Friday, March 21, 2014

কাফকার প্রেম মিলেনা য়েসেনেস্কার কাছে একগুচ্ছ চিঠি ভূমিকা ও অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান

কাফকার প্রেমমিলেনা য়েসেনেস্কার কাছে একগুচ্ছ চিঠি ভূমিকা ও অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান
সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি। নতুন ধরনের গল্প আর ন্যারেটিভের সুবাদে গত শতকের সবচেয়ে আলোচিত কথাসাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকা। আধুনিক ব্যক্তিমানুষের সংকট আর অস্তিত্বের তীব্র মোহিত রূপ তাঁর লেখায় এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যে একক কোনো ভৌগোলিক পরিসরে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। বিশ্বসাহিত্যের চেহারাকেই বদলে ফেলেছিলেন তিনি। বিশ্ব কথাসাহিত্যের ধারাকে বদলে দেওয়া আরেক ঔপন্যাসিক লাতিন আমেরিকার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাই স্মৃতিচারণা করে একবার বলেছিলেন, মাত্র উনিশ বছর বয়সে কাফকার 'রূপান্তর' নামের গল্পটি পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। গ্রেগর সামসা কী অদ্ভুতভাবে এক ভোরে একটা পোকায় পরিণত হয়ে গেল, কাফকার ওই লেখার প্রথম অংশটি পড়ে সেই দৃশ্যের দ্বারা দারুণভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন তিনি। শুধু কি মার্কেজ? বিশ্বসাহিত্যের এমন কোনো প্রধান গুরুত্বপূর্ণ লেখক নেই যিনি কাফকার এই অভিনব গল্পকথন আর শৈলীর দ্বারা প্রভাবিত হননি। কেননা, আধুনিক সময় ও ব্যক্তিমানুষের চমকপ্রদ ছবি পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। এই সময়ের আরেক খ্যাতিমান লেখক মিলান কুন্ডেরা সংক্ষেপে তাঁর অবদানের কথা ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে, 'কাফকা কোনো ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেননি। তিনি যা করেছেন, তা হলো আমাদের জীবনের নেপথ্যে যা আছে, তাকেই অবলোকন করা। তিনি জানতেন না যে তাঁর এই অবলোকন ভবিষ্যপ্রসারীও বটে। কোনো সামাজিক প্রথার অপাবরণ তাঁর অভিপ্রায় ছিল না। ব্যক্তিগত আর অনুসূক্ষ্ম সামাজিক মানবিক কর্মকাণ্ডের যে যান্ত্রিকতা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সেই দিকটির ওপরই তিনি আলোকপাত করেছেন। ইতিহাসের বিশাল রঙ্গশালায় পরবর্তীকালে যে সেই যান্ত্রিকা সক্রিয় হবে, এ রকম ভাবনা তাঁর কখনোই ছিল না।' কিন্তু মানুষের জীবনকে যিনি এইভাবে প্রাজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখেছিলেন, তাঁর জীবনই ছিল নানা সংকটে দীর্ণ, রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। বিশেষ করে প্রেম তাঁর জীবনকে কখনোই স্থিতি দেয়নি। কেউ কেউ অবশ্য কথাটাকে ঘুরিয়ে বলতে পারেন, প্রেমের জন্য আজীবন তৃষ্ণার্ত ছিলেন তিনি, কিন্তু সেই প্রেম কখনোই তাঁকে প্রশান্তি দেয়নি।
সমস্যার উৎস ছিলেন তিনি নিজেই। অর্থাৎ বাইরের কোনো ঘটনা নয়, অন্তর্গতভাবেই কাফকা ছিলেন একক নিঃসঙ্গ মনের মানুষ। ফলে প্রেমের ক্ষেত্রে যে স্থিরতার প্রয়োজন হয়, সেই রকম স্থৈর্য বা শান্ত সমাহিত মনের অধিকারী তিনি ছিলেন না। ফলে জীবনে প্রেমে পড়েছেন অনেকবার, কিন্তু কোনো প্রেমই শেষ অবধি সফল হয়নি। সফলতা তিনি চানওনি। নিজেই প্রেমে পড়েছেন, আবার প্রেমাস্পদ যখন খুব কাছে চলে এসেছে, তখনই তিনি তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তখন একা হয়ে পড়েছেন। এই একাকিত্ব থেকে আবার প্রেমে পড়েছেন, সরে এসেছেন আবার ওই একইভাবে। অর্থাৎ প্রেমে পড়া এবং সরে আসা, এভাবেই মূলত আবর্তিত হয়েছে তাঁর প্রেম।
কাফকার প্রেমে পড়ার বা প্রেমকে প্রলম্বিত করার ধরনটিও ছিল অভিনব, একান্তভাবেই নিজস্ব। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে যে কয়জন নারীর সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে মধুর হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল তাঁদের নামগুলো এখানে উল্লেখ করছি : ফেলিস বাউয়ার, গ্রেতি ব্লক, মিলেনা য়েসেনেস্কা ও ডোরা ডায়মন্ট। এই চার নারীর মধ্যে ফেলিস বাউয়ারের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জীবনের প্রথম দিকে তিনি এই ফেলিসের প্রেমে এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে তাঁর লেখকজীবন ফেলিসের ছায়াতেই শুরু হয়েছিল। কাফকার জীবনী লেখকরা বারবার এর উল্লেখ করেছেন। যৌবনের প্রারম্ভে আবেগায়িত প্রেমের দ্বারা কোনো যুবাপুরুষ যেভাবে আন্দোলিত হয়, কাফকা ঠিক সেভাবেই ফেলিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রেম একেবারেই শারীরিক ছিল না, ছিল একান্তভাবেই মানসিক। কাফকা মূলত চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। প্রায় পাঁচ বছর স্থায়ী ওই সম্পর্কের সময় কাফকা ফেলিসকে প্রায় সাড়ে তিন শ চিঠি লিখেছিলেন।
নোবেল পুরস্কারজয়ী ঔপন্যাসিক ইলিয়াস কানেত্তি বলেছেন, ফেলিসের প্রেম ছিল কাফকার সৃষ্টিশীলতার উৎস। অর্থাৎ ফেলিসের প্রতি তাঁর যে প্রেম, সেই প্রেমাকর্ষণই তাঁকে সৃষ্টিশীল করে তুলেছিল। তবে ফেলিস, কাফকার জীবনী থেকে জানা যায়, কাফকার সৃষ্টিশীলতাকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেননি। কাফকার লেখা সম্পর্কে তিনি কখনো কোনো মন্তব্য করেননি, যদিও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। কাফকার অনুরোধ সত্ত্বেও এ নিয়ে তিনি ছিলেন একেবারেই নির্বাক, অনেকটাই নিস্পৃহ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে কাফকা-ফেলিসের প্রেম ছিল দুই অসম নর-নারীর প্রেম। মানসিকভাবে তাঁদের মধ্যে কখনোই কোনো সংযোগ স্থাপিত হয়নি। ফেলিস কাফকার তীব্র সংবেদনশীল মনের গভীরতাকে কখনো উপলব্ধি করতে পারেননি। আসলে একজন সাধারণ নারী বলতে যা বোঝায় ফেলিস ছিলেন সে রকমের এক নারী। ফলে দু-দুবার তাঁর সঙ্গে বাগদান হওয়া সত্ত্বেও সেই সম্পর্ক বিয়ে অবধি গড়ায়নি। দুবারই কাফকা ভেঙে দিয়েছেন এই বাগদান। ফেলিসের পরে কাফকা আর যে একজন নারীর সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন মিলেনা য়েসেনেস্কা। অনেকটাই আবেগতাড়িত, মোহগ্রস্তের মতো ফেলিসের প্রেমে পড়েছিলেন কাফকা। প্রেম হয়তো এ রকমই। কিন্তু মিলেনার প্রতি কাফকার আকর্ষণের হেতু ছিল ভিন্ন। মিলেনা সাধারণ কোনো নারী ছিলেন না। সাহিত্য সম্পর্কে গভীর বিস্তৃত পড়াশোনা ছিল তাঁর, অনুরাগও ছিল তীব্র। জার্মান সাহিত্য চেক ভাষায় অনুবাদ করছিলেন তিনি। দেখতেও সুন্দরী ছিলেন এই নারী। একই সঙ্গে স্বভাবে সহজ, স্মার্ট। অর্থাৎ মিলেনা মানসিক দিক থেকে অনেকটাই ছিলেন কাফকার কাছাকাছি ধরনের মানুষ। ফলে বুদ্ধিদীপ্ত এই নারীর সঙ্গে কাফকার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই সম্পর্কের ধরনটাই ছিল মূলত বৌদ্ধিক। কিন্তু কে ছিলেন এই মিলেনা?

