Friday, March 21, 2014

বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখিআবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার ষাটের ও সত্তরের দশকের পুরনো ডায়েরিগুলো ঘাঁটছিলাম। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, প্রায় প্রতিবছরের ডায়েরিতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কিছু না কিছু কথা রয়েছে। এত কথা আর কারো সম্পর্কে নেই। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৪৯ সালে। তখন আমি বরিশাল শহরে স্কুলের ছাত্র, পরের বছর (১৯৫০) ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। অবশ্য তখন আমি ডায়েরি লিখি না। কিন্তু শৈশব ও কৈশোরের অনেক কথাই আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। ডায়েরি লেখা শুরু করি অনেক অনেক পরে।
পুরনো ডায়েরির পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। যখন নানা ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেছি, তখন এগুলোর গুরুত্ব বুঝিনি। এখন এগুলো পড়তে গিয়ে দেখছি, ঘটনাগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ডায়েরিতে আরো বিশদভাবে তা লিখে রাখা উচিত ছিল। অনেক ঘটনা ভুলে গেছি। এখন মনে পড়তেই দেখছি, এগুলো ইতিহাসের অমূল্য দলিল। আমি খুবই অগোছালো একজন মানুষ। যদি আমার সারা জীবনের লেখা, সংগৃহীত কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে পারতাম, তাহলে স্মৃতিকথা লিখতে গেলেও দেশের ও দশের অতীত ইতিহাসের এমন সব বিস্মৃত কথার রেকর্ড রেখে যেতে পারতাম, যা ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের হয়তো কাজে লাগত।
সে বছর কী কারণে পুরনো ডায়েরিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম মনে নেই। আমার অনুজপ্রতিম কলামিস্ট ও ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন তখন লন্ডনে। সেদিন তিনি আমার বাসায়। তাঁকে আমার ডায়েরিতে লেখা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত কোনো কোনো অংশ পড়ে শোনাতেই তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আপনার ডায়েরিতে এত সব কথা লেখা আছে, যা নিয়ে আপনার একটা আলাদা বই করা উচিত। একবারে না পারেন, ধারাবাহিকভাবে কোনো কাগজে লেখা শুরু করুন। আপনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে ঢাকার কোনো প্রথম শ্রেণীর কাগজের সঙ্গে কথা বলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।
মামুনের উৎসাহ দেখে আমি তখন তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়েছিলাম। মামুন বলেছিলেন, আমি আপনার এই লেখাটার শিরোনামও ঠিক করে ফেলেছি। এই লেখার শিরোনাম হবে 'বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি।' তারপর আমার বেলায় যা হয়, আলস্য ও বিভিন্ন কাগজের জন্য প্রায় রোজই কলাম লেখার ধান্ধায় আর ডায়েরিগুলো থেকে খুঁজে পেতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত অংশগুলো বের করে আলাদা করে লেখা হয়ে ওঠেনি। মামুনের ইচ্ছাও আর পূর্ণ করতে পারিনি।
এত বছর পরও যে বহু বছরের ডায়েরিগুলো খুঁজে পেতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার সব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কাহিনী আলাদা করতে পেরেছি, তা নয়। তবে মনে হয়েছে, স্মৃতি ও ডায়েরিগুলো নির্ভর করে লেখা যদি একবার শুরু করে দিই, তাহলে একটি বড় বই-ই সম্ভবত শেষ করে যেতে পারব। দৈনিক কালের কণ্ঠের এবারের (২০১৩) ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা পাঠানোর অনুরোধ আসতেই ভাবলাম, যতটা লিখতে পেরেছি, সেটাই প্রথম খণ্ড হিসেবে পাঠিয়ে দিই। এভাবে আয়ুতে কুলালে তিন খণ্ডে বইটি শেষ করব।
মুনতাসীর মামুনের সেই কয়েক বছর আগের উৎসাহদানের কথা মনে রেখে এ লেখাটির শিরোনাম রেখেছি 'বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি'। তবে প্রথম খণ্ডের উপশিরোনাম 'বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়'। ব্রিটেনের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের একজন একান্ত সচিব চার্চিল সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম I was a shadow of churchil (আমি চার্চিলের একজন ছায়াসঙ্গী ছিলাম)। এই একান্ত সচিবের একটি মন্তব্য আমার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, 'একজন মহামানবের অতি কাছে থেকে বোঝা যায় না, তিনি কত বড় মহামানব। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে গেলে এই সত্যটা চোখে ধরা পড়ে।' চার্চিলের একজন একান্ত সচিবের এ উক্তিটির যথার্থতা আমার উপলব্ধিতেও ধরা পড়েছে।
আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী কখনো ছিলাম না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার কৈশোরে দেখা হওয়ার পর থেকে সেই যে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালো লাগার শুরু, তা কখনো কখনো রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও নষ্ট হয়নি। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁর সম্পর্কে কখনো খুব কড়া সমালোচনা লিখলেও তিনি মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়েছেন কি না জানি না; কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করেননি। হয়তো সেদিনই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁর যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছি, সেটি কেন যৌক্তিক, তা আমাকে কাছে বসিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
যত দিন তাঁর কাছে ছিলাম, ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম, তিনি যে কত বড়মাপের মহামানব, তা বুঝতে পারিনি। তিনি চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেছি, কী বিরাট মহীরুহের ছায়াতলে বসেও তাঁর বিরাটত্ব অনুমান করতে পারিনি। তখন তাঁর একান্ত কাছাকাছি থেকে বুঝতে পারিনি, যে মানুষটির এত কাছে আছি, তিনি ক্ষণজন্মা পুরুষ। ইতিহাসে তাঁর মতো মানুষ কদাচিৎ আবির্ভূত হন। আমি জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী, লেনিনকে দেখিনি। কিন্তু আমার পরম সৌভাগ্য, আমি এ যুগের ইতিহাসের একজন ক্ষণজন্মা মানুষকে দেখার ও তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছি। এ ধরনের পরম সৌভাগ্য আমার পরবর্তী প্রজন্মের আর কারো দূরভবিষ্যতেও কখনো হবে কি না জানি না।
আমি নেতা মুজিবকে দেখেছি। মানুষ মুজিবকেও দেখেছি। বিস্ময়ের কথা এই যে নেতা মুজিব ও মানুষ মুজিবের মধ্যে বড় কোনো পার্থক্য ছিল না। কঠোরে-কোমলে মিশ্রিত একটি উদার মনের মানুষ। মানুষকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। চরম শত্রুকেও ক্ষমা করতে জানতেন। কথাটি বললে অত্যুক্তি হয় না, তাঁকে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এ ইতিহাসের আমি একজন সমকালীন প্রত্যক্ষদর্শী, এটাই আমার জীবনের পরম গৌরব।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, তখন তিনি ছাত্রনেতা থেকে যুবনেতা। ছাত্রনেতা থাকাকালেই তিনি 'শেখ মুজিব'- এই একটি নামে সর্বত্র পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁকে আমি বরিশালের ছাত্রসভায় প্রথম ছাত্রনেতা হিসেবে দেখি। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার আগে গণতান্ত্রিক কর্মী শিবিরের অন্যতম নেতা হিসেবে তাঁর নাম শুনেছি। দেখেছি নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। তারপর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। দেখেছি ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী দ্বন্দ্ব এবং আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের সময় তাঁর ভূমিকা। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা, যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তাঁর যুক্ত নেতৃত্বদান।
সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তিনি ছিলেন পুরোধা। পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা যখন চক্রান্ত করছিলেন রবীন্দ্রসংগীত বর্জন ও বাংলা বর্ণমালা লোপ করে বাংলা ভাষায় রোমান হরফ প্রবর্তনের, তখন পূর্ব পাকিস্তানে প্রগতিশীল যুবসমাজ যে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলে, শেখ মুজিব সেসব আন্দোলনে ছিলেন নেতৃত্বের সারিতে। রবীন্দ্রসাহিত্য বর্জনের প্রশ্নে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা- বিশেষ করে আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড বিরোধ হয়। আইয়ুব আমলে সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে একদল শিল্পী-সাহিত্যিকের দ্বারা যে যুক্ত বিবৃতি দেওয়ানো হয়, আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন তার অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
বাংলা ভাষাকে 'ইসলামীকরণের' ব্যাপারেও আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রবীণ নেতার সঙ্গে তাঁর বিরোধ হয়েছে। বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ছয় দফা আন্দোলন শুরু করার সময়ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়। তিনি জেলে নিক্ষিপ্ত হন। তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়। সেই মামলা থেকে তিনি মুক্ত হয়ে সিংহের বেশে বেরিয়ে আসেন। আমি তাঁকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম, 'সিংহকে শেকলে বাঁধে শৃগালের দল'। কবিতাটি 'দৈনিক ইত্তেফাকে' প্রকাশিত হয়েছিল।
সত্তরের নির্বাচনী অভিযানে আমি তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের বহু জেলা ঘুরে বেরিয়েছি। তাঁকে বারবার জেলে যেতে দেখেছি। একাত্তরের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাষণ শুনেছি। তাঁর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি। দেশ ছেড়েছি। তারপর আবার যখন দেশে ফিরে এসেছি, তখন আমার মাতৃভূমি স্বাধীন। গণভবনে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি, চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছেন। বলেছেন, তুমি এসেছ? এত দেরি করলে কেন? আমি পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছি জানুয়ারি মাসে। আর তুমি কলকাতা থেকে ফিরলে ফেব্রুয়ারি মাসে। কারণটা কী? আমি ভয় পেয়েছিলাম, তোমার নামও শহীদ সাংবাদিকদের তালিকায় আছে কি না! আমার সিরাজ নেই (শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেন), মুনীর চৌধুরী নেই, শহীদুল্লাহ কায়সার নেই। দেশে ফিরে তুমিও নেই দেখলে বড় কষ্ট পেতাম।
এত বড় শালপ্রাংশু-দেহ মানুষটি আমার মতো একজন সামান্য মানুষ ও সাংবাদিকের জন্য এত কাতর হয়ে পড়েছেন দেখে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি। তারপর বলেছি, আমি কলকাতায় আটকে গিয়েছিলাম। আপনি যেদিন (১০, জানুয়ারি ১৯৭২) দেশে ফিরে আসন, সেদিন আমার স্ত্রী ছিলেন কলকাতার এক হাসপাতালে। ওই দিনই আমার একটি মেয়ে হয়েছে। তাই সময়মতো দেশে ফিরতে পারিনি।
তিনি অসম্ভব খুশি হলেন। বললেন, মেয়ের নাম কী রেখেছ?
বললাম, আমাদের দেশ স্বাধীন করার কাজে ইন্দিরা গান্ধী যে বিশাল সাহায্য জুগিয়েছেন, সে জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য মেয়ের নাম রেখেছি ইন্দিরা।
শেখ মুজিব, তখন আমি তাঁকে ডাকতাম মুজিবভাই, আমার কথা শুনে মাথা দুলিয়ে বললেন, খুব ভালো করেছ। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার আবার দেখা হলে তাঁকে বলব, আমার দেশের মানুষ আপনার প্রতি কত কৃতজ্ঞ, তা দেখুন। আমার দেশের এক সাহিত্যিক ও সাংবাদিক তার মেয়ের নাম রেখেছে ইন্দিরা।
স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবেও বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। কোনো পরিবর্তন নেই। সেই একই পত্নীগতপ্রাণ স্বামী, সন্তানবৎসল পিতা, জনপ্রিয় নেতা, জননায়ক ও রাষ্ট্রের স্থপতি। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এ দুটি নাম যেন অভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ থেকে বাকশালে ও ধর্মতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে দেশটিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক সমাজবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশটির উত্তরণ ঘটানোর উদ্যোগ- বঙ্গবন্ধুর কী বিশাল ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল, সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা ও স্বার্থান্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে তা উপলব্ধি করার জাতীয় মানস এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের ইতিহাস এখনো বিভ্রান্তি ও বিকৃতির কুয়াশামুক্ত হয়নি। এ কুয়াশামুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের আরো দু-এক প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে। এ কুয়াশা থেকে যেদিন আমাদের মুক্তি ঘটবে, সেদিনই আমরা প্রত্যক্ষ করব বাংলার বুকে আরেক হিমালয়ের অস্তিত্ব। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কেউ কেউ বললেন, শেখ মুজিব ছিলেন গ্রিক ট্র্যাজেডির হিরো। আমি এ কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। গ্রিক ট্র্যাজেডির হিরোদের পতন ঘটেছে। শেখ মুজিবের পতন হয়নি। তাঁর মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি মৃত্যুঞ্জয় হয়েছেন লিঙ্কন, গান্ধী, মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো। তাই মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরও বঙ্গবন্ধু এই নামটি বাংলাদেশে এত বেশি জাগ্রত। তিনি হাজার বছরের লোকায়ত বাংলার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ। এই দুর্গটি ভাঙার অবিরাম চেষ্টা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু দুর্গটি ভাঙা যাচ্ছে না।
আমি এই মানুষটিকে দেখেছি। এত কাছে থেকে দেখেছি আর এত সান্নিধ্য পেয়েছি যে আজ তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মনে হয়, সবই বুঝি কল্পনা। পুরনো ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে দেখি, না, তা আমার কল্পনা নয়। একদিন তা ছিল আমার জীবনের পরম বাস্তব সত্য, বাস্তব অভিজ্ঞতা।
এ অভিজ্ঞতার কথাই আজ লিখতে বসেছি। কাছে ছিলাম বলেই এই বিরাট পুরুষের সবটা আমি দেখতে পেয়েছি- সে দাবি করব না। যেটুকু দেখতে পেয়েছি, ততটুকুই লিখব। তাঁর জীবনী লিখব না। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিচার ও বিশ্লেষণেও যাব না। আমি এই ব্যক্তি-মানুষটিকে ২৬ বছর (১৯৪৯-৭৫) ধরে কাছে ও দূরে থেকে যতটা দেখেছি, ততটাই শুধু লিখব। নিজেও জীবন-সায়াহ্নে এসে পৌঁছেছি। যখনই তাঁকে মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি- 'মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা, তোমার দয়া
রবে চির পাথেয় চির যাত্রায়।'
এক.
