ইলিয়াসের গল্পে বাস্তবতার জাদু
বাংলা কথাসাহিত্যের প্রধান উপজীব্য গ্রামকেন্দ্রিক জীবন ও তার পরিবেশ। কখনো কখনো উচ্চবিত্ত, শহরে সমাজ জীবন কিংবা ফ্যান্টাসি জাতীয় চরিত্র গল্প নিয়ে কথাসাহিত্য রচিত হলেও আজো তার বড় অংশব্যাপী আছে গ্রামীণ জীবন। গ্রামীণ জীবনের চিত্র হল শাদা অর্থে নিম্নবিত্ত মানুষ, খেটে খাওয়া অসহায় রুগ্ণ মানুষ। যারা শ্রমিক, কৃষক কিংবা কখনো কাজহীন হতদরিদ্র। কথাসাহিত্যের বড় একটা অংশ এদের নিয়ে লেখা হলেও এ জাতীয় চরিত্ররা সবসময় সঠিকভাবে চিত্রিত হয়নি কিংবা মূল্যায়িত হয়নি। ইলিয়াস এদেরকেই সৃষ্টি করেছেন। উপজীব্য করেছেন গল্পে। ইলিয়াসের রচনার পরিমাণ অন্যদের চেয়ে যথেষ্ট নয়। এমন অভিযোগ বা আক্ষেপ থাকলেও সমাজকে ও সমাজের চরিত্রদের সূক্ষ্ম ও জটিল অবয়ব প্রকাশ করতে এমন কটা রচনাই তুলনারহিত। বিশ্ববিখ্যাত লেখক বোর্হেস স্বল্প রচনাকে এমনিভাবেই বলেছেন_ 'লেখকের বলার কথা থাকে সামান্যই।' এ সামান্য বলার মাঝেই থাকে মানুষ তথা তার চারপাশের সমাজ। যেখানে মানুষ কষ্টে, দুঃখে, শোষণে, বঞ্চনে, অনটনে বিপর্যস্ত। আবার সেই মানুষদেরই নতুন করে স্বপ্ন দেখার ইঙ্গিত প্রদান করে ইলিয়াসের চরিত্ররা। এমন চরিত্রকে মূলধন করেই ইলিয়াসের গল্পগুলো বাহাদুরি হয়ে উঠেছে। তার সর্বমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৮। তন্মধ্যে চিলেকোঠার সেপাই-১৯৮৬তে ও খোয়াবনামা (উপন্যাস)-১৯৯৬তে ও ২১টি প্রবন্ধ এবং একটি অপ্রকাশিত বক্তৃতা নিয়ে 'সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু' নামে প্রবন্ধ সংকলন। এ ছাড়া ছোটগল্পকারে ৫টি গল্পগ্রন্থ। এ ছোটগল্পগুলো হল_ যাত্রা, উৎসব, প্রতিশোধ, যোগাযোগ, ফেরারী, অন্যঘরে অন্যস্বর, খোঁয়ারি, অসুখ-বিসুখ, তারা বিবির মরদ পোলা, পিতৃবিয়োগ, মিলির হাতে স্টেনগান, দুধভাতে উৎপাত, পায়ের নিচে জল, দখল, কীটনাশকের কীর্তি, যুগলবন্দি, অপঘাত, দোজখের ওম, প্রেমের গপ্পো, ফোঁড়া, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, কান্না ও রেইনকোট। মোট ২৩টি ছোটগল্প। সংখ্যায় স্বল্প হলেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাবলি আমাদের সাহিত্যে খুব গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, সাহিত্য যদি জীবনের কথা বলা আবশ্যিক হয়ে থাকে তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরোধায় জীবন। উপাদান ও বিষয়ের যথার্থতা ও সত্যোৎসার উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাও তাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। বিশেষত ভাষা ও বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করাই তো লেখকদের উদ্দেশ্য-ইলিয়াসের উদ্দেশ্য।