দুই
১৮৯৬ সালে ইউরোপের একটা প্রাচীন শহর প্রাহায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মিলেনা য়েসেনেস্কা। এখন প্রাহা হচ্ছে আধুনিক চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। মিলেনা যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন এটি ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ। মিলেনার প্রাহায় জন্মের ইতিহাস প্রাহার পুরনো চেক পরিবারগুলোর আবির্ভাবের সঙ্গে যুক্ত। এই পরিবারগুলোই এখনো চেকের অভিজাত ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে চলেছে। প্রাহার পুরনো টাউন হলের বাইরে লাতিন ভাষায় একটা মার্বেল ফলকে খোদিত রয়েছে তার পূর্বপুরুষের নাম। মিলেনার কথিত এই প্রখ্যাত পূর্বপুরুষের নাম হান য়েসেনিয়াস। তিনি প্রাহার চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উত্তীর্ণ চিকিৎসক। সতেরো শতকে হাবসবার্গের সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের বিরুদ্ধে চেক রাষ্ট্রে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন আর বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। এই আন্দোলনের স্মারকচিহ্ন হিসেবে টাউন হলের ওই ফলকে দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। মিলেনার বাবা হান য়েসেনেস্কা ছিলেন দাঁতের চিকিৎসক আর চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মিলেনার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন তাঁর মা মারা যান। মিলেনাও চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনার জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। আচার-আচরণের দিক থেকে মিলেনা ছিলেন উড়নচণ্ডী স্বভাবের এক তরুণী। বন্ধুদের সঙ্গেই সময় কাটাতে তিনি ভালোবাসতেন। ওই বয়সেই অনেক পুরুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। মাঝেমধ্যে বাবার চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত মাদকদ্রব্য চুরি করে নেশা করতেন। পোশাক-আশাক কেনা, ফুল কেনা ইত্যাদি কাজে নির্বিচারে ব্যয় করতেন বাবার অর্থ। তিনি ছিলেন আসলে দুঃসাহসী, দ্রোহী, ক্ষয়িষ্ণু, একরোখা এক মেয়ে। ফলে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে পড়তে যখন মনে হলো ভালো লাগছে না, ছেড়ে দিলেন সেই পড়াশোনা। ১৯১৮ সালে বিয়ে করলেন আর্নেস্ট পোলাক নামের এক ইহুদি বুদ্ধিজীবীকে। মিলেনার বয়স তখন মাত্র কুড়ি বছর। প্রাহার সাহিত্য ভুবনে নানাজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এক পর্যায়ে পোলাকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। আলাপের পরে প্রেম এবং বিয়ে। বিয়ের পর তাঁরা চলে আসেন ভিয়েনায়। কিন্তু এই বিয়েতে মত না থাকায় বাবার সঙ্গে মিলেনার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। মিলেনাও বিবাহিত জীবনে তেমন সুখী হতে পারেননি। দাম্পত্য সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এই সময়ে তিনি কোকেনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েনা আসার প্রথম দিকে পোলাকের আয়-রোজগার ছিল বেশ কম। ফলে মিলেনাকেও রোজগারে নামতে হয়। তিনি স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্যে সাংবাদিকতার পাশাপাশি অনুবাদে হাত দেন। ১৯১৯ সালে কাফকার একটি গল্প 'স্টোকার' পড়ে এতটাই চমৎকৃত হন যে গল্পটি জার্মান থেকে চেক ভাষায় অনুবাদের ইচ্ছা প্রকাশ করে কাফকার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই যোগাযোগই পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল। মিলেনার স্বামী পোলাকও কাফকার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তবে কাফকা এই সময়ে দিনের পর দিন, অর্থাৎ ১৯২০-২১ সালের দিকে অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন মিলেনাকে। ওই চিঠিগুলো ছিল তীব্র আবেগ আর হার্দিক উষ্ণতার অনুভবে প্রাণবন্ত, গভীর। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেও একজন লেখকের আত্মকথন আর আত্ম-উন্মোচনের দলিল হিসেবে এই চিঠিগুলো অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। গল্প আর উপন্যাসের পাশাপাশি এই চিঠিগুলোর মধ্যেও কাফকার সৃষ্টিশীল প্রতিভার অনন্য স্ফুরণ ঘটেছিল। কাফকার সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে বুঝতে হলে মিলেনাকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো পড়া জরুরি। সেই সঙ্গে পড়া প্রয়োজন তাঁর দিনপঞ্জি। অন্তরঙ্গ আত্মকথন, ব্যক্তিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর অজানা শঙ্কায় তাঁর ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো ভরা। মিলেনার প্রতি যে তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মেছিল, সে সম্পর্কে এই ডায়েরির এক জায়গায় লিখছেন, 'প্রায় এক সপ্তাহ আগে এমকে আমার সব ডায়েরি দিয়েছিলাম। এতে মানসিকভাবে কিছুটা কি মুক্ত হতে পেরেছিলাম আমি? না। আমি কি আসলে দিনপঞ্জি লেখার যোগ্য? যোগ্যতা থাকলেও নিশ্চয়ই অন্য কোনো ধরনের ডায়েরি লেখা যেতে পারে, যা হয়তো একদিন এমনি এমনি হারিয়ে যাবে। আমার আসলে কোনো ডায়েরি রাখা উচিত নয়। কেবল খুব চেষ্টা করে আমি আমাদের হার্দ সম্পর্কের বিষয়ে দু-একটা কথা লিখে রাখতে পারি। ব্যাপারটা এমন যে তাঁর সম্পর্কে যা লেখা দরকার অনেক আগেই বুঝি আমি তা লিখে ফেলেছি। তাতে হয়তো বলা হবে সেই একই কথা, আমি আর বাঁচব না। তবে হ্যাঁ, এম সম্পর্কে আমি লিখতে পারি, কিন্তু ইচ্ছা করেই আমি তা লিখব না। কেননা সেটা হবে আমাকেই সরাসরি লেখা। এ বিষয়ে আমার এত স্পর্শকাতর বা সূক্ষ্মভাবে সচেতন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এসব ব্যাপারে আমি যে রকম তাতে বলা যায়, আমি খুব ভুলোমনা নই। আমার নির্ঘুম কাটানোর কষ্ট যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই আমি নিজে একটা জীবন্ত স্মৃতি [১৫ অক্টোবর ১৯২১]।' কাফকা মিলেনার হাতে এই যে তাঁর ডায়েরিগুলো দিয়েছিলেন এর মধ্য দিয়ে তাঁর স্বভাবের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। নিজের সম্পর্কে সব সময়ই কাফকা তাঁর প্রেমিকাদের কাছে স্বচ্ছ থাকতে চেয়েছেন। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরাও ছিল তাঁর লক্ষ্য। নিজের ব্যক্তিগত দুর্বলতা, অস্থিরতা, টানাপড়েন এইসব দিক অকপটে ব্যক্ত করাও ছিল তাঁর স্বভাবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। কোনো কিছুই তিনি লুকোতে চাননি, লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।