আজ থেকে ৬৪ বছর আগের কথা। ১৯৪৯ সালের কাহিনী। আমি তখন বরিশাল শহরে আজমত আলী খান ইনস্টিটিউটে (এ.কে. স্কুল) ক্লাস নাইনের ছাত্র। দেশভাগ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে পূর্ববঙ্গ হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। তখনো পঞ্চাশের সেই কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। বরিশালে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রভাব তখনো অক্ষুণ্ন। ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ শুরু হয়নি।
বরিশালের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন তখন উজ্জীবিত। প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ছাড়াও দুটি অত্যন্ত শক্তিশালী বাম রাজনৈতিক সংগঠন ছিল- কমিউনিস্ট পার্টি (অভিভক্ত) ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি)। এদের ছাত্রফ্রন্ট ছিল। কংগ্রেসের স্টুডেন্টস কংগ্রেস। মুসলিম লীগের মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্ট ছিল ছাত্র ফেডারেশন।
এ সময় বরিশালে মুসলিম লীগ দলীয় জাঁদরেল ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দীন আহমদ। শেষ জীবনে তিনি আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা ছিলেন। যদিও পরিচিত ছিলেন ন্যাপনেতা মহিউদ্দীন আহমদ নামে। নিজের ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক শক্তির জোরে তিনি পরে বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও উঠে আসেন। এ সময় বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন আজিজুদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী। পরে খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় যোগ দেন।
এ সময় বরিশালে একটি ঘটনা ঘটে। মহিউদ্দীন আহমদ রাজনীতি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত থাকতেন বলে লেখাপড়ায় তেমন মন দিতে পারতেন না। ফলে পরীক্ষার রেজাল্ট তেমন ভালো ছিল না। সে বছর তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের আইএসসির ছাত্র ও পরীক্ষার্থী। তিনি পরীক্ষা দিতে হলে গেলেন, কিন্তু পরীক্ষার হল থেকে বহিষ্কৃত হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি পরীক্ষা দিতে বসে নকল করছিলেন, দুজন শিক্ষক তাঁকে ধরে ফেলেন ও তাঁকে হল থেকে বহিষ্কার করেন।
মহিউদ্দীন আহমদ এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর পক্ষ থেকে দাবি করা হলো, তিনি যেহেতু মুসলিম লীগের একজন জনপ্রিয় যুবনেতা, সেহেতু কংগ্রেসের সমর্থক দুজন হিন্দু শিক্ষক তাঁকে ষড়যন্ত্র করে তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য পরীক্ষার হল থেকে বের করে দিয়েছেন।
শহরে বিরাট উত্তেজনা দেখা দিল। স্কুল-কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ছাত্ররা মহিউদ্দীন আহমদের পক্ষে। অন্যদিকে হিন্দু ও অসাম্প্রদায়িক-মনা কিছু মুসলিম ছাত্র মহিউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে একদিন শহরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হলো। দাবি মহিউদ্দীন আহমদকে পরীক্ষার হলে ফিরিয়ে নিতে হবে; দুজন হিন্দু অধ্যাপককে বরখাস্ত ও কলেজ থেকে বহিষ্কার করতে হবে। হরতাল শেষে বিরাট গণমিছিল ও জনসমাবেশ করা হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়।
পাকিস্তান হওয়ার পর এই প্রথম বরিশাল শহরে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিবাদ ও বিভক্তি দেখা দেয়। বিএম কলেজের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা হরতাল সমর্থনের প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শহরের বিএম স্কুল, চৈতন্য স্কুল ইত্যাদির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা হরতালের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজমত আলী খান ইনস্টিটিউট (এ. কে. স্কুল), জেলা স্কুলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ছাত্ররা হরতালের দাবি সমর্থনের পক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তখন স্কুলের ছাত্র হলেও ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছি। একটি অসাম্প্রদায়িক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আমার বিরাগ ছিল। মুসলিম ছাত্রলীগে যোগ না দিয়ে আমি আরএসপির ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলাম। অবিভক্ত বাংলায় ছাত্র কংগ্রেস ডান ও বামপন্থী- এই দুভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে এক ভাগের অফিস ছিল বলে তার পরিচয় ছিল ছাত্র কংগ্রেস (কর্নওয়ালিস স্ট্রিট), অপর ভাগের অফিস মির্জাপুর স্ট্রিটে ছিল বলে তার পরিচয় ছিল ছাত্র কংগ্রেস (মির্জাপুর স্ট্রিট)। এই শেষোক্ত ছাত্র কংগ্রেসই ছিল বামপন্থী, বিশেষ করে আরএসপির নিয়ন্ত্রণাধীন। আমি আরএসপির ছাত্রফ্রন্টের সঙ্গেই যুক্ত ছিলাম।
চল্লিশের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বরিশালে আরএসপি ছিল খুবই শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। কমিউনিস্ট পার্টি ও তার ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের মতোই শক্তিশালী ছিল আরএসপি ও তার ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র কংগ্রেস। হাঁটিহাঁটি পা পা মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের খুবই মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্র ও যুবক কেউ কমিউনিস্ট পার্টি এবং কেউ কেউ আরএসপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বরিশালে আরএসপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পরবর্তীকালের প্রখ্যাত তিন ব্যক্তিত্ব- মোজাম্মেল হক, আবদুল খালেক খান ও শামসুদ্দীন আবুল কালাম। মোজাম্মেল হক অনেক পরে (১৯৬৫) অধুনালুপ্ত দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক থাকাকালে কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। আবদুল খালেক খান দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের শেষে ঢাকায় নব্বইয়ের দশকে মারা যান। আর বিখ্যাত কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালাম রোমে প্রবাস জীবন যাপন করাকালে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাঁর কবর রয়েছে।
১৯৪৯ সালের বরিশাল শহরে এই আরএসপির ছাত্রফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত থাকায় মুসলিম ছাত্রলীগের ডাকা হরতালে যোগ দিতে আমার ও এ. কে. স্কুলের আরো কয়েকজন সমমনা ছাত্রের আপত্তি ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, এ হরতালে বা ছাত্র মিছিলে যোগ দিতে যাব না। এ সময় বরিশাল শহরে একটা খবর ছড়িয়ে পড়ল, মুসলিম ছাত্রলীগের দুজন প্রাক্তন নেতা ঢাকা থেকে বরিশালে আসছেন। একজন শাহ আজিজুর রহমান ও অন্যজন শেখ মুজিবুর রহমান।
এ দুটি নামের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল দুটি কারণে। শাহ আজিজুর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই প্রায় সমবয়সী এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমানে মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) ছাত্র থাকাকালে একই সময়ে কলেজের ছাত্রাবাস বেকার হোস্টেলে ছিলেন। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রাদেশিক মুসলিম লীগে দুটি ধারা দেখা দেয়। একটি প্রগতিশীল এবং অন্যটি রক্ষণশীল ধারা। রক্ষণশীল ধারাটি পরিচিত ছিল নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপ ও প্রগতিশীল ধারাটি পরিচিত ছিল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নামে।
মূল সংগঠন মুসলিম লীগে এই গ্রুপিং সৃষ্টি হওয়ায় তার ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রলীগেও গ্রুপ তৈরি হয়, নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপের নেতা হন শাহ আজিজুর রহমান। হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে নেতা হন শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রামের স্কুলে ছাত্র থাকাকালেই এই দুটি নাম, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের আগে গ্রামগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগের পুনর্গঠনের কাজ চলছে। শেখ মুজিবের অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি। তিনি ছাত্রলীগ পুনর্গঠনের জন্য সারা বাংলা চষে বেরিয়েছেন। যেখানে যেতে পারেননি, সেখানে তাঁর অনুসারীরা গেছেন। ফলে ১৯৪৬ সাল থেকে মুসলিম ছাত্রলীগের মূলত নিয়ন্ত্রণ ছিল হাশিম-সোহরাওয়ার্দীপন্থী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সমমনা বন্ধুদের হাতে।