গত শতাব্দীর ষাট দশক বাংলা কথাশিল্পকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করানো যায়। কেননা, এ দশকে আমরা পেয়েছি বেশ ক'জন কথাশিল্পীকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাড়াও মাহমুদুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রাহাত খান, আহমদ ছফা, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন ও কায়েস আহমেদ প্রমুখ শক্তিধর কথাশিল্পীকে। বোধ করি, ষাট দশকের প্রায় সব কথাশিল্পীই ভাষার দিকে তীব্র, তীক্ষ্মভাবে মনোযোগী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে ইলিয়াসও ব্যতিক্রম নন, তবে তার ভাষার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা প্রতীক এবং উপমায় আবর্ত। যার পরিণতিতে কখনো কখনো তার ইঙ্গিতময়তা জীবনবাস্তবতার ধার ঘেঁষে যায়।
ইলিয়াসের গল্পের বাস্তবটাও কখনো কখনো এতটা জাদুময় হয় যে, জাদুবাস্তবতা তার কাছে তুচ্ছ মস্নান হয়ে ওঠে। ইলিয়াসের গল্পগুলোতে তথাকথিত জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া নেই, আছে বাস্তবতার জাদু_ যে বাস্তবতা পাঠককে বিস্মিত করে, পাঠককে নিয়ে যায় বোধ ও অনুভবের এক আশ্চর্য পৃথিবীতে। তার অনেক গল্পের মাঝে বোঝা যায় যে, লেখক বোধ করি এই গল্পের মাঝে অনুপস্থিত আছেন এবং কাহিনীও চলে আপন গতিতে, ধাবিত হয় অনিবার্য এক পরিণতির দিকে কিন্তু পরিণত হয় চমকে দেওয়া এক আশ্চর্য বাস্তবতায়; যা ইচ্ছাপূরণের গল্পের মতো নয় বরং পাঠককে স্তম্ভিত করে দেয় অনির্বচনীয় সেই ক্ষরণ। আর সে জন্যই গল্পকার হিসেবে ইলিয়াস স্বতন্ত্র কিংবা বলা চলে ইলিয়াসের গল্প পৃথক মনোযোগ দাবি করে। আপাত পাঠ নয়, গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন হয় এ গল্পগুলোর রসাস্বাদনে। অনেকটা আখের মতো, প্রথমে কঠিন আবরণ, তবে চিবুতে চিবুতে মূল রসায়ন। উদ্ধৃতি টানছি_ 'দুই সারি মানুষের নেগেটিভ রেখা। ...সময়ের প্রচলিত বিভাগকে লোকটা আগ্রাহ্য করে। কি বালের ইনজেকশন দিয়া ঘুম পারাইয়া রাখে' (গল্প : মিলির হাতে স্টেনগান)। এ রকম ধারণা একটি সাদৃশ্য ভিত্তিক চুক্তিমাত্র, যা সম্ভাব্য কার্যকারণ সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে। ইলিয়াস যেন বাস্তবতার সহ-সম্পর্কগুলোকে দর্শক হিসেবে দেখে আবার ওই সহ-সম্পর্কে নিজে প্রবেশ করে দেখালেন, ওই স্থানে তিনি থাকলে কি করতেন? ফলে শিল্পীমাত্রই শ্রেণীহীন হতে হয়_ শ্রেণীহীন ইলিয়াস গুচ্ছ গুচ্ছ বাস্তবতা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষার অাঁধারে আরোহের প্রাথমিক কর্তব্যকে ফিরিয়ে এনে বাংলা ছোটগল্পের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
