Friday, March 21, 2014

কোয়ার্টার নং ৪/১১

কোয়ার্টার নং ৪/১১

HIGHRISE

একটি ছবি৷ পাল্টাতে থাকা কলকাতার এক শ্রমিক ও তাঁর লড়াই নিয়ে৷ সেই লড়াইয়ের গল্প শোনালেন পরিচালক রাণু ঘোষ৷ আলাপে দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়

'অ্যাকোয়ারিয়াম' গ্রন্থে নবারুণ ভট্টাচার্য জানান, দক্ষিণ কলকাতার এক শপিংমলের উদ্বোধনের দিন সন্ধ্যায় মলটির সামনে দিয়ে হাঁটছিলেন লেখক৷ আচমকাই ক'জন রক্ষী তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দেয়৷ আপনার 'কোয়ার্টার নাম্বার ফোর ইলেভেন' ছবিতেও বারবার ঘাড় ধাক্কা খান ঊষা কোম্পানির কাজ খোয়ানো শ্রমিক শম্ভুপ্রসাদ সিং৷ অন্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়ে যান তবু একা৷ ছবির শেষে তাঁর মৃত্যুও হয় 'অজ্ঞাত কারণে'...

আমার গবেষণার সূত্রেই এই ছবির কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া৷ উন্নয়নের রাজনীতি, বলা ভালো উড়ালপুল ও হাইরাইজের যে নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নের রাজনীতি, সেটাকে আমি প্রশ্ন করতে চাইছিলাম৷ আজ যেখানে এই মল, সেই অঞ্চলের পাঁচটি বড় কারখানার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দেয়৷ ওই অঞ্চলে বাস করা শ্রমিকদের বাড়িগুলিও বেআইনি ভাবে ভেঙে দেওয়া হয়৷ এই যে গোটা অঞ্চলের চিত্রটা পাল্টে গেল, সেটাকেই আমি ধরতে চেষ্টা করছিলাম৷ এই পরিবর্তনটা যে পন্থায় ঘটছিল, সেই পন্থাটির প্রতিবাদের দলিল আমার ছবিটি৷ বছরের পর বছর ধরে এই পরিবর্তনটা ফলো করে আমার ক্যামেরা৷ এক সময় সেই ক্যামেরার হাত বদলও হয়৷ কারণ ওরা কোয়ার্টারের ভেতর আমাদের ঢুকতে দিত না৷ তখন আমার ছবির প্রধান চরিত্র, শম্ভুপ্রসাদ সিং-কে আমি ক্যামেরা চালানো শিখিয়ে দিই৷ ছবির অর্ধেকটা আনকোরা ভাবে শম্ভুরই তোলা৷ তো, এই গোটা প্রক্রিয়াটাকে ধরতে চেয়েই এই ছবি৷

শম্ভুবাবুর সঙ্গে আপনার দেখা হল কীভাবে?

২০০৬ সালে শম্ভুপ্রসাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ৷ সেই সময় থেকেই ওঁর জার্নিটাকে ফ্রেমবন্দি করার ইচ্ছে ছিল৷ ওঁকে ফলো করাটা খুব শক্ত কাজ ছিল সেই সময়ে৷ কারণ, পুলিশ প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তার ফাঁক গলে ওঁকে ধরাটা একরকম অসাধ্যই ছিল৷ কিন্ত্ত তার মধ্যেও ওঁকে আমি ক্যামেরার কাজ শেখাই৷ উনি বাধ্য ছাত্রের মতো গোটা বিষয়টি শিখে নেন৷ এই যে সরকারের তৈরি করা এত 'অড'কে একজন 'অর্ডিনারি ইন্ডিভিজুয়াল' ফেস করছে, সেটাকে কেন্দ্র করেই ছবির আখ্যান গড়ে ওঠে৷ শম্ভুবাবুর প্রতিবাদটা আমরা স্বপ্নে দেখি, কিন্ত্ত করি না৷ উনি করে ফেলেছিলেন৷ যেভাবে উনি চার বছর ধরে নিজের সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেছিলেন, নিজের ভিটে থেকে একটুও না সরে, সেটা আমাকে ভাবিয়েছিল৷

একটা চরিত্রকে ছবিটি অনুসরণ করতে করতে বারবার সনাক্ত করে ফেলে তদানীন্তন সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন বেনিয়াপনা৷ এক থেকে অনেকগুলো শম্ভু সিং-দের যন্ত্রণা ধ্বনিত হচ্ছে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে... 