মিলেনা য়েসেনেস্কার সঙ্গে কাফকার দুবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। একবার চার দিন তাঁরা ভিয়েনায় কাটিয়েছিলেন, আরেকবার এক দিন গুমুন্দে। পরিশেষে কাফকা এই সম্পর্কটা ভেঙে দেন। য়েসেনেস্কা তাঁর স্বামীকে ছেড়ে আসতে চাইছিলেন না বলে কাফকা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসের দিকে তাই তাঁদের মধ্যেকার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে আর ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর মিলেনার স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটলে ১৯২২ ও ১৯২৩ সালের দিকে তাঁদের মধ্যে আবার কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই, তাঁদের সম্পর্ক আর স্থায়ী হয়নি। ১৯২৩ সালে স্বামীর সঙ্গে মিলেনার আবার সম্পর্ক স্থাপিত হলে কাফকা তাঁর সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক ছেদ করেন। কাফকা মিলেনাকে জানান, তাঁরা কখনো আর একে অন্যের মুখদর্শন করবেন না। ভবিষ্যতে চিঠিপত্রের সম্পর্কও থাকবে না।
কাফকা ও মিলেনার সম্পর্কের পরিণতি যা-ই ঘটুক না কেন, তাঁরা দুজন বোধ আর উপলব্ধির দিক থেকে খুবই কাছাকাছি ধরনের মানুষ ছিলেন। দুজনের হার্দিক নৈকট্যও তৈরি হয়েছিল। কাফকা যেমন ছিলেন সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে খুবই তীক্ষ্ণ মেধাবী আবেগপ্রবণ মানুষ, মিলেনার মধ্যেও ছিল এই সৃষ্টিশীলতার 'আগুন'। অগ্নির এই উপমাটা মিলেনা প্রসঙ্গেই উল্লেখ করেছিলেন কাফকা। কাফকা একটা চিঠিতে মিলেনাকে লিখেছিলেন, '[তুমি] একটা জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো- এ রকম কোনো নারীকে আমি আগে কখনো দেখিনি।' মিলেনা, আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, এই একমাত্র নারীই হতে পারতেন কাফকার প্রকৃত নর্মসঙ্গিনী। ধারণা করা হয়, কাফকা ১৯২২ সালে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে 'দুর্গ' নামে যে উপন্যাসটি লেখেন, মিলেনাই ছিলেন তাঁর ওই রচনার অনুপ্রেরণা। বিশেষ করে মনে করা হয়, ফ্রেইডার চরিত্রটি অনেকটা মিলেনার আদলে সৃষ্টি করেছিলেন কাফকা। এই উপন্যাসে এমন একটি কাফের কথা আছে যেখানে স্বামীর সঙ্গে বহুবার গিয়েছেন মিলেনা। 'দুর্গ' কাফকার এমন একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, সমালোচকরা নানাভাবে যার দুর্জ্ঞেয় রহস্য আজও অনুসন্ধান করে চলেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, অনুবাদের সূত্রে কাফকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মিলেনার। মিলেনাই ছিলেন কাফকার প্রথম অনুবাদ। 'স্টোকার'ই ছিল কাফকার প্রথম অনূদিত গল্প। জার্মান থেকে চেক ভাষায় এটি অনুবাদ করেছিলেন মিলেনা। পরে তিনি কাফকার আরো অনেক লেখা অনুবাদ করেন। মিলেনা কাফকা ছাড়াও অনুবাদ করেছিলেন হার্মান ব্রখ, ফ্রানৎস ভেরফেল, আপটন সিনক্লেয়ারের বিভিন্ন রচনা। ভিয়েনায় এসে এভাবেই লেখালেখির সঙ্গে মিলেনা পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়েন। ভিয়েনা থেকে প্রাহার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই সময়ে তিনি যেমন নিবন্ধ লিখছিলেন, তেমনি নারীবিষয়ক নানা কাগজে লিখছিলেন সম্পাদকীয় আর উপসম্পাদকীয়। ১৯২৫ সালে পোলাকের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি চলে আসেন প্রাহায়। বিয়ে করেন চেক আভাঁগার্দ স্থপতি জেরোমি ক্রেজকারকে। প্রাহাতেও সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। পত্রপত্রিকায় আগের মতোই লেখালেখির পাশাপাশি শিশু-কিশোর গ্রন্থের সম্পাদনা ও অনুবাদে আরো বেশি মনোনিবেশ করেন এই বিদুষী নারী। ১৯৩০-এর দশকে তিনি মার্কসীয় মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু কিছু দিন পর স্তালিনের শাসন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওই পথ থেকে সরে আসেন। এরপর ১৯৩৮-৩৯ সালে তিনি চেক ভাষায় প্রকাশিত 'উপস্থিতি' নামের একটি অভিজাত পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন। জার্মান সেনাবাহিনী যখন চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে, য়েসেনেস্কা তখন একটা নিষিদ্ধ সংগঠনের হয়ে ইহুদিদের দেশত্যাগে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু নিজে চেকোশ্লোভাকিয়া ছেড়ে যাননি। ১৯৩৯ সালে গেস্টাপো বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে প্রাহায় এবং পরে ড্রেসডেনে নিয়ে আসে। ১৯৪০ সালে জার্মানির একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তাঁকে আটকে রাখে জার্মানরা। কিন্তু অসম সাহসী এই নারী সংকটময় ওই দিনগুলোতে বন্দি অন্য নারীদের যেভাবে মানসিক দিক থেকে উজ্জীবিত করেছিলেন, এককথায় তা ছিল অভূতপূর্ব। মিলেনার এই শেষ দিনগুলোর কথা পাওয়া যাবে ওই একই ক্যাম্পে বন্দি আর বন্ধু হয়ে ওঠা মার্গারেট বুবের-নিউমানের যুদ্ধপরবর্তী আত্মজীবনীতে। বুবের নিজেই মিলেনার দ্বারা দারুণ উজ্জীবিত হয়েছিলেন, তাঁর সাহচর্য বুবেরকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। বুবের জানাচ্ছেন, মিলেনা আর আমি, দেখা হওয়ার মুহূর্ত থেকেই পরস্পরের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সুদীর্ঘ চার বছর আমরা প্রতিটি মুহূর্ত জীবন ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একসঙ্গে লড়াই করে গেছি। আমি আর মিলেনাসহ হামবুর্গের দাগি অপরাধী আর পতিতাদের সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার সৌভাগ্য যে আমি ওই ক্যাম্পে স্থান পেয়েছিলাম। তা না হলে মিলেনার মতো মহীয়সী নারীর সঙ্গী হয়ে উঠতে পারতাম না। ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে এই ক্যাম্পে আনা হয়। কিন্তু তাঁর মানসিক শক্তি এতটাই তীব্র ছিল যে, এই অসুস্থতাকে তিনি একেবারেই তোয়াক্কা করতেন না। ১৯৪০ সালের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতেও তিনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক থাকা সত্ত্বেও ভেঙে পড়েননি। তাঁকে ভয় দেখিয়ে দুর্বল করে দেওয়া নাৎসি সেনাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। ওই ক্যাম্পেই তাঁরা দেখেছেন কী পৈশাচিকভাবে হাতুড়ে সব ডাক্তার বিকৃত উন্মত্ত উল্লাসে গিনিপিগের মতো জীবন্ত নারী বন্দিদের ওপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এ রকমভাবেই একবার কিডনি রোগে আক্রান্ত মিলেনা ওই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার কারণে ১৯৪৪ সালের ১৭ মে মারা যান। এই মৃত্যুর কথা স্মরণ করে বুবের লিখেছেন, 'মিলেনা যখন নেই, আমারই বা বেঁচে থাকার প্রয়োজন কোথায়?'