আখতারুজ্জামানের রচনা পাঠ সাহিত্যামোদীর কাছে সততই আনন্দময় অভিজ্ঞতা। আনন্দময় এ জন্য যে, লেখা পাঠ করার সময় মনে হয় নতুন কিছু পড়ছি_ এই নতুনত্ব পাওয়া যায় তার প্রকাশভঙ্গির মধ্যে, যার উপাদান ভাষা উপমা প্রতীক ইত্যাদি। আর দ্বিতীয়ত তার লেখার ভেতর দিয়ে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের জগৎটির মধ্যেই যে আরো নানান দেখবার ও বুঝবার দিক আছে আমরা তা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি। তার সমসাময়িক আরেক গল্পকার হাসান আজিজুল হকর ভাষায় 'এই ভাষা অতিবিশুদ্ধ ও সর্বোৎকৃষ্ট চোলাই, জিভ ঠেকানো মাত্রই মগজ নড়ে ওঠে। বাংলা ভাষার যাবতীয় শব্দ পঁচিয়ে তৈরি হয়েছে এক রকম রৌদ্র-পক্ব আরক। টলটলে স্ফটিকের মতো রং তার, ঝকঝকে ছুরির মতো ধার। কখনো মনে হতে পারে, এই ভাষা অতি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন খোলা বৈদ্যুতিক তার। কখনো বা অদ্ভুতভাবে মনে হতো, এই ভাষা ইলিয়াস বাস্তবের গায়ে ঠেকানো তা বাস্তবকে সঙ্গে সঙ্গে শুকে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।'
'ভাষা কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আসার অধিকার রাখে। কারণ, সমাজ স্বয়ং ভাষা থেকে অবিভাজ্য। সমাজে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের বাস্তব মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আর ভাষিক চিহ্নরূপে মতাদর্শ সৃষ্টি ভাষার দ্বারাই'_ মিখাইল বাখতিন। মতাদর্শ সম্পর্কে উৎপাদন তত্ত্বের প্রথম প্রস্তাবক ফরাসি মার্কসবাদী পিয়ের ম্যাশেরে বলেন_ 'লেখকের কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ না থাকলে তার পক্ষে ভালো লেখক হওয়া সম্ভব নয়।' তিনি এ বক্তব্যটিকে আরো সুনির্দিষ্ট করে বলেন, 'সাহিত্যে উৎপাদন হচ্ছে মতাদর্শের রূপান্তর।' এ থেকে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, তত্ত্বটি ইতিবাচক কথাশিল্পীদের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। ম্যাশেরের দাবি, সব লেখকই এই সূত্রের আওতাধীন, কেননা সবাই পূর্ব থেকেই বিরাজমান কাঁচামাল ব্যবহার করেই নিজের সাহিত্য উৎপাদন করেন। এ বাবদে স্বর্গত ক্ষিতিমোহন সেনের একাধিক রসালো উত্তর দেওয়া যেতে পারে_ 'ঘর লেপ্যা মুছ্যা, অাঁতুর ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর ক্যাছে বাচ্য চাইলেই তো আর বাচ্য পয়দা হয় না। নয় মাস দশ দিন সময় লাগে।' অর্থাৎ গল্পের ভেতরের সৌন্দর্যতাত্তি্বক রূপ প্রতিফলনের পরই গল্প সৃষ্টি হয়। ইলিয়াস বিষয় নির্ণয়ের জন্য যেমন অতীব সচেতন থাকেন তেমনি গল্পভাষা নির্মাণেও অধিক কাটাকাটি করতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তার গল্পের প্রতিটি শব্দ সুশৃঙ্খলভাবে বণ্টন না হয়েছে। তাঁর মতো অতৃপ্ত লেখক খুব কমই পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'দুর্দান্ত শক্তি' ছোটগল্পে তাঁর ডিটেলস এর জন্যই বোধ হয়? গল্প রচনায় গল্পের পরিবেশ সৃষ্টিতে, চরিত্র-চিত্রনে, ইঙ্গিতদানে, প্রতীকায়নে ইলিয়াস তার নিজস্ব ভাষা শৈলীকে প্রাধান্য দিয়েছেন, চরিত্রানুযায়ী ভাষা-ভঙ্গিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে কঠিন বাস্তবতার ভেতরে আবেগ বর্জিত টানা গদ্যের শরীরে কাব্যরসের স্ফুরণ ঘটানো। যেমন, 'অপঘাত' গল্পে মৃত শাহজাহান সম্পর্কে