ, দর্শনচিন্তা, স্বদেশস্মৃতি রোমন্থন করে সারা রাত কাটায়। ভোর হয়ে এলে বাসায় ফিরে; কেউ তার নাম ঠিকানা তালিকাভূক্ত করেনি। কিন্তুÑ
“এক সপ্তাহ পর গৃহহীন শুমারির রিপোর্ট বের হয়। রিপোর্টে দেখা যায়, এ বছর মহানগরীতে গৃহহীনের সংখ্যা দশ হাজার দুইশত তিন জন। অর্থাৎ গেল বছরেরর প্রায় দ্বিগুণ। রিপোর্টের যোগ-বিয়োগে দেখা যায় শুমার কর্মীরা ঐ রাতে দুই শত ঊনপঞ্চাশজন স্বেচ্ছাসেবককে বিভিন্ন স্থাপনায় গণনা করতে পেরেছিলেন। শুমার কর্মীদের রিপোর্ট পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, তারা ক্যানেল স্ট্রিট স্টেশনে অর্থাৎ যেখানে হারিস অবস্থান করছিলÑ সেখানে কোন হোমলেস ব্যক্তিকেই দেখতে পায়নি।”
“ ‘ও মন যাইবায় রে ছাড়িয়া/ দালান পাকা জমিদারী থাকবেরে পড়িয়া..’ গানটি গেয়ে গেয়ে একটি প্রচ্ছন্ন ঘোরজালে আটকা পড়ে হারিস। আসলে মানুষ মাত্রই তো উদ্বাস্তু, মানুষ মাত্রই তো গৃহহীন! তারপরও মোহ, প্রেম, কাম, বিত্ত, বৈভব, চাতুরী, মিথ্যাচার শঠতা সবই ঘিরে রাখে মানুষের জীবন।”
আমি মনে করি গল্পের নেপথ্যে ফুটে ওঠেছে গল্পাকারের জীবন দর্শন। একজন লেখক তো নিজেকে প্রকাশ করে যান তার লেখনির মাধ্যমে। ফকির ইলিয়াসও তার বাইরে নয়। তবে এ গল্পের ভেতরে তিনি অনেক উপগল্পও বলে ফেলছেন। গল্পের কাহিনী একমুখি হলেও বর্ণনা বিভিন্ন শাখায় প্রশাখায় লম্বিত হয়েছে। বিশেষ করে শায়লার স্বামী যিনি বাংলাদেশের একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ফুলটাইম কোনো চাকরিও পাচ্ছেন না, আর যেনো তেনো কোনো কাজ করাও তার পছন্দ নয়Ñ তাকে টেনে আনা ঘটনার ঘনঘটাই মনে হবে। এদিকে শায়লা ব্যয়বহুল আমেরিকার জীবনকে টেনে নিতে বাধ্য হয়ে ডাবল শিফটের চাকরি চালিয়ে যেতে হয়। শায়লা দীর্ঘ সময়ের কাজের ধকল সইতে সইতে এক সময় জটিল ব্যাধি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের সংসার ও দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। প্রবাস জীবনে যন্ত্র মানবের ব্যস্ত সময়, জীবনযাত্রার মানের সাথে পাল্লা দিয়ে নির্ঘুম রাতের ফেরি করা শ্রমের কথা দিয়েই সাজাতে পারতেন একটি পূর্ণগল্পÑ যে গল্পে লণ্ডন আমেরিকার প্রতি বাঙালী প্রবণতা একটু হলেও জীবন বাস্তবাত বুঝার সুযোগ পেতো। অবশ্য গল্পাকারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় শুমার কাজে নিয়োজিত কর্মীদের পরিসংখ্যানে গাফিলতি, দায়িত্বে অবহেলা ও সর্বোপরি যেনোতেনোভাবে একটা রিপোর্ট তৈরি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা। গল্পের চরিত্র হারিস নিজেই গৃহহীন সেজে পরিসংখ্যান রিপোর্টটি ভূয়া প্রমাণ করেছে। গৃহহীনদের শুমারি করার জন্য সে রাতে দুই হাজার কর্মীর বিশাল এক বহিনী নিউইয়র্ক শহরে নিয়োজিত করা হয় এবং শুমারি কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিটি কর্তৃপ দুইশ পঞ্চাশজন স্বোচ্ছাসেবককে গৃহহীনের বেশভূষা পরিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় পুরো নিউইয়র্ক শহরে। হারিসও এই স্বেচ্ছাসেবকদের একজন। ক্যানেল স্ট্রিট স্টেশনে নকল গৃহহীন হারিস জগৎ, জীবন, মরণ, দর্শনচিন্তা, স্বদেশস্মৃতি রোমন্থন করে সারা রাত কাটায়। ভোর হয়ে এলে বাসায় ফিরে; কেউ তার নাম ঠিকানা তালিকাভূক্ত করেনি। কিন্তুÑ
“এক সপ্তাহ পর গৃহহীন শুমারির রিপোর্ট বের হয়। রিপোর্টে দেখা যায়, এ বছর মহানগরীতে গৃহহীনের সংখ্যা দশ হাজার দুইশত তিন জন। অর্থাৎ গেল বছরেরর প্রায় দ্বিগুণ। রিপোর্টের যোগ-বিয়োগে দেখা যায় শুমার কর্মীরা ঐ রাতে দুই শত ঊনপঞ্চাশজন স্বেচ্ছাসেবককে বিভিন্ন স্থাপনায় গণনা করতে পেরেছিলেন। শুমার কর্মীদের রিপোর্ট পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, তারা ক্যানেল স্ট্রিট স্টেশনে অর্থাৎ যেখানে হারিস অবস্থান করছিলÑ সেখানে কোন হোমলেস ব্যক্তিকেই দেখতে পায়নি।”
‘পরবর্তী সখ্যায় সমাপ্য’ একটি দীর্ঘ গল্প। প্রথম পুরুষের বর্ণনায় গল্প কথনে কথকের দেখাশুনার জগতের নানান অনুসঙ্গের মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ রয়েছে গল্পটিতে। এতে বিমানবালার সাথে মদ্যপ সাংসদের অশালীন আচরণ, লোক কবি ও বাউল গায়েনের মুক্ত গান পরিবেশনে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিবন্ধকতা, মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পোপট, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ভাঙ্গন প্রভৃতি বিষয় গল্প কথকের মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। আর সবগুলো বিষয়ই মূলতঃ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্রের প্রেমোপাখ্যানের পার্শ্বচিত্র হিশেবে এসেছে। বলা যায় গল্পটি অনেক বিষয়ের সমন্বিত বর্ণনার একটি প্রয়াস। কিন্তু গল্পের প্রথম দিক থেকে ‘আমি’ চরিত্রের যে প্রতিবাদী, সংযমী, উদার মনোভাব দেখলাম, শেষ পরিণতিতে তার ব্যক্তিত্বের অবনতি, পলায়নপর মনোভাবে গল্পের শিল্পমান কিছুটা ুন্ন হয়েছে বলে মনে করি। কেননা, প্রেমের পরাজয়ের কাছে নতি স্বীকার করে আত্মপলায়ন, আত্মবিনাসে আর যাই হোক দেবদাস হওয়া যায়, কিন্তু আবেগের জোয়ারে নিজেকে ডুবিয়ে মারলে জীবনের সার্থকতা কোথায় থাকে? বরং দৃঢ় মনোবল নিয়ে সামনে চলার মাঝে একটা ম্যাসেজ থাকে আপামর জনসাধারণের জন্য। এরকম ‘বিবর্তনের নিঃসঙ্গ বয়ন’ গল্পটিতেও মূল গল্পে প্রবেশের আগে প্রাসঙ্গিক বর্ণনার ভারে কিছুটা ভারাক্রান্ত বলে মনে হয়েছে। গল্পের মূল চরিত্র সাদিব ও সাদিয়া। কিন্তু গল্পটি শুরু করে সামনে এগুতে থাকলে শাদিবের মুক্তিযোদ্ধা বাবার প্রতিই পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট হবে বেশি। এবং প্রথম অনুচ্ছেদে ক্রমেই তিনি শীর্ষ চরিত্রে পাঠকের মনে স্থান করে নেবেন। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শেষের দিকে গেলে পাঠকের মোড় ঘুরে মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শাদিব ও সাদিয়া। প্রথম দিকের বর্ণনা একটু ঋজু থাকলে মনে হয় এমন হতো না।
