তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা
২৮ জানুয়ারি ২০১৪,মঙ্গলবার, ‘আমাদের সময়’পত্রিকায় একটি নিজস্ব প্রতিবেদন- ‘বীরাঙ্গনাদের কেন মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না- সরকারের কাছে তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে চলতি বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে বীরাঙ্গনাদের তালিকা প্রস্তুত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না এবং গত ৪২ বছর বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেওয়া কেন বেআইনি ঘোষনা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।”
অনেক দেরিতে হলেও মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত বাংলাদেশ সরকার বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত বীরাঙ্গনা যারা জীবিত আছেন তাঁরা নিজে অথবা যারা সম্ভ্রম আর জীবন একসাথে হারিয়েছেন তাঁদের স্বামী, সন্তান, ভাইবোন, বাবা-মা যাঁরা আছেন তারা কি সবাই মাথা উঁচু করে অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসবেন? এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য তালিকাভুক্ত হতে চাইবেন? আমরা তো তাদের ভুলে যাইনি। মনের মধ্যে অনেক যত্নকরে তাঁদের স্মৃতি দিনের পর দিন ধারণ করে লালন করে আসছি।
দেশের স্বাধীনতার জন্যে বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, আত্মহুতির ভয়ংকর সেই স্মৃতি মনে করে এখনো শিউরে উঠি। মাঝে মাঝেই মনে হয় আমরা কি তাঁদের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পেরেছি? সামাজিক রীতি-নীতি, বিধি-নিষেধ, সংস্কারের বাইরে এসে কি মাথা উঁচু করে বলতে সাহায্য করেছি মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের আবদানের কাহিনি? জীবিত যাঁরা আছেন তাঁদের সন্তানেরা কি সগর্বে মাথা উঁচু করে বলতে পেরেছে- তারা সেই বীরাঙ্গনার সন্তান যাঁরা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে?
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন অবদান রেখেছেন। আমাদের উচিত কৃতজ্ঞতার সাথে তাঁদের স্মরণ করা।যতটুকু মনে আছে, সেসময়ের গোপালগঞ্জের দুইজন নারী নেত্রী যাঁদের নাম, যাঁদের চেহারা আমি শ্রদ্ধার সাথে এখনো মনে করতে পারি। এতোদিন আগের সেই তাঁদের সাহসী চেহারা স্মরণ করে আমি এখন অবাক হই মাঝে মাঝে। মুক্তিযুদ্ধে এই সাহসী দুই নেত্রীর অবদান কতোজন জানেন,কতোজনই-বা মনে রেখেছেন? (আমি এখানে তাঁদের নাম উল্লেখ করতে চাইনা, যদি আমার এই লেখা তাঁদের কাছে পৌঁছাতে জানাতে চাই, লেখার মাধ্যমে জানাতে চাই তাঁদের বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁরা আমার বড় বোনের বান্ধবী, আমার কাছে তাঁরা পরম শ্রদ্ধেয়, অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব)। যাঁদের স্লোগানের ধ্বনি সেসময় কলেজ চত্বর, স্কুল প্রাঙ্গণ, রাস্তা, মাঠের সভা মুখরিত করে রেখেছেন। রাস্তায় রাস্তায় মিছিলের সামনে সেসময় তাঁরা নেত্রিত্ব দিয়েছেন। দেশ স্বাধীনের স্বপ্নের গল্প শুনিয়েছেন সবাইকে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখার মতো ছিল সেই সাহসিক সৌন্দর্য!