তিন
মিলেনা য়েসেনেস্কার জীবন, বুঝতে অসুবিধে হয় না, বহুবর্ণিল ছিল। অনেক চড়াই-উতরাই আর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে। খুবই বুদ্ধিমতী, দৃঢ়চেতা, সাহসী নারী ছিলেন তিনি। ফ্রানৎস কাফকা যে অসাধারণ প্রতিভাধর একজন লেখক হয়ে উঠছেন, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। মিলেনা মনে করতেন তাঁর স্বামী পোলাক ততটা বিশ্বস্ত নন। কিছুদিন স্বামীর সঙ্গে আলাদা হয়ে গিয়ে কাফকার সাহচর্যে প্রশান্তি খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন মিলেনা। তবে তাঁরা কতটা পরস্পরের প্রণয়ী হয়ে উঠেছিলেন, সেই বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কাফকা-মিলেনার প্রণয়ের পরিণাম অবশ্য যা-ই হোক না কেন তাঁদের পরস্পরের প্রতি টান ছিল খুবই গভীর। কাফকা সরাসরি মিলেনাকে বলেছিলেন, যৌনতা নিয়ে তাঁর আছে দারুণ ভীতি। এই ভীতির কারণও তিনি খুলে বলেছিলেন মিলেনাকে। কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভিক দিনগুলোতে বেশ কয়েকজন নারীর সাহচর্যে এসেছিলেন কাফকা। তাদের সঙ্গে তাঁর যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ছিল ক্ষণস্থায়ী আর বিবমিষায় ভরা। নিজের দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কোনো নারীকেই সুখী করতে পারেননি, নিজেও সুখী হননি। কাফকা বলেছিলেন, এসবের জন্য তিনি নিজেই দায়ী। সারা জীবন কাফকা এ রকম যৌনসংকটের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে নারীদের সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। বিয়ে আর দাম্পত্যজীবন নিয়েও তাঁর মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের বিরাগ। এ কারণেই ফেলিসের সঙ্গে দু-দুবার বাগদান সত্ত্বেও ছিন্ন করেন সেই সম্পর্ক। কাফকার এই যৌনভীতি সম্পর্কে খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন মিলেনা। কাফকার স্বভাব ছিল অনেকটা এ রকমই। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা সচেতনভাবে নিজের প্রেমের পরিণতি সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলে মিলেনাকে সজাগ করে দিতেন। কাফকা তাঁর স্বভাবের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ও খুলে বলেছিলেন মিলেনাকে। বিশেষ করে নিজের স্বভাবের নেতিবাচক দিকগুলো তিনি অকপটে মিলেনার কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। ভয়, হতাশা, বিবিক্তি, নৈঃসঙ্গ্য ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে ভরা থাকত তাঁর চিঠিগুলো। ১৯২০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দুজনের মধ্যে অসংখ্য চিঠি বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু প্রচলিত অর্থে যাকে প্রেমপত্র বলে, এই চিঠিগুলোকে সেই ধরনের চিঠি বলা যাবে কি না সন্দেহ।
১৯২০ সালেই মিলেনার সঙ্গে অনুবাদের সূত্রে চিঠির মাধ্যমে প্রথম যোগাযোগ হয় কাফকার। মিলেনার অনুবাদগুলো পাঠ করে তাঁর প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। মিলেনার সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে কাফকা বুঝে ফেলেন, মিলেনার সাহিত্যবোধ আর সৃষ্টিশীল সত্তা কতটা উঁচু মানের। অনুবাদেও কতটা সিদ্ধহস্ত তিনি। মিলেনার এসব অনুবাদ পড়ে তিনি সেই অনূদিত লেখাগুলো তাঁর সেই সময়ের প্রকাশক কার্ট উলফকে দিয়ে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কাফকা মিলেনাকে যেসব চিঠি লিখেছিলেন মিলেনাই ছিলেন সেসব চিঠির স্বত্বাধিকারী। যুদ্ধকালীন সেই দুঃসময়ে এই চিঠিগুলো মিলেনা সংরক্ষণ করার অভিপ্রায়ে বন্ধু উইলি হাসের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু উইলি এই সময় প্রাহা ছেড়ে চলে যান। চিঠিগুলো তিনি রেখে যান তাঁর এক আত্মীয়ের কাছে। পরম যত্নে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই চিঠিগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধ অবসানের পর হাস কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের সম্মতি নিয়ে সেগুলো সম্পাদনার কাজ শুরু করেন এবং তাঁর সম্পাদনায় এই চিঠিগুলো প্রকাশিত হয়। তত দিনে কাফকা আর মিলেনা কেউ আর বেঁচে নেই।
চেক ভাষায় মিলেনার করা কাফকার 'স্টোকার' গল্পটির অনুবাদ যখন ট্রিবিউন নামের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন কাফকার বয়স ৩৬ বছর। ইতিমধ্যে তাঁর দুটি গল্পের সংকলন বেরিয়ে গেছে- 'অনুধ্যান' এবং 'গ্রাম্য ডাক্তার'। সেই সঙ্গে বেরিয়ে গেছে আরো কিছু লেখা- 'বিচার', 'রূপান্তর', 'বিচারালয়ে'। ফেলিসের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর তাঁর জীবনে কিছুটা স্থিতি এসেছে। কিন্তু উদ্বিগ্ন ছিলেন নিজের যক্ষ্মা রোগ নিয়ে। এ জন্য প্রায়ই তাঁকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল। এ রকমই এক সময়ে ১৯২০ সালের বসন্তকালে তিনি মেরানে যান আর সেখান থেকেই মিলেনাকে প্রথম চিঠিটি লেখেন তিনি। ঘুম হলেই তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে : 'আমি যদি ঘুমুতে পারি, তাহলে আমার স্বাস্থ্য নিঃসন্দেহে ভালো হয়ে যাবে। এটা সত্যি যে আজকাল আমি কিছুটা মুটিয়ে গেছি। কিন্তু নির্ঘুম ব্যাপারটি অসহ্য হয়ে উঠছে। এর অবশ্য অনেক কারণ আছে, এর একটা কারণ হচ্ছে ভিয়েনায় যোগাযোগ করা। সে তো জীবন্ত অগ্নি, এ রকমটা আমি আগে কখনো দেখিনি। ঘটনাচক্রে ওই আগুন সব কিছু পুড়িয়ে দিচ্ছে। পোড়াচ্ছে তাঁকেও। একই সঙ্গে সে খুবই কোমল, শান্ত, সাহসী, বুদ্ধিমতী আর নিঃস্বার্থপরায়ণ এক নারী।' এই চিঠিতে 'তাঁকে' বলতে বোঝানো হয়েছে মিলেনার স্বামী পোলাককে। মিলেনার প্রতি কাফকার এই যে আকর্ষণ তার পেছনে মিলেনার দুঃখ-কষ্টের কারণগুলো বড় ভূমিকা পালন করেছিল। অর্থাৎ তাঁদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত স্তর থেকে হার্দিক হয়ে পড়েছিল। কাফকার চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায়, মিলেনার সঙ্গে তিনি সব দিক থেকে জড়িয়ে পড়েছিলেন, শুধু হৃদয়ের কথা বলার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন না। মিলেনাও নিজেকে কাফকার কাছে মেলে ধরেছিলেন, কাফকার প্রতিক্রিয়া থেকেই তা বোঝা যায়। এই প্রেমের সম্পর্ক এমন হয়ে উঠেছিল যে দুজন দুজনকে আবিষ্কার করেছিলেন, একাত্ম হয়েছিলেন। কাফকা তাই বলতে পেরেছিলেন, ফেলিসের সূত্রে বিয়ের একটা ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি। মিলেনা বলেছিলেন, কাফকার অসুখ তিনি নিজের ফুসফুসেই অনুভব করছেন। দুজন এইভাবে চিঠি লিখতে লিখতে নিজেদের আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্টকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও মিলেনা তাঁর স্বামীকে ছেড়ে কাফকার কাছে চলে আসতে পারেননি। অনেকে মনে করেন, অস্থিতিশীল মেধাবী কাফকার সঙ্গে জীবন কাটানো সংগত হবে কি না ভেবেই মিলেনা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। কাফকা তাই যখন এই সম্পর্কের ইতি টানলেন তার পরপরই চিকিৎসা নিতে চলে গেলেন একটা পাহাড়ে অবস্থিত স্যানেটোরিয়ামে। সেখান থেকে তিনি বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে লেখেন, 'ঘুম আমার খুব কমই হয়। কিন্তু দুটি বিষয়ে আমি সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছি। প্রথমত, আমার হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা হয়...আরেকটা হলো ধারাবাহিকভাবে কিছু স্বপ্ন আমি দেখেছি। সেই সব স্বপ্নের একটা হলো, একটা বালক সাদা শার্ট পরে আমার বাঁ দিকে বসে (আমার মনে নেই ছেলেটা কি আমার- নাকি অন্য কারো, তবে এ নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি), আর মিলেনা বসেছে আমার ডান দিকে। দুজনেই আমার সঙ্গে হাসিখুশিতে মেতে ছিল আর আমি তাদের আমার মানিব্যাগ সম্পর্কে একটা গল্প বলছিলাম। বলছিলাম, কিভাবে আমি সেই ব্যাগটা হারিয়েছিলাম আর উদ্ধার করেছিলাম। যদিও ব্যাগের ভেতরটা আমি সেইভাবে খুঁজে দেখিনি, ভেতরে কোনো টাকাকড়ি আছে কি না, সেটাও জানতাম না। এর পরও যদি ওটা হারিয়ে যেত, যতক্ষণ ওরা আমার সঙ্গে থাকত, আমি কিছু মনে করতাম না। আত্মসুখ, অন্তর্গত অনুভব কিভাবে স্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে যায়, কাফকার চিঠিটি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কিন্তু এই স্বপ্নও একসময় ভেঙে যায়, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন দুই প্রেমাস্পদ- কাফকা ও মিলেনা। একজনের জীবনাবসান ঘটে স্যানেটোরিয়ামে, অন্যজনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।