ফকির ইলিয়াসের এ গ্রন্থটির সবচেয়ে ছোট পরিসরের একটি গল্প হলো ‘ছায়াময় তৃতীয় প্রহর’। লেখক গল্পটিতে সংপ্তিভাবে মূল গল্পটি উপস্থিত করেছেন কৃতিত্বের সাথে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দেশে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগের যে মাত্রাগত পাথর্ক রাষ্ট্রযন্ত্র নির্ধারণ করে দিয়েছে এর ফলে কোনো দেশের লোক পাচ্ছে ব্যক্তি স্বাধীতার পূর্ণমাত্রা, কোথাও দেখা দিচ্ছে জটিলতা; এরই সরল বর্ণনা রয়েছে গল্পটিতে। ‘সমতলে প্রপাতের আলো’ গল্পটি ইলিয়াস মহৎ মন ও মানবপ্রেমের জারিত রসে সিক্ত করেছেন। মানব কল্যাণ আর মানবতার জন্য একটা ম্যাসেজ রয়েছে গল্পটিতে।
ফকির ইলিয়াসের একটি অসাধারণ চমৎকার গল্প ‘যেভাবে ঘনিয়ে আসে জলের গ্রহণ’। গল্পের শুরু হয়েছে যেভাবে সুন্দর বর্ণনায়, সমাপ্তিও হয়েছে নান্দনিকভাবে। লেখক এই গল্পের কহিনী নির্বাচনে যেমন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি বর্ণনায়ও তা অটুট রেখেছেন। গল্পে কেন্দ্রিয় চরিত্র আইরিনা আমেরিকার শিকাগো গহরের বিলাসবহুল জীবন যাপনের মায়া ত্যাগ করে মানবতা, দরিদ্র, অনাথ শিশুদের কল্যাণে নিজের সহায় সম্পদ দান করার পরিবর্তিত মানষিকতার মাধ্যমে গল্পাকার উন্নত বিশ্বের ভোগবাদী জীবন-যাপনের মাঝেও মানুষের মনের যে সুখ নেই তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আর আইরিনার মানষিক পরিবর্তনেরও একটা কার্য-কারণ সম্পর্ক দেখিয়েছেন তিনি। আইরিনের বাঙালী স্বামী আজমাল হোসেনের সততা, উদারতা, নিখাঁদ দেশপ্রেম, মানবতা ও শিশু-বান্ধব মনোভাব তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে সাংস্কৃকিত মিশ্রায়ন ও মানষিক পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। আইরিনার এ পরিবর্তন আরো তরান্বিত হয় স্বামী আজমাল হোসেনের মৃত্যুর পর তারই লাইফ ইন্সুরেন্সের নমিনিসত্ত্ব উইল অনুযায়ী আইরিনা পাবেন পঞ্চাশ শতাংশ, পঁচিশ শতাংশ পাবে তাদের দত্তক পুত্র আকবর হোসেন, আর পঁচিশ শতাংশ পাবে বাংলাদেশের দুস্থ শিশুরাÑ এমন অর্থভাগ দেখে। স্বামীর ব্যক্তিত্ব আর বিরহে হাহাকার করে ওঠে তার মন। এভাবেই এগিয়ে যায় চমৎকার এক গল্পের কাহিনী বর্ণনা। ভোগবাদী জীবনের মোহ ত্যাগ করে জীবনটাকে ছোট করে ভাবতে থাকে আইরিনা। যে প্রেম দিয়ে আজমালের সাথে বিয়ে ও ঘর করেছিলো আইরিনা, সে প্রেমকে বিজয়ী করতে বাংলাদেশে এসে আজামালের সমাধির পাশে সমাহিত হতে চায় আইরিনা। আর চায় বলেই দত্তক পুত্র আকবর হোসেনকে চাপ দেয় তাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে।