তখন না বোঝা সেসব স্মৃতি মনে করে এখন আঁতকে উঠি। যুদ্ধের সময় সরকারি চাকরির কারণে বন্দুকের নলের সামনে অফিস করতে হয়েছে আমার আব্বার। শহরে তখন আমাদের গৃহবন্দি জীবন। তখন খেলা মানে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। গল্প মানে যুদ্ধের গল্প। কথা মানে যুদ্ধে কথা। যতদূর মনে আছে, ঠিক সেই সময়ে গোপালগঞ্জ শহরের দুই প্রান্তের সেই দুই সাহসী নেত্রীকে পাকিস্তান আর্মিদের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জিম্মি হিসেবে আটক করে, সেই সাথে একজনের বাবাকে পাকিস্তান আর্মিদের অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট (তৎকালীন গোপালগঞ্জের সদর সার্কেল অফিসের হেড কোয়ার্টার এলাকা)-এর টর্চারিং সেলে (সদর সার্কেল অফিস হেড কোয়ার্টারের অডিটরিয়াম) ধরে নিয়ে আসা হয়। অন্য আর একজনের বাবা না থাকায় তাঁর নিকট এক আত্মীয়কে ধরে নিয়ে আসে সেই টর্চারিং সেলে।
তখন না বুঝে অনেক কিছু জানতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে।এখন সব বুঝে অবাক হই। গর্বিত হই এই ভেবে যে, এতো বড় যুদ্ধ আমি নিজর চোখে দেখেছি। পাকিস্তান আর্মিদের পৈশাচিক নির্যাতনে মুমূর্ষু প্রায় বাবা আর আত্মীয়কে বাঁচানোর জন্যে সেই দুই নেত্রী গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে সেচ্ছায় ধরা দিতে হয়েছিলেন পাকিস্তান আর্মিদের কাছে। সেদিনই কিছু পরে শহরের মুসলিম লীগের প্রভাবশালী এক নেতার সহযোগিতায় তাঁদের আর্মিদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল। যতদূর মনে আছে, তাঁরা আবার শহর ছেড়ে প্রথমে নিরাপদ আত্মগোপনে চলে যান এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। তাঁদের সেই দুঃসাহসীকতা কতজন মনে রেখেছে,কতজন জানে? যাঁরা নিশ্চিত মৃত্যু জেনে দেশের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে নিরাপদ আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, মৃত্যুর মতো শঙ্কাকে জেনেও অনিশ্চয়তায় পাকিস্তান আর্মিদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে আমাদের দায়, জাতির দায়। তাঁরা আমাদের অহংকার? তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
যুদ্ধ শেষে লাশ হয়ে পড়ে থাকা বীরাঙ্গনাদের দেখে ভয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করেছিলাম। পাকিস্তান আর্মিরা যুদ্ধে হেরে গিয়ে যেদিন গোপালগঞ্জ শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, সেদিন বিকেলে মানুষের মিছিলে মিশে গিয়ে পাকিস্তান আর্মিদের টর্চারিং সেলের পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে পড়ে থাকা লাশগুলোর মধ্যে ৫/৬টি অর্ধগলিত নারীদের লাশ দেখেছিলাম। এখনো মনে আছে, কারো অর্ধগলিত নাকে আটকে আছে জ্বলজ্বলে নাকফুল, কারো প্রায় খসে পড়া হাতের মাংসের সাথে আটকে আছে ধবধবে সাদা শাখা, কারো প্রায় বের হয়ে আসা খুলির সাথে আটকে আছে লম্বা চুলের বিনুনি। বীভৎস সেই দৃশ্য! এরা দেশের জন্যে জীবন দিয়েছিলেন, মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছিলেন, সম্ভ্রোম হারিয়েছিলেন। আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব সেইসব বীরাঙ্গনাদের খেতাব নিতে কেউ কি কখনো এগিয়ে এসেছেন কিনা জানি না। এঁদের বীরত্বগাঁথা কেউ কি সগর্বে বর্ণনা করতে এগিয়ে এসেছেন কিনা জানি না। আমি এখনো শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের মনে করি। মনের মধ্যে তাঁদের স্মৃতি সযত্নেধারণ করে আছি। তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা মেশানো অনন্ত ভালোবাসা।
সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম,
অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ।
অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ।
[মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। এর দায় কোনোক্রমেই পরিবর্তন ডটকমের নয়।]
http://www.poriborton.com/post/46384/%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE
No comments:
Post a Comment