বরিশালেও মুসলিম ছাত্রলীগে দুভাগ দেখা দেয়। আগে মহিউদ্দীন আহমদ ও বাহাউদ্দীন আহমদ- এই দুই ছাত্রনেতা ছিলেন পরস্পরের গভীর বন্ধু, পরে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে বাহাউদ্দীন আহমদ ও তাঁর বন্ধু শামসুল হক চৌধুরী (টেনু মিয়া) হাশিম-সোহরাওয়ার্দীপন্থী ছাত্রলীগ অংশের নেতা হন। মহিউদ্দীন আহমদ থাকেন নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ সমর্থক অংশে। ছাত্রলীগের এই অংশের কেন্দ্রীয় নেতা শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে মহিউদ্দীন আহমদের গভীর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিল।
মহিউদ্দীন আহমদকে পরীক্ষার হল থেকে বহিষ্কারের প্রতিবাদ ও কলেজের দুজন হিন্দু অধ্যাপককে বরখাস্তের দাবিতে বরিশাল শহরে যে ছাত্র মিছিল হয়, তা খুব বড় হয়নি। কারণ বাহাউদ্দীন ও টেনু চৌধুরীর ছাত্রলীগের অংশ এবং স্কুল-কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছাত্ররা তাতে যোগ দেয়নি। অনেক মুসলমান ছাত্রও দেয়নি। মহিউদ্দীন আহমদের পক্ষের আন্দোলনে সমর্থন দান ও তা জোরদার করার জন্যই শাহ আজিজুর রহমান বরিশালে আসছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান কেন আসছেন তখন আমরা তা জানতে পারিনি।
পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। পরে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমিন। শাহ আজিজুর রহমান ছাত্রলীগের সরকার সমর্থক অংশের নেতা এবং এই দুই নেতারই খুব ঘনিষ্ঠ। মহিউদ্দীন আহমদ ও মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগের সরকার সমর্থক অংশের নেতা-কর্মীরা তাঁকে শহরের স্টিমারঘাটে অভ্যর্থনা জানিয়ে ফজলুল হক এভিনিউ সংলগ্ন খেলাফত নামে তখনকার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে নিয়ে আসেন। পত্রিকাটি মহিউদ্দীন আহমদ চালাতেন। সম্পাদক ছিলেন তাঁর গ্রুপের ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আলী আশরাফ। পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আলী আশরাফও মুসলিম লীগ রাজনীতি ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দিয়েছিলেন।
ওই দিন বিকেলেই বরিশাল টাউন হলে (অশ্বিনীকুমার হলে) শাহ আজিজ মুসলিম লীগ কর্তৃক আয়োজিত এক ছোটখাটো জনসভায় যোগ দেন এবং ঘোষণা করেন, মহিউদ্দীন আহমদ বিএম কলেজের সাম্প্রদায়িক হিন্দু শিক্ষকদের বিষ নজরে পড়েছেন। তাঁর পক্ষে জনমত রয়েছে। সরকারের নির্দেশে তাঁর ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে, তার প্রতিকার করা হবে। পর দিন তিনি স্টিমারযোগে ঢাকায় ফিরে যান। মহিউদ্দীন আহমদ আবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কলেজের দুই হিন্দু অধ্যাপককে বরখাস্ত করা হয়েছিল কি না আমার স্মরণ নেই।
শাহ আজিজুর রহমানকে দেখে ও তাঁর বক্তৃতা ও কথাবার্তা শুনে আমি খুব ইমপ্রেসড হইনি। ছোটখাটো মানুষ, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। তখন বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষা করার জন্য চারদিকে গুঞ্জন চলছে। তিনি সে সম্পর্কে কথা বলতে নারাজ। মন্ত্রীদের মতো তাঁর হাবভাব ও কথাবার্তা। সব সময় মুখে এক কথা, ভারত ও কমিউনিস্টরা হচ্ছে পাকিস্তান নামক শিশুরাষ্ট্রের ঘোরতর শত্রু। তাদের এজেন্টরা পাকিস্তানের সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সম্পর্কে সাবধান। তিনি জেলা মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। ডিসির (তখন বলা হতো ডিএম বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) বাড়িতে ডিনার খেলেন। তারপর ঢাকায় ফিরে গেলেন।
এর কয়েক দিন পরই বরিশালে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আগেই শুনেছিলাম, তিনি ছিপছিপে পাতলা চেহারার মানুষ হলেও দীর্ঘদেহী সুপুরুষ। তাঁর বক্তৃতা থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরোয়। নাজিমুদ্দীন-নূরুল আমিন সরকারের তিনি কঠোর সমালোচক। তিনি মুসলিম লীগের হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের যুবনেতা ছিলেন। দেশভাগের পর মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। তাঁর প্রগতিমনা বন্ধুদের সঙ্গে মিশে গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির গড়ে তুলেছেন। যাকে বলা চলে, এ দেশের মুসলিম লীগের কার্যত প্রথম বিরোধী দল। এই কর্মী শিবিরের জঠর থেকেই পরে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
বরিশাল শহরে সেই ৬৪ বছর আগে শাহ আজিজুর রহমানকে দেখার জন্য আমার মনে তেমন আগ্রহ জন্মায়নি; তাঁকে দেখেও খুব উৎসাহবোধ করিনি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার জন্য আমার মনে আগ্রহ জন্মেছিল। আমি বাম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। শেখ মুজিব ছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নেতা। তাহলে তাঁর প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম কী জন্য? সে কথাটা আগে লিখছি।
আমাদের পরিবারের আরিফ চৌধুরী (কবি আসাদ চৌধুরীর বাবা) ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। তিনি হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে ছিলেন। তখন এই গ্রুপের একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল মিল্লাত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশিম নিজে। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। আরিফ চৌধুরী এ পত্রিকাটি তাঁর গ্রামের ঠিকানায় নিয়মিত আনতেন। ফলে আমরাও পড়ার সুযোগ পেতাম।
এই কাগজে মাঝেমধ্যে খবর দেখতাম, শেখ মুজিবুর রহমান নামে এক ছাত্রনেতা কলকাতায় ক্লাইভ স্ট্রিটের নাম পাল্টে নবাব সিরাজদ্দৌলা রোড নাম করার দাবি তুলেছেন। তিনি অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসা ও তাঁর পরিবারকে সাহায্যদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এবং বেসরকারিভাবে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এক খবরে বলা হয়েছিল, ইসলামিয়া কলেজের এক ছাত্র বিতর্কসভায় তিনি বলেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর ভাষা বাংলা, যেহেতু বাংলাই পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হওয়া উচিত। তা ছাড়া ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের সময় মুসলিম ছাত্রলীগের যে অংশটি ছিল বাংলা ভাগের ঘোর বিরোধী ও স্বাধীন যুক্তবাংলা গঠনের পক্ষে, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই অংশের অন্যতম প্রধান নেতা।
১৯৪৯ সালে বরিশালে এসে তখনকার যুবক নেতা শেখ মুজিব কার বাসায় উঠেছিলেন সে কথা আমার এখন স্মরণ নেই। হয়তো তাঁর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় উঠেছিলেন। বরিশালে মুসলিম ছাত্রলীগের সরকারবিরোধী অংশের নেতা তখন কাজী গোলাম মাহবুব (পরে ভাষাসৈনিক), কাজী বাহাউদ্দীন আহমদ (পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে চিফ পাসপোর্ট অফিসার) এবং শামসুল হক চৌধুরী টেনু মিয়া। কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী।
কাজী বাহাউদ্দীন থাকতেন বরিশাল শহরে ফকিরবাড়ী রোডের মসজিদসংলগ্ন এক বাসায়। আমিও ওই ফকিরবাড়ী রোডেই তিনটি দোতলা টিনের বাড়ি নিয়ে তৈরি উলানিয়া হাউসে মাঝে মাঝে থাকতাম। বাড়িটি ছিল গোলাম কাদের চৌধুরীর। তিনি আমার চাচা। তখন থেকেই আমি লেখালেখি করি বলে কাজী বাহাউদ্দীন আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একদিন উলানিয়া হাউস থেকে আমি রাস্তায় বেরোতেই তাঁর মুখোমুখি হলাম। তিনি বললেন, ঢাকা থেকে শেখ মুজিব এসেছেন। তুমি তাঁর নাম শুনেছ?