কাবেজের উক্তিটি সংবেদক পাঠকমনকে বেশ কাঁপিয়ে তোলে_ 'কাবেজ খুব যত্ন করে সাবান মাখায় আর বিড়বিড় করে ছোট থাকতে বড়ো দিঘীতে নিয়া কত গোসল কর্যা দিছি, কী দাপাদাপী করিছে। এখন তাঁই একটা কথাও কচ্ছে না গো।' কিংবা 'পায়ের নিচে জল' গল্পে 'আর খাবো না গো। নদী এহন জিরাবা নাগছে। বেশী খালে পরে নদীর হাগা ধরবো না?' অথবা 'দুধভাতে উৎপাত' গল্পে- 'জয়নাবের ছোট ছেলেটি আহমদ উল্লাহ পাছা ও উরুতে পাতলা গু নিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়ায়, তার দিকে কারো নজর নাই।' এমন গ্রামীণ পরিবেশের বর্ণনা সত্যিই অবাক করে দেয়। ভাবিয়ে তোলে। কী অসম্ভব শক্তিতে মগজে ঢুকেছে। নড়ে উঠেছে পাঠকের নিউরণ কোষগুলো। তেমনিভাবে 'নদীর হাগা' আর 'পাতলা গু' এসব অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের ফলে ইলিয়াসের গল্পগুলোকে শুধু বিশিষ্টতাই এনে দেয় না, ইলিয়াসও হয়ে ওঠেন বিশিষ্টজন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এমন একজন শক্তিমান কথাশিল্পী যার রচনায় শিল্পবোধের সাক্ষাৎ একটু বেশি মাত্রায় মেলে। এখানে তিনি অতিমাত্রায় সৎ-সাবলীল। ইলিয়াসের শ্রম, মেধা-মননের পরীক্ষা ও নিরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায় লক্ষণীয়। একজন মহৎ ও সৎ লেখকের লেখার মধ্যে যেমন থাকে কাহিনী নির্মাণের ক্ষমতা, চরিত্রদের দুর্দান্ত শক্তি, ইতিহাস, মিথ প্রকরণ, কুসংস্কার, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুখ তথা গোটা সমাজেরই দর্পণ তুলে ধরা। তথা প্রশ্নটা যখন সাহিত্যের তখন প্রচলিত সব অনিয়মকে ভেঙে নতুন কাঠামোকে কর্তৃত্ব দেওয়া। ইলিয়াসের গল্পগুলো প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নতুন ধারার গল্প লিখেছেন, কিন্তু বিষয়বস্তু ছিল চিরকালীন। একজন লেখকের দায়দায়িত্ব শুধু পাঠকদের নিছক রস জোগানই নয়, তাদের সৃষ্ট ও শৃঙ্খলা পথ বাতলে দেওয়া। ইলিয়াস জানতেন, লুকাচের দৃষ্টিভঙ্গি। লুকাচের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল_ 'সাহিত্যকর্ম তার নিজস্ব আঙ্গিক উৎস ব্যবহারের মাধ্যমে বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।' বাণিজ্যমুখী গল্পকারদের মতো এসি রুমে অথবা ইজিচেয়ারে দুলতে দুলতে তিনি কল্পনাশ্রয়ী হয়ে গল্প লেখেননি। ইলিয়াসের প্রতিটি লেখাই ছিল কষ্টকর ও বেদনাপ্রসূত। কাহিনীর পটে বারবার যাতায়াত করে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মুখের কথাকে ও তাদের বেদনাগুলি উপলব্ধ করে উপজীব্য করেছেন। এ কারণেই ইলিয়াসের চরিত্রদের কথোপকথন এত প্রাণবন্ত ও তাজা। তদুপরি অনেক প্রজ্ঞাবান তাত্তি্বকরা ইলিয়াসের গল্পের বর্ণনা বিস্তৃতি বহুমুখী এবং দীর্ঘতা বলে আপত্তি করেন। এ অভিযোগ মানতে আমার কিছুটা দ্বিধাও আছে। কারণ একটি গল্প সৃষ্টি করতে ইলিয়াস ভাবনার অথবা বাস্তবতার নানা সঙ্গ-প্রসঙ্গ এনেছে কিংবা জুড়ে দিয়েছে, যা অনেকের গল্পে মস্নান। সেই সব বাস্তবতার ধারক ও বাহকের ফাটলগুলো যদি দেখিয়ে দেওয়া যায় তাহলে গল্পে ডিটেলসের বিস্তৃতি হওয়া স্বাভাবিক। তবুও ইলিয়াস অনেক আগাছাকে কেটে কেটে গল্পগুলোকে সীমাবদ্ধতায় রেখেছেন। আর যদি বর্ণনার আধিপত্য অধিকতর হয়েই যায় তবে সে গল্পে আর যাই হোক প্রাণ থাকে না। কিন্তু ইলিয়াসের প্রতিটি গল্পই প্রাণ পেয়েছে।