“আকবর আমি আমার প্রাপ্ত ইন্সুরেন্সের অর্থটিও শিশু নিকেতনের জন্য দিয়ে দিতে চাই। আর চাই বাকি জীবনটা বাংলাদেশে গিয়েই কাটিয়ে দিতে। বাংলাদেশের ঋতুচক্র, বাংলাদেশের ফুল-নদীর কথা অনেক শুনেছি। আমি তা স্পর্শ করতে চাই। আমার মুখমণ্ডলে লাগাতে চাই সুরমা নদীর জলের ঝাপটা। যে সুরমা নদীতে সাঁতার কেটেছে আজমাল হোসেন।”
“আকবর আমি আমার প্রাপ্ত ইন্সুরেন্সের অর্থটিও শিশু নিকেতনের জন্য দিয়ে দিতে চাই। আর চাই বাকি জীবনটা বাংলাদেশে গিয়েই কাটিয়ে দিতে। বাংলাদেশের ঋতুচক্র, বাংলাদেশের ফুল-নদীর কথা অনেক শুনেছি। আমি তা স্পর্শ করতে চাই। আমার মুখমণ্ডলে লাগাতে চাই সুরমা নদীর জলের ঝাপটা। যে সুরমা নদীতে সাঁতার কেটেছে আজমাল হোসেন।”
‘চৈত্যনের চাষকথা’ গ্রন্থের নামগল্পটি একেবারে শেষে পত্রস্থ হয়েছে। গল্পটির শুরু হয়েছে সুন্দর চিত্রকল্প দিয়ে। নিসর্গের নান্দনিক ব্যবহার গল্পটিকে চমৎকৃত করে তুলেছে। একটু উদৃত্তি দিলে স্পষ্ট হবে।
“শার্লেট কাউন্টির দণি দিয়েই বয়ে গেছে যে ছোট্ট নদীটি, তার নাম শার্লেট রিভার। কোনো নদী ঢেউহীন হয়ে পড়লে তাকে নাকি হৃদ বলা যায়! শার্লেট নদীটিও যেমন স্থির কোনো প্রতিকৃতি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। শোনা যায়, এই নদীটির সাথে এক সময় সাগর মোহনার সংযোগ ছিল। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট প্রশাসন পোর্ট শার্লেট কাউন্টিকে আরো উপভোগ্য, আরো পর্যটকদের দর্শনীয় করে তোলার জন্য নদীটিকে লেক বানিয়ে ফেলেছে।”
গল্পটি কাহিনীর দিকে যেতে যেতে এভাবে এসেছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা। গল্পটিতে স্থান পেয়েছে কষ্টপোড়া অভিবাসী জীবন, অভিবাসীদের প্রতি অভিবাসীর সহমর্মিতা, জীবনের টানে মানুষে মানুষে মায়ার বাঁধন, সেই জীবনের টানে সে বাঁধনকে ছেদন, দেহতত্ত্ব, ভাববাদের বিষয়-আশয়। পরেশ আমেরিকায় পরিচিত হয় কষ্টের ঘানি টানা একটা জীবন, স্বামী পরিত্যক্তা মেক্সিকান মেয়ে জুলিয়ার সাথে। কৃষিফার্মে অনেকদিন একসাথে কাজ করার সুযোগে গড়ে ওঠেছিলো তাদের মাঝে মায়ার এক বাঁধন। কর্মনিষ্ঠতার পাশাপাশি পরেশের মাঝে বাউলিপনাও ছিলো। কাজের অবসরে গান করতো, জুলিয়া মন দিয়ে তার গান শুনতো। কৃষিতে দতা অর্জনের পর পরেশ আর আমেরিকায় থাকতে চায়নিÑ বাংলাদেশের কৃষকের জন্য সে স্বপ্ন দেখে। পরেশের এমন সিদ্ধান্তে ভেঙ্গে পড়ে জুলিয়া। কাহিনী আরো ঘনিভূত হয়। পরেশ সকল অর্থ আর আবেগের হাতছানি উপো করে নিজ মাতৃভূমির সেবায় স্বদেশে ফিরে আসে। মাতৃভূমিতে পরেশের ফিরে আসার মধ্য দিয়েই গল্পটি শিল্প সার্থক হয়ে ওঠে। শিকড়ের প্রতি টান, দেশপ্রেমের চেতনা এখানে প্রবল। চৈতন্যহীনতা মানেই তো নিঃ®প্রাণ, জড়বস্তু। যে মানুষের মাঝে চৈতন্য নেই তার অবস্থাও তথৈবচ। ফকির ইলিয়াসের গল্পনাম ও গ্রন্থনাম ‘চৈতন্যের চাষকথা’ এ বিবেচনায় যথার্থ হয়েছে বলে মনে করি।