মিলেনা য়েসেনেস্কাকে লেখা কাফকার কয়েকটি নির্বাচিত চিঠি [অনুবাদ লেখকের]

(১)
মিরান-উন্তেরমেইস
পেনসন অটোবার্গ
প্রিয় ফ্রাউ মিলেনা,
আপনাকে আমি প্রাহা থেকে একটি নোট পাঠিয়েছিলাম। এরপর মিরান থেকেও। কোনো জবাব আসেনি। আপনি যে দ্রুত উত্তর দেবেন হয়তো তাতে তেমন কোনো কিছু ছিল না- আমার ওই নোটে। তবে নীরবতা যদি আপনার ভালো থাকার লক্ষণ হয়- যা আমার ক্ষেত্রেও ঘটে, লেখালেখি থেকে বিরত রাখে, তাহলে আমি তৃপ্ত। হয়তো এটাও সম্ভব, মনে হচ্ছে সেটাই মূল কারণ, ওই নোটের মাধ্যমে কোনোভাবে আমি হয়তো আপনাকে বিরূপ করে তুলেছি। সে রকম হলে এ কথা বলা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই যে আমার আঙুলগুলো অপটু, যা লিখতে চাই তা না লিখে অন্য কিছু লিখে ফেলি, যা হয়তো এক্কেবারে উল্টো কিছু হয়ে যায়। অথবা তার থেকেও খারাপ কিছু হয়ে যাওয়াও সম্ভব। মোদ্দা কথা, শান্তভাবে শ্বাস নেওয়ার সময়টুকুও আপনি পাচ্ছেন না, যে সময়টুকু না পেলে আপনার কোনো কিছুই লেখা হয়ে ওঠে না। সুতরাং বলা যায়, সময় আপনার ভালো যাচ্ছে না। প্রথম সম্ভাবনার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। কেননা সেটার কাছাকাছি আমার নিজের অবস্থান নয়। বাকি সব কিছুর সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাচ্ছি। দ্বিতীয় সম্ভাবনার বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেওয়া আমার সাজে না। কিভাবে দেব? শুধু এই প্রশ্নটুকু রাখতে পারি যে কিছু দিনের জন্য ভিয়েনা ছেড়ে অন্য কোথাও কেন আপনি বেরিয়ে পড়ছেন না? আর যা-ই হোক আর দশটা-পাঁচটা মেয়ের মতো আপনি গৃহহীনা তো নন? বোহেমিয়া ঘুরে এলে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারতেন, তাই না? কিংবা অন্য কোনো কারণে, যা আমি হয়তো জানি না, আপনি বোহেমিয়া যেতে না চাইলে অন্য কোথাও তো ঘুরে আসতে পারেন। মিরানেও আসতে পারেন। মিরান কি আপনার চেনা শহর? এই দুটির মধ্যে একটি অন্তত আমি আশা করছি- হয় টানা অনিঃশেষ স্তব্ধতা- যার অর্থ উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, আমি ঠিকঠাক আছি; অথবা অন্য কোনো কথা!
আন্তরিক শ্রদ্ধাসহ
কাফকা
আপনার চেহারার খুঁটিনাটি আমার ঠিক মনে পড়ছে না। শুধু কফি হাউসে টেবিল ছেড়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনার শারীরিক গঠন এবং পোশাকের ছায়াটুকু এখনো চোখের সামনে ভাসছে।

(২)
প্রিয় ফ্রাউ মিলেনা,
আজ আমি আপনাকে আলাদা করে কিছু লিখতে চাইছি, কিন্তু হয়ে উঠছে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে বিষয়টিকে আমি ভাবগম্ভীর করে তুলতে চাইছি। চাইলে, লেখাটাও অন্য রকম হতো। কিন্তু এখন সার্বক্ষণিকভাবে সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হলো বাগানের কোথাও আপনার জন্য একটা ডেকচেয়ার প্রস্তুত রাখা। এটা থাকবে অর্ধেক ছায়ায় এবং আপনার হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে অন্তত ১০ গ্লাস দুধ। ভিয়েনায়ও এটা সম্ভব, বিশেষ করে এই গ্রীষ্মে। তবে খিদে আর অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া? একেবারেই চলবে না। এটুকু করা কি সম্ভব নয় বা সম্ভব করে তোলার মতো এমন কাউকে আপনি পাবেন না? ডাক্তার কী বলেছেন? বড় খাম থেকে যখন পাণ্ডুলিপিটি বের করছিলাম, আমি প্রায় হতাশ হয়ে গেছিলাম। আপনার কাছ থেকে আসলে আমি শুনতে চেয়েছিলাম আপনার নিজের কথা। আমি চাইনি পুরনো কোনো কবরস্থান থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসুক। অথচ এটাই কিভাবে যেন আমাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে। পরে মনে হলো এ হয়তো আমাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করতে চাইছে। সব মিলিয়ে আমার মাথার মধ্যে কিন্তু কিছুই ঢুকছে না, কী করে আপনি এত পরিশ্রমের কাজে হাত দিলেন। আপনি যে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কাজটি করেছেন তাতে আমি মুগ্ধ আর গভীরভাবে আলোড়িত। বাক্যের জন্য বাক্য, আস্থা রাখার মতো করে চেক ভাষায় যে অনুবাদ করা সম্ভব, আমার ভাবনায় আসেনি। আপনার এই বিশেষ ক্ষমতা এবং স্বাভাবিক গুণ সম্পর্কে আমার জানা থাকা উচিত ছিল। জার্মান ও চেক ভাষার মধ্যে কি এতটা নৈকট্য আছে? জানি না, থাকলেও থাকতে পারে। তবে যা-ই হোক না কেন এসব আলোচনার কোনো শেষ নেই। বহুদিন থেকে যে এই বেহুদা বিতর্কটা চলে আসছে, সেটা আমি আপনাকে প্রমাণ করে দিতে পারি ফ্রাউ মিলেনা! আক্ষরিক অনুবাদ তো খুব সহজেই করা যায়। এর বাইরের যা কিছু, সেটা করতে গিয়ে বাধাগুলো মূলের তুলনায় কখনো কখনো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ঘটনাটা হলো, আপনাকে সেই ধরনের গল্পই পছন্দ করতে হবে, যে গল্পে কিছু না কিছু মূল্যবোধের কথা আছে। কিন্তু তাতে হয়-কি, আমাদের জগতের চেহারাটাই অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য আর দুষ্পাঠ্য হয়ে উঠতে পারে। অচেনা, বৈশিষ্ট্যহীন হয়ে পড়াও সম্ভব। এ ব্যাপারে আমি আর বেশি কিছু বলছি না। আপনি উল্ফের কাছ থেকে আমার 'গ্রামের ডাক্তার' গ্রন্থটি পেয়ে যাবেন। বইটা আমি তাকে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছি।