বললাম, শুনেছি। তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।
বাহাউদ্দীন বললেন, তিনি আজ বিএম কলেজ ছাত্রাবাসের কমনরুমে আয়োজিত এক ঘরোয়া সভায় বক্তৃতা দেবেন। তুমি আসবে?
: ওটা তো ছাত্রলীগের সভা। আমি ছাত্র কংগ্রেসের সদস্য।
বাহাউদ্দীন বললেন, তা আমি জানি। তবে এটা কেবল ছাত্রলীগের সভা নয়, সাধারণ ছাত্রদের ঘরোয়া সভা। শেখ মুজিব দেশের বর্তমান অবস্থা এবং ছাত্রদের করণীয় কী সে সম্পর্কে কথা বলবেন। তুমি তো সাপ্তাহিক নকীব কাগজে রিপোর্টও লিখে থাকো। এই সভার রিপোর্টও লিখতে পারবে।
আমি উৎসাহিত বোধ করলাম। বললাম, যাব।
বরিশালে এখন বেশ কয়েকটি দৈনিক কাগজ। পাকিস্তান হওয়ার আগে ছিল মাত্র দুটি সাপ্তাহিক- বরিশাল হিতৈষী ও কাশিপুর নিবাসী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছরেই প্রকাশনা শুরু হয় সাপ্তাহিক নকীবের। 'বরিশাল হিতৈষীর' বয়স তখন ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। সম্পাদক ছিলেন শ্রীদুর্গামোহন সেন। ১৯৪৬ সালে আমি যখন তাঁকে প্রথম দেখি তখন তাঁর বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। তখনো কর্মক্ষম এবং গৌরবর্ণ সুপুরুষ।
তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন, দুজনই জেলা কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। গান্ধীর ডাকে আন্দোলনে যোগ দিয়ে একাধিকবার জেল খেটেছেন। আমি যখন বরিশালে স্কুলের ছাত্র এবং গল্প-কবিতা লেখা শুরু করেছি, তখন একদিন দুর্গামোহন কাকা বললেন, তোমার লেখার হাত তো ভালো। শহরের সভা-সমিতিতেও যাও। এসব সভায় ছোট ছোট রিপোর্ট লিখে আমাকে দাও না কেন? হিতৈষীতে ছাপব। আমি তা লেখা শুরু করেছিলাম। আমার রিপোর্টগুলো তিনি ছাপতেন। শিরোনাম ছিল 'সমাচার সন্দেশ'।
১৯৫০ সাল পর্যন্ত দুর্গামোহন সেন বরিশালেই ছিলেন, বরিশাল হিতৈষী পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। তাঁর দেশত্যাগের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু পঞ্চাশ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার পর তিনি বরিশাল ছেড়ে শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে বাধ্য হন। কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কাছেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি।
'নকীব' কাগজের সম্পাদক ছিলেন নূর আহমদ। তখন মধ্যবয়স্ক, কাঁচাপাকা দাড়ির একজন সুদর্শন মানুষ। তিনি কলকাতা থেকেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সহযোগিতায় সাপ্তাহিক নকীব প্রকাশ করেছিলেন। কাগজটির নাম 'নকীব' নজরুলই রেখেছিলেন। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা নকীবেই প্রকাশিত হয়েছিল। নূর আহমদ সাহেব শুধু দক্ষ সাংবাদিক ছিলেন না, একজন নাট্যকার এবং গল্প লেখকও ছিলেন। ছিলেন নজরুল অনুরাগী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের একজন।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর নূর আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় না গিয়ে বরিশালে চলে আসেন। তিনি ভোলা এলাকার লোক। বরিশালে এসে শহরের গির্জা মহল্লায় অবস্থিত হামিদিয়া প্রেসের (এখন আছে কি না জানা নেই) মালিক আবদুল হামিদ চৌধুরীর সহযোগিতায় ১৯৪৭ সালেই নকীব কাগজ প্রকাশ শুরু করেন।
আমি স্কুলের ছাত্র। কিন্তু অর্থকষ্টে ভুগছি। নানাভাবে লেখাপড়ার খরচ চালাই। জানতে পারলাম, নকীব-সম্পাদক নূর আহমদ ছাত্রজীবনে আমাদের গ্রাম উলানিয়ায় কিছুকাল ছিলেন। আমার বাবা-চাচা সবাইকে চেনেন। ভাবলাম, তাঁর কাছে গেলে নকীবে ছোটখাটো রিপোর্ট লিখে যদি যৎসামান্য টাকা পাই, তাহলে লেখাপড়াটা চালাতে পারব।
একদিন সাহসে বুক বেঁধে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমার পরিচয় পেয়ে এবং তাঁর কাগজে ছোটখাটো রিপোর্ট লিখব জেনে খুশি হলেন। কিন্তু আমার টাকার প্রয়োজন জেনে বললেন, রিপোর্টিংয়ের জন্য টাকা দিতে পারব না। তবে তুমি যদি প্রুফ রিডিং জানো এবং আমাকে প্রুফ রিডিংয়ে সাহায্য করতে পারো, তাহলে তোমাকে কিছু টাকা দিতে পারব।
আমি তখন প্রুফ রিডিং জানতাম না। কিন্তু অল্পদিনে শিখে নিলাম। নকীবের জন্য রিপোর্ট লেখার পাশাপাশি এই প্রুফ রিডিংয়ের জন্য আমার মাসিক পারিশ্রমিক ধার্য হলো কুড়ি টাকা। তখনকার দিনের কুড়ি টাকা। আমার আনন্দ আর ধরে না।
শেখ মুজিব প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ফকিরবাড়ী রোডে উলানিয়া হাউসের সামনে বাহাউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি যখন আমাকে বিএম কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের সরকারবিরোধী অংশের সভায় যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানালেন। তখন নকীবে এই সভার রিপোর্ট করতে পারব ভেবে খুশি হলাম এবং সহজেই রাজি হলাম।
কাজী বাহাউদ্দীন আমাকে জানিয়েছিলেন, সন্ধ্যার পর সভাটি হবে। শেখ মুজিব এবং কাজী গোলাম মাহবুব বক্তৃতা করবেন। আমি সেদিন স্কুল ছুটি হতেই গির্জা মহল্লায় (প্যারেরা রোড) হামিদিয়া প্রেস-ভবনের দোতলায় গিয়ে হাজির হলাম, সেটাই ছিল সাপ্তাহিক নকীবের দপ্তর। ভেবেছিলাম, নূর আহমদ সাহেব শেখ মুজিবের নাম জানেন না এবং তাঁর মতো তরুণ ছাত্রনেতার সভার কথা জেনে উৎসাহ বোধ করবেন না। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনে বললেন, খুব ভালোভাবে তাঁর মিটিংয়ের খবরটি কভার করতে হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যেসব ছাত্রনেতা তাঁর ডান হাত ছিলেন, যেমন আনোয়ার (নেংড়া আনোয়ার নামে পরিচিত), নূরুদ্দীন আহমদ (পরে গ্রিন অ্যান্ড হোয়াইটের নূরুদ্দীন নামে পরিচিত) প্রমুখ তাদের মধ্যে শেখ মুজিবই ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সবচেয়ে কাছের।
নূর আহমদ সাহেব আরো বললেন, খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ভয় করেন। ওদিকে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানও ভয় পান তাঁকে। ফলে দুজনে ষড়যন্ত্র করে নানা বিধিনিষেধ দিয়ে সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে দিতে চান না। সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর ও করাচিতে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন এবং জিন্নাহ-মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে আসার সুযোগ খুঁজছেন। এখানেও সরকারবিরোধী দল খাড়া করতে চান। শেখ মুজিবকে একটু টিপে দেখো তো এ দল গঠনের প্রস্তুতি সম্পর্কে কোনো খবর বের করতে পার কি না।
আমি তাঁর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে সেদিন সন্ধ্যায়ই ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রাবাসে গিয়ে হাজির হলাম। একটা রুমে (সম্ভবত কমনরুম) ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো যুবক বসে আছেন। সম্ভবত অধিকাংশই কলেজছাত্র। তাঁদের মধ্যে আমিই হয়তো একমাত্র স্কুলছাত্র। পরিচিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী বাহাউদ্দীন, শামসুল হক চৌধুরী টেনু মিয়াও ছিলেন। আর ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র ফেডারেশনের স্বদেশ বসু (পরবর্তীকালের ড. স্বদেশ বসু), আরএসপির ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র কংগ্রেসের নির্মল সেন (পরবর্তীকালে নির্মলদা নামে পরিচিত বিখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিক)। আরো ছিলেন আরশাদ আলী নামে আবুল হাশিমের ভক্ত এক ছাত্রনেতা। আরো অনেক পরিচিত মুখ ছিল, সবার কথা মনে নেই।