আসলে ইলিয়াসের দেখার চোখটা ছিল বিশাল। কলমের ক্ষুরধার ছিল প্রখর। অনেক গল্পকার যেখানে দু'চার পৃষ্ঠা লিখেও মূলভাবটা প্রকাশে সক্ষম হননি সেখানে ইলিয়াস উজ্জ্বল। দু-তিন লাইন লিখেই মূল বিষয়বস্তু প্রকাশে সক্ষম। তৎসঙ্গে মিলিয়ে যায় সমাজের বহু বিচিত্রময় চরিত্র। মিখাইল বাখতিন যাদের বলেছেন, 'বহুকণ্ঠীয় রচনা'। যাতে করে ইলিয়াসের গল্পে দীর্ঘতা অনিবার্য।
যারা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তন্বিষ্ঠ পাঠক তাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, ইলিয়াসের রচনা বহুকাল ধরে এ দেশের পাঠকশ্রেণীকে পড়তে হবে এবং ওই পাঠের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি করতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব এবং চারিপাশ্র্বের মানুষকে, মাটিকে।
গত শতাব্দীর ষাট দশক বাংলা কথাশিল্পকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করানো যায়। কেননা, এ দশকে আমরা পেয়েছি বেশ ক'জন কথাশিল্পীকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাড়াও মাহমুদুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রাহাত খান, আহমদ ছফা, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন ও কায়েস আহমেদ প্রমুখ শক্তিধর কথাশিল্পীকে। বোধ করি, ষাট দশকের প্রায় সব কথাশিল্পীই ভাষার দিকে তীব্র, তীক্ষ্মভাবে মনোযোগী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে ইলিয়াসও ব্যতিক্রম নন, তবে তার ভাষার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা প্রতীক এবং উপমায় আবর্ত। যার পরিণতিতে কখনো কখনো তার ইঙ্গিতময়তা জীবনবাস্তবতার ধার ঘেঁষে যায়।
ইলিয়াসের গল্পের বাস্তবটাও কখনো কখনো এতটা জাদুময় হয় যে, জাদুবাস্তবতা তার কাছে তুচ্ছ মস্নান হয়ে ওঠে। ইলিয়াসের গল্পগুলোতে তথাকথিত জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া নেই, আছে বাস্তবতার জাদু_ যে বাস্তবতা পাঠককে বিস্মিত করে, পাঠককে নিয়ে যায় বোধ ও অনুভবের এক আশ্চর্য পৃথিবীতে। তার অনেক গল্পের মাঝে বোঝা যায় যে, লেখক বোধ করি এই গল্পের মাঝে অনুপস্থিত আছেন এবং কাহিনীও চলে আপন গতিতে, ধাবিত হয় অনিবার্য এক পরিণতির দিকে কিন্তু পরিণত হয় চমকে দেওয়া এক আশ্চর্য বাস্তবতায়; যা ইচ্ছাপূরণের গল্পের মতো নয় বরং পাঠককে স্তম্ভিত করে দেয় অনির্বচনীয় সেই ক্ষরণ। আর সে জন্যই গল্পকার হিসেবে ইলিয়াস স্বতন্ত্র কিংবা বলা চলে ইলিয়াসের গল্প পৃথক মনোযোগ দাবি করে। আপাত পাঠ নয়, গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন হয় এ গল্পগুলোর রসাস্বাদনে। অনেকটা আখের মতো, প্রথমে কঠিন আবরণ, তবে চিবুতে চিবুতে মূল রসায়ন। উদ্ধৃতি টানছি_ 'দুই সারি মানুষের নেগেটিভ রেখা। ...