হয়তো সেই কারণেই সেন্সর বোর্ড দীর্ঘ দিন অনুমোদন করেনি ছবিটি৷ সেন্সর বোর্ডের পনেরো জনের কমিটি তাই হয়তো আমায় এক রকম থ্রেটই করে৷ যদিও তাতে আমি বিশেষ ঘাবড়াইনি৷ কারণ, তা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে ছবিটিকে সারা পৃথিবীতে দেখাতেই পারি৷ আর যে সব বড় ফেস্টিভ্যালে সেন্সর অনুমোদন দরকার, সেগুলি আমার দরকার নেই৷ আমার তো প্রতিপাদ্য বিষয়ই ছিল, শ্রমিকদের সংগ্রাম৷ দাঁতে দাঁত চেপে দিনের পর দিন কী ভাবে তারা কোর্ট কেস চালাচ্ছে, সেই জায়গাটাকে তুলে ধরা৷ যে গরিব মানুষগুলো খাওয়ার পয়সার বিনিময়ে নিজেদের দাবি দাওয়ার মামলা লড়ছে, তাদের তো আমি বলতে পারি না, আপনারা কেসগুলো তুলে নিন, তবেই আমার ছবি নির্বিবাদে সেন্সর অনুমোদন পেয়ে যাবে৷ তো, ব্যক্তিগতভাবেই ছবিটি সাউথ কোরিয়াতে প্রথম দেখানো হয়৷ তার পর, অস্ট্রেলিয়াতেও দেখানো হয়৷ সেখানে সেন্সর ইস্যুটা নিয়েও প্রচুর লেখালেখি হয়৷ সিওলে ছবিটি থিয়েটারে মুক্তি পায়৷ ভারতের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিক্রিয়াটা একটু আলাদা৷ শম্ভুপ্রসাদবাবু সিটুর লোয়ার কমিটিতে কিছুদিন কাজ করেছেন, পার্টির সদস্যপদও ছিল ওঁর৷ পরে অবশ্য সেই সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করেন৷ ফলে, অনেকেই এখনও চেষ্টা চালাচ্ছে, ছবিটিকে যাতে আটকে দেওয়া হয়৷ তবে পাশাপাশি আরেক শ্রেণির মানুষও আছেন৷ তাঁরা ছবিটিকে সাধারণ এক শ্রমিকের অসাধারণ লড়াই হিসেবেই দেখছেন৷ এবং তাঁরা ছবিটি নিয়ে ভীষণ ভাবেই উত্তেজিত৷ আর সেটাই আমার জোর৷ উল্লেখ্য, জার্মানিতেও কিন্ত্ত ছবিটি খুব প্রশংসিত হয়৷ আসলে ছবিটিতে শম্ভুর সঙ্গে জার্নির একটা লিভিং এক্সপেরিয়েন্স পাওয়া যায়, সেটাই কোথাও দাগ কাটছে দর্শকদের মনে৷

যে সব জায়গার নাম করলেন, বেশিরভাগই সম্ভ্রান্ত এলাকা৷ পৃথিবীর কোনও লেবার ক্যাম্পে কী দেখানো হয়েছে এই ছবি? 

হ্যাঁ, তা-ও হয়েছে৷ সানফ্রান্সিসকোর বন্দর এলাকার একটি লেবার ক্যাম্পে ছবিটি দেখানো হয়৷ এবং সেখানকার শ্রমিকরা নিজেদের লড়াইয়ের সঙ্গে শম্ভুপ্রসাদের লড়াইয়ের মিলও খুঁজে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন৷

ছবিটির নির্মাণ চলাকালীন কোনও বাধার মুখোমুখি হন?

কেউ ভয়ে কাজই করতে চাইত না আমার সঙ্গে৷ কত যে সহকারীরা ছেড়ে চলে গিয়েছেন! সেই সঙ্গে স্থানীয় লোকের সঙ্গে যখনই কথা বলেছি, লক্ষ করেছি, সকলের মধ্যেই একটা অদ্ভুত মনোভাব৷ অর্থাত্‍ এ সব হবেই, কোনও ভাবেই সেটা আটকানো যাবে না৷ ফলে চুপ করে যাও৷ এটুকু তো বলা যায়, যা ঘটছে সেটাকে আমি মেনে নিচ্ছি না৷ সেটা কিন্ত্ত বলছিলেন না তাঁরা৷ বরং একটা স্ট্যাটিক মনোভাব তাঁদের মাথায় গেঁড়ে বসে ছিল৷

ওই এলাকাটা এক রকম 'শহরের ভেতর আরেকটা শহর'৷ কিন্ত্ত চুরমার হয়ে গেল পুরনো স্থাপত্য৷

অবশ্যই দুঃখের৷ এটা ভালো বুঝবেন, ২০০৬ থেকে একটানা আমার ডকুমেন্টেশনগুলো দেখলে৷ এটুকুই বলব, মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন-সবটাই স্পষ্ট ধরা আছে৷ সেটুকুই ভরসা৷ সেই সঙ্গে, শহরের প্রোডাকশান বেস্ড ফ্যাক্টরিগুলো যখন ক্রমে সারি্‌র্ভস সেক্টরে বদলে বদলে যাচ্ছে, সম্পূর্ণ পাল্টে যাচ্ছে সিটিস্কেপ, তখন আমার ছবিটির রাজনীতিটা কতটা প্রাসঙ্গিক, তা বোধহয় আর আলাদা ভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না৷
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/interviews/interview-of-director-ranu-ghosh/articleshow/31162964.cms

No comments:

Post a Comment