শেখ মুজিবুর রহমান নির্দিষ্ট সময়ে সভাকক্ষে ঢুকলেন। না, তাঁর গায়ে মুজিব কোট ছিল না। ঠোঁটে পাইপ ছিল না। পাতলা ছিপছিপে চেহারা, পরনে সাদা পাজামা, গায়ে কালো রঙের শেরোয়ানি। ঠোঁটে পাতলা কালো গোঁফ। চোখের দ্যুতি প্রখর। ওই বয়সেই তাঁর ব্যক্তিত্ব মানুষকে কাছে টানে। কাজী গোলাম মাহবুবসহ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি কোলাকুলি করলেন। একটা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, 'এখানেও আমাকে টিকটিকি পেছু ছাড়ছে না।'
টিকটিকি মানে সরকারি গোয়েন্দা। শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সম্মুখ সারির ছাত্রনেতা ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানেও তাঁর পেছনে সরকারি গোয়েন্দারা লেগে আছে। আজ বুঝতে পারি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ দল ক্ষমতা হাতে পেয়ে প্রথমেই পাকিস্তানকে 'পুলিশি স্টেটে' পরিণত করেছিল।
প্রথমেই কাজী গোলাম মাহবুব বক্তৃতা দিলেন। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর বক্তৃতা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজে যে আলোড়ন চলছে, তা আন্দোলনে রূপ নিতে যাচ্ছে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবি দিবস হিসেবে পালিত হয়। মাহবুব জানালেন, ভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবি এখন আর বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষা করা নয়, দাবি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার।
তাঁর বক্তৃতা থেকেই জানতে পারলাম, মুসলিম ছাত্রলীগের সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী অংশ এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই বিভক্ত। শাহ আজিজুর রহমানের সমর্থক অংশের নাম নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থক সরকারবিরোধী অংশটির নাম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (নিখিল কথাটি এই অংশের নামের পেছনে ছিল না)। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি এই ছাত্রলীগের জন্ম। নইমউদ্দীন আহমদ (পরে অ্যাডভোকেট) ছিলেন এই ছাত্রলীগের প্রথম কনভেনর। ওই বছরই জিন্নাহ যখন কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দিতে গিয়ে উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে আবার ঘোষণা (প্রথম ঘোষণা রমনার জনসভায়) দেন, তখন এই নইমউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বেই কয়েকজন ছাত্র নো নো বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। নইমউদ্দীন আহমদ গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের জন্মের এক বছর পরে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্ম।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন এবং নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। তিনি তাঁর জিন্নাহ মুসলিম লীগ বিলোপ করে অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনর নির্বাচিত হন। অর্থাৎ তিনি হন আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
সুতরাং শেখ মুজিব যখন ১৯৪৯ সালে বরিশালে আসেন (আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছু আগে) তখনো তিনি ছাত্রজীবন শেষ না করা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করত।
আমার এখন দুঃখ হয়, বরিশালে সেই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় প্রথম শোনা শেখ মুজিবের সেই বক্তৃতা কেন পুরোপুরি লিখে সংগ্রহ করে রাখিনি। সাপ্তাহিক নকীবে তাঁর বক্তৃতার সে অংশটুকু প্রকাশিত হয়েছিল, সে অংশটুকুও আর খুঁজে পাইনি। তখন আমি ডায়েরি লেখা শুরু করিনি। ফলে তাঁর বরিশালে আসার দিন-তারিখও সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না।
তবে তাঁর বক্তৃতার কিছু কিছু কথা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ভাষা বিতর্ক সম্পর্কে কিছু কথা বলার পরই তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং ছাত্রসমাজের করণীয় সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। তাঁর গলায় যে বজ্রের আওয়াজ লুকিয়ে আছে, সেদিন তাঁর প্রথম বক্তৃতা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি বললেন, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিদের দান সর্বাধিক। এখন সেই পাকিস্তানে বাঙালিদের সব অধিকার হরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা ইংরেজদের বদলে পাঞ্জাবিদের শাসক হিসেবে পেয়েছি। এই পাঞ্জাবি শাসকেরা ইংরেজ শাসকদের চেয়েও নিষ্ঠুর শাসক এবং শোষক। আমাদের মুখ থেকে শুধু ভাষা কেড়ে নেওয়ার হুকুম জারি হয়নি। আমাদের জাতি-পরিচয়, সংস্কৃতি-সভ্যতা পর্যন্ত ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
'শেখ মুজিবের কথায় ফরিদপুরের আঞ্চলিক ভাষার টান ছিল। আমার পাশেই বসেছিলেন নির্মল সেন। তিনিও ফরিদপুরের লোক। তখন সম্ভবত বিএম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্সের ছাত্র। তিনি বললেন, 'শেখ মুজিব আমাগো জেলার লোক।' অর্থাৎ ফরিদপুরের লোক। অনেক বছর পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক, তখন লন্ডনের 'টাইমস' কাগজের এক প্রতিবেদনে তাঁকে বলা হয়েছিল, 'এ পোয়েট অব পলিটিকস' (একজন রাজনীতির কবি)।
কথাটা অত্যুক্তি নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ তো ছিলই। সেই সঙ্গে তাঁর কথায় এমন জাদু ছিল যে তাঁর বাংলায় আঞ্চলিকতার টান থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হতো। বরিশাল বিএম কলেজে সেই সন্ধ্যায় তিনি বললেন, 'পাকিস্তান আন্দোলন সফল করেছে বাঙালি মুসলমানরা। শেরে বাংলা ফজলুল হক পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্ব দিয়ে মুসলিম লীগকে বিরাট জয়ের অধিকারী না করলে পাকিস্তান অর্জন সম্ভব হতো না। এখন পাকিস্তানে এই দুই বাঙালি নেতাই কোণঠাসা। উর্দুভাষী ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে এনে পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আলা পদে বসানো হয়।'
'ভাইয়েরা, দুঃখের কথা কী বলব! কোনো দেশভাগ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশ রাজধানী শহরটি পায়। কলকাতা শহর আমাদের পাওয়ার কথা। পূর্ববঙ্গের নীল, পাট, তুলা, রেশমের টাকা এবং শ্রমিকদের মেহনতে কলকাতা নগরী গড়ে উঠেছে। র‌্যাডক্লিফ সাহেবের রায়ে সেই শহর চলে গেল সংখ্যালঘু অংশ পশ্চিমবঙ্গের হাতে। কেন গেল? কারণ র‌্যাডক্লিফ কমিশনে বাঙালি মুসলমানের পক্ষ থেকে কলকাতা পাওয়ার যুক্তি উত্থাপনের কোনো যোগ্য বাঙালি মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদলে রাখা হয়নি।'