সময়ের প্রচলিত বিভাগকে লোকটা আগ্রাহ্য করে। কি বালের ইনজেকশন দিয়া ঘুম পারাইয়া রাখে' (গল্প : মিলির হাতে স্টেনগান)। এ রকম ধারণা একটি সাদৃশ্য ভিত্তিক চুক্তিমাত্র, যা সম্ভাব্য কার্যকারণ সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে। ইলিয়াস যেন বাস্তবতার সহ-সম্পর্কগুলোকে দর্শক হিসেবে দেখে আবার ওই সহ-সম্পর্কে নিজে প্রবেশ করে দেখালেন, ওই স্থানে তিনি থাকলে কি করতেন? ফলে শিল্পীমাত্রই শ্রেণীহীন হতে হয়_ শ্রেণীহীন ইলিয়াস গুচ্ছ গুচ্ছ বাস্তবতা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষার অাঁধারে আরোহের প্রাথমিক কর্তব্যকে ফিরিয়ে এনে বাংলা ছোটগল্পের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
আখতারুজ্জামানের রচনা পাঠ সাহিত্যামোদীর কাছে সততই আনন্দময় অভিজ্ঞতা। আনন্দময় এ জন্য যে, লেখা পাঠ করার সময় মনে হয় নতুন কিছু পড়ছি_ এই নতুনত্ব পাওয়া যায় তার প্রকাশভঙ্গির মধ্যে, যার উপাদান ভাষা উপমা প্রতীক ইত্যাদি। আর দ্বিতীয়ত তার লেখার ভেতর দিয়ে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের জগৎটির মধ্যেই যে আরো নানান দেখবার ও বুঝবার দিক আছে আমরা তা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি। তার সমসাময়িক আরেক গল্পকার হাসান আজিজুল হকর ভাষায় 'এই ভাষা অতিবিশুদ্ধ ও সর্বোৎকৃষ্ট চোলাই, জিভ ঠেকানো মাত্রই মগজ নড়ে ওঠে। বাংলা ভাষার যাবতীয় শব্দ পঁচিয়ে তৈরি হয়েছে এক রকম রৌদ্র-পক্ব আরক। টলটলে স্ফটিকের মতো রং তার, ঝকঝকে ছুরির মতো ধার। কখনো মনে হতে পারে, এই ভাষা অতি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন খোলা বৈদ্যুতিক তার। কখনো বা অদ্ভুতভাবে মনে হতো, এই ভাষা ইলিয়াস বাস্তবের গায়ে ঠেকানো তা বাস্তবকে সঙ্গে সঙ্গে শুকে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।'
'ভাষা কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আসার অধিকার রাখে। কারণ, সমাজ স্বয়ং ভাষা থেকে অবিভাজ্য। সমাজে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের বাস্তব মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আর ভাষিক চিহ্নরূপে মতাদর্শ সৃষ্টি ভাষার দ্বারাই'_ মিখাইল বাখতিন। মতাদর্শ সম্পর্কে উৎপাদন তত্ত্বের প্রথম প্রস্তাবক ফরাসি মার্কসবাদী পিয়ের ম্যাশেরে বলেন_ 'লেখকের কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ না থাকলে তার পক্ষে ভালো লেখক হওয়া সম্ভব নয়।' তিনি এ বক্তব্যটিকে আরো সুনির্দিষ্ট করে বলেন, 'সাহিত্যে উৎপাদন হচ্ছে মতাদর্শের রূপান্তর।' এ থেকে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, তত্ত্বটি