হিন্দি-আধিপত্য ঠেকানোর উপায় কী, কেন জরুরি?
চার বন্ধ হয়েছে। যদি আজ ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার আমরা বন্ধ করে দেই, তবে কাল থেকে ইউনিলিভারের মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের ক্রেতা ও ভোক্তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। লাক্স থেকে শুরু করে সানসিল্ক, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি থেকে শুরু করে ডাভ পর্যন্ত প্রতিদিনের ব্যবহার্য প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন আমরাএখন মূলত ভারতীয় চ্যানেলগুলোতেই দেখি। স্টারপ্লাস, সনি আর জি চ্যানেলগুলোর জন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যে বাজেট রাখে তা বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর জন্য রাখে না। দেখা গেছে, তাদের বাজেটের বড় অংশটাই ভারতীয় চ্যানেলগুলোর জন্য বরাদ্দ। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো যা পায় তা ছিঁটেফোটা মাত্র। ফলে আজ যদি আমরা বাংলাদেশে ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেই তবে আগামীকাল থেকে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো লাভবান হতে শুরু করবে।
বিজ্ঞাপন থেকে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়বে। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো নতুন নতুন কাজ পাবে। প্রথম দিকে ভারতে তৈরি বিজ্ঞাপনগুলো এখানে প্রচারিত হবে। কিন্তু, ধীরে ধীরে সেদেশের ছোট ছোট স্টাররা আমাদের দর্শকদের কাছে গুরুত্ব হারাবে। ফলে, আমাদের নায়ক-নায়িকাদের নিয়েই বিজ্ঞাপন তৈরির তাগিদ তৈরি হবে। আর বেশি কল্পনা করার দরকার নেই। এবার ভিন্ন দিকে যাওয়া যাক।
আজ যদি ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয় তবে রাতারাতি আরেকটি চাপ তৈরি হবে। বাংলাদেশের দর্শকরা চাইবেন- এদেশের চ্যানেল তাদের একই জিনিশ দেখাক অথবা বিকল্প কিছু তাদের সামনে নিয়ে আসুক। দর্শকদের এই চাপ যদি আমাদের চ্যানেলগুলো, নির্মাতারা, কলাকুশলীরা অনুভব করেন তবে ভালো কিছু হতেই পারে। সবার চেষ্টায় বিকল্প বিনোদন-ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। আর সে চাপ যদি অনুভূত না হয় তবে দর্শকরা খুব দ্রুত হতাশ হয়ে আবার ভারতীয় চ্যানেল প্রচারের দাবি তুলবেন।
আমি খুব ছোট করে একটি কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভারতীয় বা বাংলাদেশি চ্যানেল খোলা বা বন্ধ রাখার প্রশ্নটা প্রথমত অর্থনৈতিক। আমাদের দেশে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের স্বত্বাধিকারীরা গত কয়েক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। শত শত মানুষ এইখাতে কাজ করছেন, কিন্তু চ্যানেল ব্যবসায় মন্দা কাটছে না। নতুন নতুন চ্যানেল আসছে। কিন্তু পুরনো দু’একটা ছাড়া কেউ লাভের মুখ দেখছে না, বিনিয়োগ উঠে আসা দূরের কথা। সারাবিশ্বেই টেলিভিশন ও বিনোদন বাণিজ্যের রমরমার যুগে বাংলাদেশ যে ব্যতিক্রম তার মূল কারণ হলো, ভারতীয় বিনোদন বাণিজ্যের দাপটের সামনে আমরা নতজানু হয়ে বসে আছি।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের আস্থাভাজনদের মধ্যে টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স বিতরণ করছে, এটি খুব ভালো কথা। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে টিভির লাইসেন্স দেওয়ার কিছু কুফল আছে। চ্যানেলগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। এ উদ্দেশ্য থেকে সব টিভিই খবর ও টকশো করতে চায়। কিছু বিনোদনও করতে চায়। খবর ও বিনোদনের মিশ্রণে সবগুলো চ্যানেলই একরকম হয়ে গেছে। বলতে গেলে কোনো ব্যতিক্রম নেই। খবর করতে গিয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। বিনোদনের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ কারও নেই।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কি এমন মানুষ নেই যারা শুধু সিনেমার জন্য তিনটি চ্যানেল করতে পারেন? এফডিসির বাংলা সিনেমা নিশ্চয় চলবে তাতে, ডিজিটাল সিনেমা চলবে, নতুন নির্মাতাদের সিনেমা চলবে, বিদেশ থেকে আনা সিনেমা ডাবিং করে চালানো হবে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে এমন কেউ কি নেই যারা ছোটদের জন্য দু-তিনটি চ্যানেল করতে পারেন? আমাদের দেশে কার্টুন তৈরি জন্য যা দরকার সবই আছে। শুধু বিনিয়োগ নেই। চ্যানেল থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে। বাটুল দ্য গ্রেট, চাঁদের বুড়ি ও ম্যাজিকম্যান, মোটু পাতলুর মতো কার্টুন তৈরি হতে সময় লাগবে না। যতদিন না হয় ততোদিন আমরা ডোরেমন সহ ছোটদের কাছে জনপ্রিয় কার্টুনগুলো ডাবিং করে চালাতে পারবো।
একইভাবে গানের জন্য, নাটকের জন্য, ফানের জন্য, ডকুমেন্টারির জন্য আলাদা চ্যানেল আমাদের সরকারগুলো বরাদ্দ দিতে পারে। রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করার জন্য ছায়ানট সংশ্লিষ্টদের একটি চ্যানেল দিলে আওয়ামী লীগ সরকারের কী সমস্যা হবে?