'র‌্যাডক্লিফ কমিশনে কলকাতাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত রাখার পক্ষে যুক্তি উত্থাপনের জন্য এ কে ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো যোগ্য এবং বিখ্যাত আইনজীবী থাকা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতিনিধিদলে যুক্ত করা হয়নি। যুক্ত করা হয়েছে আই আই চুন্দ্রিগড় এবং আরো একজন অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতাকে। একজন বাঙালি উকিলকে রাখা হয়েছিল, তিনি জুনিয়র উকিল হামিদুল হক চৌধুরী (হামিদুল হক চৌধুরী তখন একজন জুনিয়র উকিল ছিলেন)।'
'এই কমিশনেও আমাদের কলকাতা পাওয়ার পক্ষে ইচ্ছে করে জোরালো যুক্তি উত্থাপন করা হয়নি। তার কারণ কী জানেন? এখন এই চক্রান্তের কথা ফাঁস হয়েছে। জিন্নাহ-লিয়াকত-নাজিম এই উর্দুভাষী তিন চক্রীর ইচ্ছা ছিল না কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হোক। কারণ কলকাতাকে বলা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় মহানগরী। এর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর- কোনো শহরের তুলনা হয় না। আমরা কলকাতা পেলে এই শহরটিকেই করতে হতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী। পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা হতো বাংলাভাষী বাঙালিরা। তা কি উর্দুভাষী মুসলিম মাড়োয়ারিদের সহ্য হয়?'
'আরো দুঃখের কথা শুনবেন? কোনো দেশ ভাগ হলে রাজধানী শহরটি যারা পায়, তাদের জন্য অপর অংশকে একটা ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক। এ জন্যই পাঞ্জাব ভাগ হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান লাহোর শহর পাওয়ার জন্য ভারতকে ৯ কোটি টাকা দেবে বলে ধার্য হয়। অনুরূপভাবে কলকাতা শহর হারানোর জন্য পূর্ব পাকিস্তান ভারতের কাছ থেকে ৯ কোটি টাকা পাওয়ার দাবিদার হয়। জিন্নাহ সাহেবের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান এ টাকা পায়নি। লাহোরের জন্য ভারতকে যে টাকা দিতে হতো, তার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য বিনিময় করা হয়।'
"ভাইয়েরা আমার, বলতে দুঃখে আমার বুক ফেটে যায়। এই পাকিস্তান কি আমরা চেয়েছিলাম? পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালি। দেশের ৫৫ ভাগ অধিবাসী আমরা। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। আমরা চাইলে দাবি করতে পারতাম, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী হবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং দেশটির একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ভাষা। আমরা উদারতা দেখিয়ে এ দাবি করিনি। তার পুরস্কার হলো শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মতো যোগ্য নেতাদের হটিয়ে দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে এক 'পাপেট সরকার' আমাদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া। এখন এই খাজা সাহেবই আবার বাঙালি পরিচয়ে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তিনিও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
কথা ছিল চট্টগ্রামে আমাদের নেভাল হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হবে। তা হয়নি, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জন করে পূর্ব বাংলা, তা খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বিশ্বের কোনো দেশে বিক্রয় কর (সেলস ট্যাক্স) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে না, থাকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। পূর্ববঙ্গের হাত থেকে সেই সেলস ট্যাক্স ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান দুটি প্রতিবেশী মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা পরস্পরের ঘোরতর শত্রু। তা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে ট্রেড রুট অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের এই ট্রেড রুট দিয়ে আফগান রপ্তানি পণ্য ড্রাই ফ্রুটস যায় বহির্বিশ্বে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের আবহমানকালের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ বন্ধ করা হয়েছে। কলকাতা ও হাওড়ার চটকলগুলো আমাদের জুট কাটিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। আমরা জুট কাটিং না দিলে এই চটকলগুলো বন্ধ হবে। তাতে ১০ লাখ শ্রমিক বেকার হবে। তার মধ্যে অধিকাংশ শ্রমিকই পূর্ববঙ্গের। একইভাবে পূর্ববঙ্গের বিড়ি শিল্প, তেল ও মৃৎশিল্প ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। এক কথায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে, অর্থনীতি ধ্বংস করে তাকে একটি কলোনিতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে।
শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও চলছে আগ্রাসন। পশ্চিম পাকিস্তানে আবদুল হক নামে এক ব্যক্তিকে বাবায়ে উর্দু খেতাব দিয়ে উর্দুভাষার উন্নয়নের জন্য উর্দু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলার উন্নয়নের জন্য কোনো প্রচেষ্টা নেই, এক পয়সার অর্থ বরাদ্দ নেই। চলছে বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা আখ্যা দিয়ে তার উচ্ছেদের জন্য দুহাতে সরকারি অর্থ ব্যয়। ড. শহীদুল্লাহ্র মতো পণ্ডিত বাংলা ভাষার সমর্থক বলে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের পেটোয়া বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা বাংলা ভাষাবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অভিযান চালানো হচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এখন গভর্নর জেনারেলের মুখ দিয়ে দু-দুবার অগণতান্ত্রিকভাবে বলানো হয়েছে, উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা হবে।
জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে অগ্রসর শ্রেণী ছাত্রসমাজেরই দায়িত্ব বেশি। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বার্থ, অধিকার ও দাবিদাওয়া আদায়ের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা মুক্ত হয়ে একটি উদার জনকল্যাণকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, অবিভক্ত ভারতে একটি নয়, একাধিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আমরা চাইলে আলাদা স্বাধীন পূর্ববঙ্গ চাইতে পারতাম। আমরা তা চাইনি। আমাদের এই উদারতাকে অবাঙালি শাসকরা যেন দুর্বলতা ও অক্ষমতা বলে না ভাবে। ভাবলে ভয়ানক ভুল করবে তারা।"
এর পর তিনি ছাত্রদের সমস্যা, দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িক সমস্যা, বিহারি মোহাজেরদের সমস্যা, সাংগঠনিক কর্মসূচি ইত্যাদি নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন। সভাশেষে চা পানের সময় বাহাউদ্দীন আহমদ আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার পরিচয় জেনে তিনি বললেন, 'তুমি উলানিয়ার জমিদার পরিবারের ছেলে। আরিফ চৌধুরীকে চেনো?'