গ্রন্থটি ‘ভাষাচিত্র’ থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১০-এ প্রকাশ হয়েছে। প্রচ্ছদকাজ করেছেন সৃজনশীল শিল্পী তৌহিন হাসান। বইটির দাম:১০০ টাকা।
“শার্লেট কাউন্টির দণি দিয়েই বয়ে গেছে যে ছোট্ট নদীটি, তার নাম শার্লেট রিভার। কোনো নদী ঢেউহীন হয়ে পড়লে তাকে নাকি হৃদ বলা যায়! শার্লেট নদীটিও যেমন স্থির কোনো প্রতিকৃতি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। শোনা যায়, এই নদীটির সাথে এক সময় সাগর মোহনার সংযোগ ছিল। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট প্রশাসন পোর্ট শার্লেট কাউন্টিকে আরো উপভোগ্য, আরো পর্যটকদের দর্শনীয় করে তোলার জন্য নদীটিকে লেক বানিয়ে ফেলেছে।”
গল্পটি কাহিনীর দিকে যেতে যেতে এভাবে এসেছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা। গল্পটিতে স্থান পেয়েছে কষ্টপোড়া অভিবাসী জীবন, অভিবাসীদের প্রতি অভিবাসীর সহমর্মিতা, জীবনের টানে মানুষে মানুষে মায়ার বাঁধন, সেই জীবনের টানে সে বাঁধনকে ছেদন, দেহতত্ত্ব, ভাববাদের বিষয়-আশয়। পরেশ আমেরিকায় পরিচিত হয় কষ্টের ঘানি টানা একটা জীবন, স্বামী পরিত্যক্তা মেক্সিকান মেয়ে জুলিয়ার সাথে। কৃষিফার্মে অনেকদিন একসাথে কাজ করার সুযোগে গড়ে ওঠেছিলো তাদের মাঝে মায়ার এক বাঁধন। কর্মনিষ্ঠতার পাশাপাশি পরেশের মাঝে বাউলিপনাও ছিলো। কাজের অবসরে গান করতো, জুলিয়া মন দিয়ে তার গান শুনতো। কৃষিতে দতা অর্জনের পর পরেশ আর আমেরিকায় থাকতে চায়নিÑ বাংলাদেশের কৃষকের জন্য সে স্বপ্ন দেখে। পরেশের এমন সিদ্ধান্তে ভেঙ্গে পড়ে জুলিয়া। কাহিনী আরো ঘনিভূত হয়। পরেশ সকল অর্থ আর আবেগের হাতছানি উপো করে নিজ মাতৃভূমির সেবায় স্বদেশে ফিরে আসে। মাতৃভূমিতে পরেশের ফিরে আসার মধ্য দিয়েই গল্পটি শিল্প সার্থক হয়ে ওঠে। শিকড়ের প্রতি টান, দেশপ্রেমের চেতনা এখানে প্রবল। চৈতন্যহীনতা মানেই তো নিঃ®প্রাণ, জড়বস্তু। যে মানুষের মাঝে চৈতন্য নেই তার অবস্থাও তথৈবচ। ফকির ইলিয়াসের গল্পনাম ও গ্রন্থনাম ‘চৈতন্যের চাষকথা’ এ বিবেচনায় যথার্থ হয়েছে বলে মনে করি।
গ্রন্থটি ‘ভাষাচিত্র’ থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১০-এ প্রকাশ হয়েছে। প্রচ্ছদকাজ করেছেন সৃজনশীল শিল্পী তৌহিন হাসান। বইটির দাম:১০০ টাকা।
http://shikorblogdotcom.wordpress.com/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE-2/%E0%A6%AB%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%87%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%88%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B0/
No comments:
Post a Comment