Friday, March 28, 2014

আজহারের মতো যেন না হন মাহি

আজহারের মতো যেন না হন মাহি

P1_DHONI
সব্যসাচী সরকার 

ঢাকা: উস্কোখুস্কো চুল, উজ্জ্বল দুটি চোখ৷ মুখের ভাষায় ধরা পড়ছে বিস্ময়৷ সদ্য ক্রীড়া সাংবাদিকতায় পা রাখা বছর চব্বিশের বাংলাদেশি যুবকের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠতে হয়৷ 'ওই লোকটা মানে ধোনিও কি আপনাদের আজহারউদ্দিনের মতো...না না, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে!' মিরপুর স্টেডিয়ামে ওই ধোনিপ্রেমী তরুণ সাংবাদিকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে গিয়ে কোথাও একটা অসহায়তা গ্রাস করে৷ কী বলব বা বলা উচিত, ঠিক করে উঠতে পারি না৷ কপি লিখতে শুরু করার আগে বিপন্ন বোধ করি৷ কি বোর্ডে হাত রাখতে গিয়ে আঙুল কেঁপে যায়৷

তিনি ভুল না ঠিক, দোষী না নির্দোষ, সেই বিচারের ভার আদালতের৷ কিন্তু দুই ফর্ম্যাটে বিশ্বকাপ জয়ী এবং একবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের রেকর্ড থাকা বিশ্বের একমাত্র অধিনায়ককে নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যে টানা পোড়েন বৃহস্পতিবার চলেছে, তা ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অবশ্যই বিরলতম ও নজিরবিহীন৷ হতে পারে শ্রীনিবাসনের চাপ ছিল, কিন্ত্ত মুকুল মুদগল কমিশনের সামনে বোর্ড প্রেসিডেন্টের জামাই গুরুনাথ মাইয়াপ্পানকে বাঁচাতে ভারত অধিনায়ক মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, এই মারাত্মক অভিযোগও তো করেছেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বিহারের আইনজীবী হরিশ সালভে৷ ধোনি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিচারপতি পট্টনায়েক, এ-ও তো মিথ্যে নয়৷

কলঙ্কের অধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন নয়৷ নতুন শতাব্দীর গোড়ায় দিল্লি পুলিশ ফাঁস করেছিল 'হ্যান্সিগেট'৷ তার পরে এ দেশের জনতা টিভিতে করণ থাপারের শো-তে তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কপিল দেবকে কাঁদতে দেখেছে, সিবিআইয়ের জেরার সামনে ভেঙে পড়তে দেখেছে আর এক ভারত অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিনকে৷ দেখেছে কী ভাবে ৯৯ টেস্ট খেলা আজহার আজীবন নির্বাসিত হয়ে খেলতে পারেননি ১০০ তম টেস্ট৷ আর তার পর ছাইভস্ম থেকে ভারতীয় ক্রিকেট উঠে দাঁড়িয়েছিল এক বঙ্গসন্তানের হাত ধরে৷ হ্যান্সিগেট পরবর্তী অধ্যায়ে সোনালি রেখা ও 'টিম ইন্ডিয়া' ধারণার জন্মই সৌরভ জমানায়৷

'আমরাও পারি' ভাবনার জন্ম যদি সৌরভের হাত ধরে হয়ে থাকে, পূর্ণতা অবশ্যই জনৈক মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে৷ সৌরভকে বাদ দিলে সচিন, সৌরভ বা কুম্বলেও দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন, কিন্ত্ত দুটো ফরম্যাটে বিশ্বকাপ এবং একই সঙ্গে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার বিরল কৃতিত্ব আর কারও নেই৷ গোটা বিশ্বেই নেই৷ জনমানসে এখনও গেঁথে আছে ২০১১-র ২ এপ্রিলের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম এবং ম্যাচ জেতানো ছক্কার পর ব্যাটটাকে নিঃশব্দে ঘোরানো৷ ফাইনালের দিন নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে তুলে আনা৷ কিংবা ২০০৭-এর সেপ্টেম্বরে জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স, যখন মারমুখী মিসবা উল হকের সামনে শেষ ওভার করার জন্য ডেকে নেওয়া অখ্যাত যোগিন্দর শর্মাকে৷ বা গত বছরের গ্রীষ্মে, ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ইশান্ত শর্মার করা সেই ওভার৷ যখন কেউ ভাবেনি, ওই সময় ইশান্তকে বল দেওয়া যেতে পারে৷

শ্রীনির 'পোষ্যপুত্র' হয়ে ওঠা নিয়ে অভিযোগ এখন ধোনির নামে উঠছে বটে, কিন্ত্ত সৌরভ জমানাতেও তো এই একই অভিযোগ ছিল ভারতীয় ক্রিকেটমহলের৷ ২০০২-এর ইংল্যান্ড সফরের সময় সৌরভের নামও তো হয়ে গিয়েছিল 'জিরো থ্রি থ্রি'৷ ০৩৩৷ যে নম্বরে ফোন করলেই জগমোহন ডালমিয়াকে পাওয়া যেত৷ রাজ সিং যেমন নয়ের দশকের গোড়ায় সিনিয়রদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে তরুণতম আজহারকে 'মি...ঞা ক্যাপ্টেন বনোগে?' বলেছিলেন৷ আসলে ভারতীয় বোর্ডের সংবিধান ও গঠনতন্ত্র বরাবর এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বোর্ড প্রেসিডেন্টকে প্রবল ক্ষমতাশালী করে রাখা হয়েছে৷ যে কারণে ক্রিকেটারদের অ্যাসোসিয়েশন তৈরির চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে৷ আর যিনিই অধিনায়ক হয়েছেন, তাঁকে বোর্ড প্রেসিডেন্টকে তুতিয়ে পাতিয়ে চলতে হয়েছে৷ না হলেই সরিয়ে দেওয়ার ভয় তাড়া করেছে৷

সচিন-সৌরভ-রাহুলরা যা পারেননি, ধোনি কী করে পারবেন? বোর্ড কর্তাদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, সিস্টেমকে মেনে নিয়েই তিনি দেশকে বিশ্বসেরা করার চেষ্টাটা করেছিলেন৷ আর তাতে সফলও৷ গ্রেগ চ্যাপেলকে এ দেশের আম জনতা যতই ব্রাত্য মনে করুক, 'ব্যক্তি বা তারকা নয়, দল আগে' সুলভ অস্ট্রেলীয় ভাবনা তিনিই প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটে এনেছিলেন৷ চ্যাপেল তো ক'দিন আগেও বলেছেন, একজন ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের যা যা গুণ থাকা দরকার, সব ক'টাই ধোনির মধ্যে দেখেছিলেন৷ অত প্রতিভাবান নন, কিন্ত্ত রাঁচির মতো জায়গা থেকে উঠে এসে বিশ্ব ক্রিকেটে ওয়ান ডে ফরম্যাটে অন্যতম সেরা অধিনায়ক ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফিনিশারের জায়গাটা করে ফেলার জন্য ভারতীয় ক্রিকেটে চিরস্থায়ী একটা আসন ধোনির জন্য থাকবে৷ সীমার মধ্যে থেকে সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার যে আকুতি যে কোনও স্বপ্নকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়, সচিন যাকে বলেন, 'ফলো ইওর ড্রিম', তার সার্থক রূপায়ণ তো ধোনির মধ্যেই আমরা দেখতে পাই৷

এ দেশের নতুন প্রজন্ম যতটা না মোদী বা রাহুলের, তার চেয়ে অনেক বেশি করে মহেন্দ্র সিং ধোনির৷ ভোটের আগে গলা কাঁপিয়ে ভাষণ বা দেশ গড়ার কাল্পনিক প্রতিশ্রুতি যার পরিচয় নয়৷ যিনি বাইশ গজের সঙ্কটে বারবার বিপদসঙ্কুল বৈতরণী পার করে দেশকে নিরাপদ কিনারায় পৌঁছে দিয়েছেন৷ আর সেটা টেলিভিশনের সৌজন্যে লোকে বারবার দেখতে পায়, রিলেট করতে পারে৷ সেই কারণেই এই বিশ্বকাপের মাঝে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ 'ক্যাপ্টেন কুল' এবং বিশ্ব জোড়া তাঁর ভক্তকুলকে এক মহাসঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে৷ একদিকে এতকাল ধরে অর্জিত সুনাম ও বিশ্বজয়ীর ভাবমূর্তি, অন্য দিকে সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার অশনিসঙ্কেত৷ মুকুল মুদগল কমিশনের সামনে গুরুনাথ মাইয়াপ্পানকে নিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য নিয়ে খুব বেশি জলঘোলা হওয়ার কথা নয়৷ ধরেই নেওয়া যেতে পারে, শ্রীনির চাপে ওই সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল ধোনিকে৷ 
http://eisamay.indiatimes.com/sports/cricket/let-there-not-be-another-azhar/articleshow/32828782.cms?

আর এই মামলায় সবচেয়ে যেটা তাত্‍পর্যের, ক্ষমতালোধী, দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বৈরাচারী একটা শ্রীনি চলে গেলে ভারতীয় ক্রিকেটের কিছুই এসে যাবে না৷ বরং শাপমুক্তি ঘটবে৷ কিন্ত্ত বিশ্বকাপের যখন আর দশ মাসও বাকি নেই, একটা ধোনিকে হারালে ভারত হারাবে ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিনিশার ও বিচক্ষণ এক অধিনায়ককে৷ তদন্তে আর কী কী বেরোবে, এখনই বলা কঠিন৷ চেন্নাই সুপার কিংস বা রাজস্থান র্যয়ালস নিষিদ্ধ হোক, তাতেও কিছু এসে যায় না৷ কিন্ত্ত ওইটুকুতেই যেন দাঁড়ি পড়ে৷ দোহাই ক্রিকেট-দেবতা, ধোনি যেন আর একটা আজহার না হয়ে যান! 

No comments:

Post a Comment