ইতিবাচক কথাশিল্পীদের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। ম্যাশেরের দাবি, সব লেখকই এই সূত্রের আওতাধীন, কেননা সবাই পূর্ব থেকেই বিরাজমান কাঁচামাল ব্যবহার করেই নিজের সাহিত্য উৎপাদন করেন। এ বাবদে স্বর্গত ক্ষিতিমোহন সেনের একাধিক রসালো উত্তর দেওয়া যেতে পারে_ 'ঘর লেপ্যা মুছ্যা, অাঁতুর ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর ক্যাছে বাচ্য চাইলেই তো আর বাচ্য পয়দা হয় না। নয় মাস দশ দিন সময় লাগে।' অর্থাৎ গল্পের ভেতরের সৌন্দর্যতাত্তি্বক রূপ প্রতিফলনের পরই গল্প সৃষ্টি হয়। ইলিয়াস বিষয় নির্ণয়ের জন্য যেমন অতীব সচেতন থাকেন তেমনি গল্পভাষা নির্মাণেও অধিক কাটাকাটি করতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তার গল্পের প্রতিটি শব্দ সুশৃঙ্খলভাবে বণ্টন না হয়েছে। তাঁর মতো অতৃপ্ত লেখক খুব কমই পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'দুর্দান্ত শক্তি' ছোটগল্পে তাঁর ডিটেলস এর জন্যই বোধ হয়? গল্প রচনায় গল্পের পরিবেশ সৃষ্টিতে, চরিত্র-চিত্রনে, ইঙ্গিতদানে, প্রতীকায়নে ইলিয়াস তার নিজস্ব ভাষা শৈলীকে প্রাধান্য দিয়েছেন, চরিত্রানুযায়ী ভাষা-ভঙ্গিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে কঠিন বাস্তবতার ভেতরে আবেগ বর্জিত টানা গদ্যের শরীরে কাব্যরসের স্ফুরণ ঘটানো। যেমন, 'অপঘাত' গল্পে মৃত শাহজাহান সম্পর্কে কাবেজের উক্তিটি সংবেদক পাঠকমনকে বেশ কাঁপিয়ে তোলে_ 'কাবেজ খুব যত্ন করে সাবান মাখায় আর বিড়বিড় করে ছোট থাকতে বড়ো দিঘীতে নিয়া কত গোসল কর্যা দিছি, কী দাপাদাপী করিছে। এখন তাঁই একটা কথাও কচ্ছে না গো।' কিংবা 'পায়ের নিচে জল' গল্পে 'আর খাবো না গো। নদী এহন জিরাবা নাগছে। বেশী খালে পরে নদীর হাগা ধরবো না?' অথবা 'দুধভাতে উৎপাত' গল্পে- 'জয়নাবের ছোট ছেলেটি আহমদ উল্লাহ পাছা ও উরুতে পাতলা গু নিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়ায়, তার দিকে কারো নজর নাই।' এমন গ্রামীণ পরিবেশের বর্ণনা সত্যিই অবাক করে দেয়। ভাবিয়ে তোলে। কী অসম্ভব শক্তিতে মগজে ঢুকেছে। নড়ে উঠেছে পাঠকের নিউরণ কোষগুলো। তেমনিভাবে 'নদীর হাগা' আর 'পাতলা গু' এসব অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের ফলে ইলিয়াসের গল্পগুলোকে শুধু বিশিষ্টতাই এনে দেয় না, ইলিয়াসও হয়ে ওঠেন বিশিষ্টজন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এমন একজন শক্তিমান কথাশিল্পী যার রচনায় শিল্পবোধের সাক্ষাৎ একটু বেশি মাত্রায় মেলে। এখানে তিনি অতিমাত্রায় সৎ-সাবলীল। ইলিয়াসের শ্রম, মেধা-মননের পরীক্ষা ও নিরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায় লক্ষণীয়। একজন মহৎ ও সৎ লেখকের লেখার মধ্যে যেমন থাকে কাহিনী নির্মাণের ক্ষমতা, চরিত্রদের দুর্দান্ত শক্তি, ইতিহাস, মিথ প্রকরণ, কুসংস্কার, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুখ তথা গোটা সমাজেরই দর্পণ তুলে ধরা। তথা প্রশ্নটা যখন সাহিত্যের তখন প্রচলিত সব অনিয়মকে ভেঙে নতুন কাঠামোকে কর্তৃত্ব দেওয়া। ইলিয়াসের গল্পগুলো প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নতুন ধারার গল্প লিখেছেন, কিন্তু বিষয়বস্তু ছিল চিরকালীন। একজন লেখকের দায়দায়িত্ব শুধু পাঠকদের নিছক রস জোগানই নয়, তাদের সৃষ্ট ও শৃঙ্খলা পথ বাতলে দেওয়া। ইলিয়াস জানতেন, লুকাচের দৃষ্টিভঙ্গি। লুকাচের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল_ 'সাহিত্যকর্ম তার নিজস্ব আঙ্গিক উৎস ব্যবহারের মাধ্যমে বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।' বাণিজ্যমুখী গল্পকারদের মতো এসি রুমে অথবা ইজিচেয়ারে দুলতে দুলতে তিনি কল্পনাশ্রয়ী হয়ে গল্প লেখেননি। ইলিয়াসের প্রতিটি লেখাই ছিল কষ্টকর ও বেদনাপ্রসূত। কাহিনীর পটে বারবার যাতায়াত করে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মুখের কথাকে ও তাদের বেদনাগুলি উপলব্ধ করে উপজীব্য করেছেন। এ কারণেই ইলিয়াসের চরিত্রদের কথোপকথন এত প্রাণবন্ত ও তাজা। তদুপরি অনেক প্রজ্ঞাবান তাত্তি্বকরা ইলিয়াসের গল্পের বর্ণনা বিস্তৃতি বহুমুখী এবং দীর্ঘতা বলে আপত্তি করেন। এ অভিযোগ মানতে আমার কিছুটা দ্বিধাও আছে। কারণ একটি গল্প সৃষ্টি করতে ইলিয়াস ভাবনার অথবা বাস্তবতার নানা সঙ্গ-প্রসঙ্গ এনেছে কিংবা জুড়ে দিয়েছে, যা অনেকের গল্পে মস্নান। সেই সব বাস্তবতার ধারক ও বাহকের ফাটলগুলো যদি দেখিয়ে দেওয়া যায় তাহলে গল্পে ডিটেলসের বিস্তৃতি হওয়া স্বাভাবিক। তবুও ইলিয়াস অনেক আগাছাকে কেটে কেটে গল্পগুলোকে সীমাবদ্ধতায় রেখেছেন। আর যদি বর্ণনার আধিপত্য অধিকতর হয়েই যায় তবে সে গল্পে আর যাই হোক প্রাণ থাকে না। কিন্তু ইলিয়াসের প্রতিটি গল্পই প্রাণ পেয়েছে।
আসলে ইলিয়াসের দেখার চোখটা ছিল বিশাল। কলমের ক্ষুরধার ছিল প্রখর। অনেক গল্পকার যেখানে দু'চার পৃষ্ঠা লিখেও মূলভাবটা প্রকাশে সক্ষম হননি সেখানে ইলিয়াস উজ্জ্বল। দু-তিন লাইন লিখেই মূল বিষয়বস্তু প্রকাশে সক্ষম। তৎসঙ্গে মিলিয়ে যায় সমাজের বহু বিচিত্রময় চরিত্র। মিখাইল বাখতিন যাদের বলেছেন, 'বহুকণ্ঠীয় রচনা'। যাতে করে ইলিয়াসের গল্পে দীর্ঘতা অনিবার্য।
যারা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তন্বিষ্ঠ পাঠক তাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, ইলিয়াসের রচনা বহুকাল ধরে এ দেশের পাঠকশ্রেণীকে পড়তে হবে এবং ওই পাঠের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি করতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব এবং চারিপাশ্র্বের মানুষকে, মাটিকে।
http://www.dainikdestiny.com/index.php?view=details&type=main&cat_id=1&menu_id=57&pub_no=114&news_type_id=1&index=2&archiev=yes&arch_date=09-03-2012
No comments:
Post a Comment