বললাম, 'চিনি, তিনি আমার আত্মীয়।'
শেখ মুজিব বললেন, 'তিনি ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদে সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। তখন হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে ছিলেন। এখন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য। কিন্তু আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।'
আমি ছাত্রলীগের কোনো গ্রুপে নেই; ছাত্র কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত জেনে শেখ মুজিব বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বললেন, 'তুমি ছাত্রলীগে নেই কেন?'
বললাম, 'ছাত্রলীগ সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। আমি সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি না। তাই ছাত্র কংগ্রেসে রয়েছি।'
: কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফেডারেশনে যাওনি কেন?
: প্রথমদিকে ছাত্র ফেডারেশনের দিকেই ঝুঁকেছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টির বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন সম্পর্কিত ভূমিকা আমার পছন্দ হয়নি। তা ছাড়া ছাত্র কংগ্রেসও বাম ছাত্রসংগঠন। এর পেছনে আছে আরএসপি।
শেখ মুজিব বললেন, 'হু, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল। বরিশালে এই দলের নেতা দেবকুমার ঘোষ, তাঁকে আমি চিনি। একজন বিপ্লবী পুরুষ।'
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠন করা উচিত। উদ্যোগ নিতে হবে। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধীরেসুস্থে পদক্ষেপ নিতে হবে। সে জন্য কিছুদিন সময় লাগবে।'
প্রথম দিনের দেখাতেই তাঁকে আমি মুজিবভাই ডেকেছিলাম। তাঁকে আমার ভালো লেগেছিল ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ও রাজনীতিবিদ হিসেবেও। মনে হয়েছিল, তিনি সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে যুক্ত বটে, কিন্তু একজন অসাম্প্রদায়িক মনের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতেই তাঁকে বেশি মানায়।
এই ঘরোয়া সভার একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট লিখে আমি সাপ্তাহিক নকীব পত্রিকার সম্পাদক নূর আহমদ সাহেবকে দিয়েছিলাম। তিনি মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব সংক্রান্ত শেখ মুজিবের বক্তব্যটুকু বাদ দিয়ে বাকি অংশ প্রকাশ করেন। আমাকে বললেন, 'লাহোর প্রস্তাব সম্পর্কে এ ধরনের কথা এখন স্পর্শকাতর বিষয়। সরকার সহ্য করতে চাইবে না। পত্রিকার ওপর আঘাত আসতে পারে।'
সেবার বরিশালে শেখ মুজিবুর রহমান দু-তিন দিনের বেশি থাকেননি। মুকুন্দ দাসের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। অশ্বিনীকুমার হলে কোনো জনসভা করেননি। কিন্তু অশ্বিনীকুমার হলের সামনে 'রুচিরা' রেস্টুরেন্টে এক বৈকালিক চায়ের আসরে এসেছিলেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত একটি ঐতিহাসিক রেস্তোরাঁ ছিল এই রুচিরা। সারা অবিভক্ত বাংলার অনেক ঐতিহাসিক পুরুষ এই রেস্তোরাঁয় এসে চা খেয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে আছেন কবি জীবনানন্দ দাশ, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, হুমায়ুন কবির, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকি ১৯৪৬ সালের বোম্বাই নৌবিদ্রোহের দুই বিপ্লবী নেতাও। আমি সবাইকে দেখিনি, কিন্তু ১৯৪৬ সালে এই অশ্বিনীকুমার হলে প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন ও প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। ছাত্র ফেডারেশনের সাংস্কৃতিক সভায় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছাত্র কংগ্রেসের সাংস্কৃতিক সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি দুজনকেই এই রুচিরা রেস্টুরেন্টে ভক্ত পরিবৃত অবস্থায় চা খেতে দেখেছি। রুচিরার সামনে রাস্তার অপর পারে ছিল অমৃত ভাণ্ডার। হোটেল-কাম-রেস্টুরেন্ট। দুটিই এখন নেই। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর উঠে গেছে।
এই রুচিরায় সদলবলে চা খেতে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান। খবর পেয়ে আমিও ছুটলাম সেখানে। তিনি চায়ের কাপ হাতে খোলা মনে কথা বলছিলেন। বললেন, বরিশাল তাঁর খুব ভালো লাগে। বরিশালে তাঁর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত থাকেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বাড়িতে আসেন এবং থাকেন। বরিশালে নদীর পাড়ে লাল সুরকি ঢালা পথ, দুপাশে ঝাউগাছ, হেমায়েতউদ্দীন প্লে গ্রাউন্ড, বেলস পার্ক, ভাটার খাল, চাঁদমারীর খাল তাঁর খুব ভালো লাগে। কবি নজরুল সত্যই বলেছেন, বরিশাল বাংলার ভেনিস।
আমি এক ফাঁকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মুসলিম লীগবিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল কি হচ্ছে?
তিনি বললেন, 'হচ্ছে। শিগগিরই তোমরা খবর পাবে। আগে আর কিছু বলব না।' তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কি ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর কলেজে পড়ার জন্য ঢাকায় আসবে?'
বললাম, 'আমার ইচ্ছে।'
তিনি বললেন, 'তাহলে আমার সঙ্গে দেখা করো।'
ঠিক এই সময় রুচিরায় এসে ঢুকলেন মোহাম্মদ এমাদউল্লা। আমরা তাঁকে ডাকতাম লালাভাই। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ইয়ুথ লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তখন ছিলেন মহিউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু ও সহকর্মী। শেখ মুজিব তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেদিন রাতেই তিনি স্টিমারযোগে ঢাকা রওনা হন।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
লন্ডন, ২৮ জুলাই, ২০১৩

No comments:

Post a Comment