অবশ্যই আমি চেক ভাষা বুঝি। আমি কয়েকবার আপনাকে বলতে চেয়েছি, আপনি আমাকে চেক ভাষায় কেন চিঠি লেখেন না? এ কথা বলছি না যে আপনি জার্মান ভালো জানেন না বা বোঝেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনি জার্মান ভাষাদক্ষতার আশ্চর্যজনক প্রমাণ দিচ্ছেন, কখনো ক্বচিৎ ব্যর্থ হলে সেখানেও দেখছি ভাষা নিজে থেকেই আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করছে এবং এটা অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনাই বটে, তৃপ্তিরও। কেননা কোনো জার্মান নিজেও তার ভাষার কাছ থেকে এমনটা পাবে, আশা করারও সাহস পাবে না। তার সাহস হবে না ভাষাকে এতটা ব্যক্তিগত স্তরে ছুঁয়ে দেওয়ার। কিন্তু আমি আপনার চেক ভাষায় লেখা চিঠি পড়তে চেয়েছিলাম। কারণ এই ভাষার সঙ্গে আপনি গভীরভাবে যুক্ত। হয়তো এই ভাষা প্রকাশের মধ্যেই আমরা পেতে পারি পূর্ণাঙ্গ মিলেনা য়েসেনেস্কাকে (আপনার অনুবাদ সে কথাই প্রমাণ করছে)। অথচ ভিয়েনায় কেবল আপনি, অথবা বলা যায় ভিয়েনায় কেবল একজনই আছেন, আর সে হচ্ছেন আপনি যিনি নিজেকে এ কাজের জন্য প্রস্তুত করেছেন। সুতরাং চেক ভাষায় আমাকে চিঠি দিন, প্লিজ! যে ফেউইলেতোঁর কথা আপনি উল্লেখ করেছেন, সেটাও আপনি পাঠিয়ে দেবেন। জীর্ণ যদি হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। আপনি তো সব মালিন্যসহ আপনার মতো করে আমার গল্পগুলো পড়েছেন। কত দূর এগোতে পেরেছিলেন জানি না। সম্ভবত আমি ততটুকুই করতে চাই যতটুকু সম্ভব। যদি না পারি, তাহলে আমার সংস্কার কুসংস্কার আর সিদ্ধান্তেই অনড় থেকে যাব।
আপনি আমার বাগ্‌দান সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। দু-দুবার বাগ্‌দান হয়েছিল আমার। আপনি চাইলে তৃতীয়বারও হতে পারে। তবে মনে রাখা দরকার, প্রথম মেয়েটির সঙ্গে আমার বাগ্‌দান হয়েছিল দুবার। সে রকম যদি আবার হয়, তাহলে বিয়ে ভাঙার ঘটনা ঘটবে তিনবার। তাও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। প্রথম বিচ্ছেদের আর কোনো অবশেষ নেই। এর পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। (শুনেছি তাঁর বিয়ে হয়েছে, সন্তানও।) দ্বিতীয় বাগ্‌দানে এখনো কিছুটা হলেও প্রাণ আছে, তবে এর সফল পরিণতির আশা নেই। ফলে এই বাগ্‌দানের বেঁচে থাকা বা না থাকাটাকে ঠিক জীবিত না বলে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা বলে আখ্যায়িত করলেই ভালো হয়। মানবজীবনের নিয়মই এটা। অবশ্যই এই ঘটনায় এবং অন্যান্য আরো কয়েকটি ঘটনায় সাধারণভাবে আমি লক্ষ করেছি, পুরুষরাই বেশি ভোগে। কেউ যদি অন্যভাবে দেখতে চান তাহলে দেখা যাবে, এসব বিষয়ে পুরুষদের প্রতিরোধের ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোগে তাদের সরলতার কারণে। বিষয়টা এমন নয় যে তাদের ভুলত্রুটি হয় না, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তারা বাস্তববাদী হয়ে ওঠে। আবার সেই একই অনুভূতি, কোনো দোষ না করার অনুভূতি। এসব ব্যাপারে নিজেকে খুব বেশি প্রকাশিত করে ফেলাটাও কাজের কথা নয়। ব্যাপারটা এমন, কাউকে হয়তো নরকের একটা বড় কড়াই, যাতে তরল পদার্থ গরম হয়, ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা চালাতে হবে। প্রথমত, এ রকম করা যায় না; দ্বিতীয়ত, যদিও বা করা যায়, যে করবে তাকে পুড়ে মরতে হবে। ওই পাত্র থেকে উথলে ওঠা ফুটন্ত তরল পদার্থের ঘায়ে তার শরীরের মাংস গলে গলে পড়বে। সুতরাং বিষয়টা সামলাতে হবে অন্যভাবে।
শুরু করার জন্য যেভাবেই হোক বাগানে শরীর এলিয়ে দিন আর অসুস্থতা থেকে নিজেকে বের করে আনুন। এটা যদি বাস্তবে নাও হয়, যতটা সম্ভব আপনি সজীব হয়ে উঠবেন। অপার মাধুর্যে আপনাকে ছুঁয়ে যাবে।
আপনার, ফ্রানৎস্ কে.

(৩)
মিরান, মে ১৯২০
প্রিয় ফ্রাউ মিলেনা,
এভাবে সম্বোধন করাটাই আমার আর ভালো লাগছে না। কিন্তু ক্লান্তিকর নিরাপত্তাহীন এই বিশ্বের এটা এমনই একটা মাধ্যম, অসুস্থ দুর্বল মানুষও একে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে পারে। কবে এটা যদি ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে তাহলে তা কিন্তু স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার লক্ষণ হতে পারে না।] অনেকটা নিঃসঙ্গ আমি। মানুষের মাঝে সেইভাবে বাস করিনি। জার্মান আমার মাতৃভাষার চেয়ে কম কিছু নয়। এই কারণে জার্মান ভাষাকে আমার জন্য স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। চেক ভাষাও আমার অন্তরের কাছাকাছি একটা ভাষা। এ ভাষার সঙ্গে মিশে থাকে আমার হৃদয়ের অনুভব। এই কারণে আপনার চিঠি আমার ভেতরকার অস্বস্তিকে দূর করে দিয়েছে। আমি আপনাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। আপনার শরীরের আলোড়ন, নড়াচড়া, দুটি হাত, হাতের আঙুল- এত প্রাণবান আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে ভাবতেই ভালো লাগছে। এ যেন একটা একটা করে সব কিছুর অন্তরঙ্গ অবলোকন। অথচ আমার চোখ দুটিকে যখনই আপনার মুখের দিকে চেয়ে থাকার জন্য তুলে ধরি, আশ্চর্যজনকভাবে আপনার চিঠির মধ্যে ডুবে যাই! কী দারুণ একটা গল্প! আগুন জ্বলে উঠছে। আমি আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এ গল্প আপনার জীবন থেকে উঠে আসা নিয়মনীতিকে মেনে চলতে প্রলুব্ধ করবে। এরই মধ্য দিয়ে আপনি আপনার নিজের জীবনকে মেলে ধরছেন। এরই প্রভাবে আপনি কারোর করুণা পেতে আগ্রহী নন। আপনার এই সুদৃঢ় অবস্থান ভীষণ স্বাভাবিক। যেহেতু কোনো বিধিবিধান বা নিয়মকানুন আইন প্রণয়ন ছাড়া নির্ভেজাল ঔদ্ধত্য বা আত্মশ্লাঘার বেশি কিছু নয়, সেই নিয়মের বাস্তব প্রমাণও আপনি রেখেছেন। অন্যদিকে এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আপনার আছে বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, খুব সন্তর্পণে আপনার হাতের আঙুলে আমার চুম্বনের স্পর্শটুকু দিয়ে যেতে চাই। আমার দিক থেকে আমি বলতে পারি, জাগতিক বিধিবিধান আমি মানি না। এ কথা বিশ্বাস করা আমার বেশ কঠিন, এই বিধিবিধান বা নিয়মকে অনুসরণ করার ফলে আপনাকে খুব একা থাকতে হবে। আসলে এ এক আত্মদর্শন, কেবলই অন্তর্দর্শন- পথ আর পথের অনির্দিষ্ট অভিমুখে পৌঁছার।
কিন্তু এসব ছাড়া যে চরম উত্তাপের আগুনে আপনি বসবাস করছেন সেখানে সীমিত মানবিক বুদ্ধিমত্তার চোখ দিয়ে আপনাকে দেখতে পাওয়া, সে এক মারাত্মক কাজ। এই মুহূর্তে আমি আমার নিজের কথাই বলি। স্কুল হোমওয়ার্কের মতো কেউ যদি আপনার পুরো কাজটুকু লক্ষ করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই দেখতে পাবেন, আমাকে ঘিরে তিন ধরনের সম্ভাবনা আপনার মধ্যে বিরাজ করছে। আপনি নিজের সম্পর্কে আমাকে কিছু না জানাতে পারেন, কিন্তু সেটা করলে এই যে আমি আপনাকে জানতে পারছি, জেনে আনন্দ পাচ্ছি, এই আনন্দ থেকে আপনি আমাকে বঞ্চিত রাখতেন। তবে এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হলো এই তৃপ্তি, এই আনন্দকে আমার যাচাই করে নেওয়ার আনন্দ। সুতরাং এটা রুদ্ধ করে দেওয়ার দুঃসাহস আপনি কখনো করবেন না, প্লিজ। দ্বিতীয়ত, অনেক কিছুই আমার কাছে আপনি গোপন রাখতে পারতেন কিংবা তাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আমার কাছে পরিবেশন করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে আমার যা অবস্থা, সেই অবস্থায় এমনটা করলে আমি দ্বিগুণ মর্মাহত হব। এ কারণেই হয়তো আপনি আগেও সেসব করার সাহস পাননি। এবার বলি তৃতীয় সম্ভাবনা সম্পর্কে। আপনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজেকে কিছুটা সুরক্ষিত রাখতে। এই চেষ্টার ঈষৎ আভাস পাওয়া যায় আপনার চিঠিগুলো থেকে। আমি প্রায়ই আপনার বিপুল যন্ত্রণা, প্রশান্তি, সাহস আর আত্মসংযম থেকে পাঠ নিই। তবে শুধু এসব নয়, আরো অনেক কিছুরই পাঠ নিচ্ছি আপনার চিঠিগুলো থেকে। এ পাঠ বাস্তব জীবনের ভয়াবহতার।
স্বাস্থ্য বিষয়ে আপনি যা লিখেছেন তাতে আমি সন্তুষ্ট নই (আমার স্বাস্থ্য ভালোই আছে। একটাই অসুবিধা, এই পাহাড়ি হাওয়ায় ঘুম ভালো হচ্ছে না)। চিকিৎসকের পরামর্শ হলো, সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাওয়ার অনুকূল অবস্থা এখনো আসেনি। অথবা বলা ভালো, পরিস্থিতি এখনো প্রতিকূল রয়ে গেছে। কেবল আপনার প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা সম্ভব এর ব্যাখ্যা ঠিক কী হতে পারে। ডাক্তাররা অবশ্যই কিছুটা নির্বোধ। স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। অথবা তেমন একটা নির্বোধ নয়, যতটা নির্বোধ হয়ে থাকে অন্যরা। কিন্তু তাদের ভানটুকু সত্যি হাস্যকর বলে মনে হয়। যা-ই হোক, আমাদের এটাই বুঝে নিতে হবে যে আগের তুলনায় দিনে দিনে আরো কত স্থূলবুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে তারা। এসব ডাক্তারের সমকালীন চাহিদাকে অবশ্য কোনোভাবে স্থূলবুদ্ধির চাহিদা বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যেটা অসম্ভব তা হলো, আপনি সত্যি সত্যিই অসুস্থ বোধ করবেন এবং এই বোধ আপনার কখনো কাটবে না। ফলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার পর কোন দিক থেকে আপনার জীবনে পরিবর্তন এলো, সেটাই বড় প্রশ্ন। অবশ্য আরো কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, যে প্রশ্নগুলো করার অনুমতি আপনি অন্তত আমাকে দেবেন।
কেন আর কখন থেকে আপনি আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন? কেনই বা আপনি বললেন, ভিয়েনায় একসময় অসংখ্য মানুষ বাস করত, কিন্তু এখন করে না? আপনি লিখেছেন, আপনার মালিন্যভরা কোনো কিছু আপনি আমাকে পাঠাতে চান না। এ কথার অর্থ হলো, আমার ওপর আপনার এতটুকু আস্থাও নেই যে আপনার সম্পর্কে যে ধারণা আমার হয়েছে, সেই ধারণা আমার বদলে যাবে। এ রকমটাই তো মনে করছেন, তাই না?
ঠিক আছে, আপনার ওপর আমার রাগ হচ্ছে; আর রেগে গেলেই বা আপনার কী আসবে যাবে? এটা আসলে কোনো বিয়োগান্তক নাটকের বিষয় নয় তো? বাস্তব জীবনের দুঃখজনক তেমন কোনো ঘটনা? যা-ই হোক, হৃদয়ের এক কোণে আপনার জন্য কিছুটা রাগ সঞ্চিত রইল। এতে দুজনের মানসিকতার কিছুটা ভারসাম্য রক্ষিত হবে।
আপনার, ফ্রানৎস্ কে.

(৪)
মিরান, ৪ জুন ১৯২০
শুক্রবার
আজ সন্ধ্যার দিকে একা একা, আমি নিজে, সত্যি সত্যিই এই প্রথম অনেকটা হাঁটলাম। এর আগে এত দিন হেঁটেছি অন্য লোকদের সঙ্গে। বলা দরকার, প্রায়ই বাড়িতে একা বসে, শুয়ে, ঘুমিয়ে, সময় কাটে আমার। এ আসলে কোন দেশ! মিলেনা, সূর্য, আপনি যদি এখানে থাকতেন, ওহ্ তাহলে বুঝতে পারতেন! 'হতবুদ্ধিসম্পন্ন আমার এই মাথায় এর বেশি কিছু আসছে না!' তবু মিথ্যে বলা হবে যদি আপনাকে আমি না বলি, আমি আপনাকে অনেক মিস করছি। এটাই সব কিছু ছাপিয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো, এক ধরনের জাদুও বটে- আপনি এখানে আমার কাছেই আছেন। আছেন আমার অস্তিত্বে, আমার সর্বসত্তায়। যেখানেই যাই, আপনি থাকছেন আমার পরিসরজুড়ে অথবা তার চেয়েও বেশি। আমি কৌতুক করছি না, কখনো কখনো কল্পনা করি আপনি এখানেই আছেন আপনিও আমাকে মিস করছেন। প্রশ্ন করেন আমাকে : 'তিনি কোথায়! তিনি তো মিরানে আছেন বলেই জানিয়েছিলেন!'
এফ.
আমার লেখা দুটি চিঠিরই উত্তর কি আপনার হাতে পৌঁছেছে?

(৫)
আমি আরেকবার আপনার রবিবারের চিঠিটা পড়লাম। প্রথম পাঠের পর এই চিঠিটা যত ভয়াবহ বলে মনে হয়েছিল, এখন দেখছি তা আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। আমার ভেতরকার কেউ একজন চাইছে, মিলেনা, আপনার সমগ্র মুখমণ্ডল তার দুহাতের তালুর মাঝে নিয়ে আপনার গভীর দুই চোখের ওপর নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে, যাতে আপনি তার সেই দুচোখের মণির আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি গভীরভাবে প্রতিফলিত দেখবেন এবং নিজের সত্তাটাকে চিনতে পারবেন। আপনার চিঠিতে যা লিখেছেন তাও যেন কল্পনায় আনা আপনার পক্ষে সম্ভবপর না হয়।

(৬)
বিশ্লেষণের পালা এবার আমার। গতকাল এই ব্যাখ্যার প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছিলাম।
আমি চাই না (মিলেনা, অনুগ্রহ করে আমাকে সাহায্য করুন। অনুগ্রহ করে একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি যতটা বোঝাতে পারি অন্তত তার থেকে একটু বেশিই আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন) আমি চাই না (আমি আদৌ তোতলাচ্ছি না কিন্তু) ভিয়েনায় আসতে। কেননা, আমি মানসিক চাপের সঙ্গে পেরে উঠব না। মানসিকভাবে আমি সুস্থ নই। ফুসফুসের অসুখ আমার মানসিক রোগেরই বাড়তি লক্ষণ। আমার প্রথম দুটি বাগদান হয়ে যাওয়ার চার-পাঁচ বছর পর আমি এইভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি (প্রথম প্রথম এর কোনো ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পেতাম না। কারণ আপনার চিঠি পেয়ে মহানন্দে ডুবে থাকতাম। পরে খুঁজে পাই এর ব্যাখ্যা। ভুলে থাকার চেষ্টা করি সব কিছু। আপনার বয়স যথেষ্ট কম, যথেষ্ট যুবতী আপনি। পঁচিশেই হয়তো এখনো পা রাখেননি। সম্ভবত তেইশ-টেইশ এ রকম কিছু একটা হবেন। আমি সাঁইত্রিশ, বলতে পারেন প্রায় আটত্রিশ। বলা দরকার, প্রায় সামান্য হলেও প্রজন্মের ফারাক রয়ে গেছে আপনার সঙ্গে আমার। বিনিদ্র রাত্রি, মাথাব্যথার রাত্রি, আমার চুলে পাক ধরিয়ে দিয়েছে)। খুঁটিনাটি এসব আরণ্যক গল্প আমি আপনাকে শোনাতে চাইছি না। এর বিস্তৃত বিবরণ অযথা ব্যাখ্যারও কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা এসব লিখতে আমার সত্যিই ভয় করে। বাচ্চাদের মতো ভয়। তবে শিশুর আছে ভুলে যাওয়ার অসীম ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা আবার আমার নেই। তিনবার বাগ্‌দানের মধ্য দিয়ে সাধারণ যে ব্যাপারটি ঘটেছিল তা হলো, তিনবারের যা কিছু দোষ বা ত্রুটি, সবই ছিল আমার। সন্দেহাতীতভাবে আমার। দুটি মেয়েকেই আমি অসুখী করেছি। আমি এখন প্রথম মেয়েটির কথা বলছি। দ্বিতীয়টি সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। কেননা, মেয়েটি ভীষণ স্পর্শকাতর আর যেকোনো শব্দ, এমনকি অত্যন্ত বিনয়সূচক শব্দও কখনো কখনো তাঁর কাছে সাংঘাতিক বলে মনে হয়। এটা এখন আমি বুঝি, আমার জীবনে তাঁকে টেনে এনে (আমি চাইলে সে হয়তো নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল) চিরস্থায়ী কোনো সুখ জীবনে আমি পেতাম না। স্থিতিও আসত না। আসলে তাঁকে নিয়ে, ধীর-স্থির, শান্ত, দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ কোনো বিবাহযোগ্য পুরুষ হয়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। বারবার নিজে থেকেই আমি তাঁকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছি। তবু বলতে হয়, আমি তাঁকে কখনো কখনো পাগলের মতো ভালোবেসেছি। যদিও জানতাম না, বিয়ের চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত কিছু আমার মধ্যে ছিল কি না। আমি এভাবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে তাঁকে বারবার আঘাত করেছি। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। (আপনি এও বলতে পারেন, এভাবে আমি আসলে নিজেকেই আঘাত করেছি)। সৌভাগ্যের বিষয় হলো সে কখনো এসবে ভেঙে পড়েনি। একে সে প্রুশিয়ার অধিবাসী, তার ওপর আবার ইহুদি- এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরি এক দুর্জয় দৃঢ়চেতা নারী সে। অথচ আমি ঠিক তার উল্টো। স্বাস্থ্যবান নই, শক্তপোক্তও নই, প্রাণবন্ত তো নই-ই। ফলে শেষ অবধি ভুগতে হলো তাঁকেই। একই সঙ্গে ভুগলাম আমিও। আঘাতে আঘাতে নিজেই জর্জরিত হলাম।

(৭)
শনিবার
আপনার চিঠি পেয়েছিলাম। বলা দরকার, আপনার চিঠি আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। সব কিছু বাদ দিয়ে বলি, ওই চিঠির নির্যাসটুকু নিহিত রয়েছে একটিমাত্র অনুচ্ছেদে। সেটা হলো, আপনি আমাকে আর প্রাহাতে কোনো চিঠি পাঠাবেন না। সর্বপ্রথম আমি এই কথাটার ওপর জোর দিচ্ছি, যাতে এই দিকটির প্রতি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় আপনারও। এভাবেই হয়তো একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হুমকি-ধমকি দেয় আর দূর থেকে সে বুঝে যায়, যাকে সে ধমক দিচ্ছে তার মতলবটা আসলে কী।
সম্ভবত আমাকে আপনার চিঠি আর না লেখাটাই হবে ঠিক কাজ। ওই চিঠির বেশ কিছু অংশ এ কথারই প্রতিধ্বনি করছে। এর বিরুদ্ধে অবশ্য আমার কিছু বলার নেই। শুধু সেসব অংশ থেকে আমি বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি বেশ গভীরভাবেই, আমি এখন অনেক উচ্চতায় আরোহণ করেছি আর শুধু সে কারণেই এখানকার বাতাস খুব হালকা, অন্তত আমার ফুসফুসের ক্ষেত্রে তো বটেই। আমার জন্য অনিবার্য হচ্ছে বিশ্রাম নেওয়া।
আপনার এফ.

No comments:

Post a Comment