ইতোমধ্যে যে চ্যানেল বরাদ্দ দেওয়া হয়ে গেছে সেগুলোর মধ্য থেকে কেউ যদি বিশেষ কোনো চ্যানেলে রূপান্তরিত হতে চায় তবে তাদের সে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আর নতুনগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ চ্যানেলকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
টার্গেট নিলে, নাটকের জন্য ৫টি, বাচ্চাদের জন্য ৩টি, সিনেমার জন্য ৩টি, গানের জন্য ৩টি, ডকুমেন্টারির (ইতিহাস, কৃষি, ভ্রমণ, রান্না, লাইফস্টাইল, ধর্ম, ফ্যাশন)জন্য ৭টি চ্যানেল, মিশ্র বিনোদন ও রিয়েলিটি শোর জন্য ৫টি চ্যানেল তৈরি করা সম্ভব। সত্যি কথা বলতে, ২০-২৫টা নিউজ চ্যানেল চালানোর মতো সাংবাদিক আমাদের নেই। এত টকশো চালানোর মতো রিসোর্স পারসনও আমাদের নেই। ফলে, নিউজ ও টকশোর মান পড়ছে দিনকে দিন। এগুলো দর্শক হারাচ্ছে। এগুলোর অধিকাংশই একই রকম এবং বোরিং হয়ে উঠেছে। টিভির জন্য নীতিমালা করলে, নিউজ ও টকশো ভিত্তিক চ্যানেল কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
আবার ফিরে যাই, ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল না দেখানো প্রসঙ্গে। আমাদের চ্যানেল না দেখিয়ে ভারতের লাভ হচ্ছে বহুমুখী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় যখন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যেত তখন সেদেশে বাংলাদেশের প্রসাধন-সামগ্রীর বাজার খুলেছিল। দেখানো বন্ধ করার পর বাজার আবার কমেছে। আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজার চলে গেছে ভারতের হাতে। আমাদের বিজ্ঞাপন নির্মাতারা মাল্টিন্যাশনালগুলোর কাজ পাচ্ছে না। আমাদের স্টাররা মাল্টিন্যাশনাল বিজ্ঞাপনের অফার পাচ্ছে না। বিনোদন-বাণিজ্যে আমাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের, ইধার কা মাল উধার করে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে খেতে হচ্ছে। আমাদের সিনেমা, গান, নাটক বিকশিত হচ্ছে না। এগুলো ইতোমধ্যে রুগ্ন খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। আমরা বিনোদনের জন্য এতটাই ভারত-নির্ভর হয়ে পড়েছি যে, অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন যে এর কোনো বিকল্প নেই।
বিনোদনের ক্ষেত্রে ভারত-নির্ভরতা আরও কিছু পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, স্বকীয়তা, ঐতিহ্য আমরা হারাতে বসেছি। হিন্দি গানের পাশে এখনই বাংলা গান লোকায়ত সঙ্গীত হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেছে। এমনকি আমাদের জাতীয় অনুষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক তকমা পরাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বদলে হিন্দি পপ-সংস্কৃতির কাছে আমাদের হাত পাততে হচ্ছে। হিন্দি গান খারাপ নয়, বলিউডের সংস্কৃতিও পরিত্যাজ্য নয়। কিন্তু, সে সংস্কৃতিটা মূলত হিন্দিভাষীদের জন্য। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের তামিল-তেলেগুভাষী মানুষ একে গ্রহণ করেনি। বলিউড যেখানে সেই মুম্বাইয়ের মারাঠিরাও একে মেনে নেয়নি। এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের বলিউড নির্ভরতা মুম্বাইয়ের পরিস্থিতিকেও হার মানাতে চলেছে।
হিন্দি চ্যানেলগুলোর কারণে, আমাদের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই হিন্দি ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে কমিউনিকেশনের জন্য হিন্দিভাষা ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু সেটি কতটা কার্যকর সেটা ভাবা দরকার। কেননা, ভারতের ভেতরে বিভিন্ন ভাষার মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে। সেখানে আমাদের শিশুদের হিন্দি শেখা তেমন কাজে আসবে না। এমনিতে শিশুরা একসঙ্গে তিনটি ভাষা আয়ত্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলার পর ইংরেজিকে বেছে নেয়াই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু টিভির প্রভাবের কারণে বাংলার পর হিন্দি ভাষা স্থান করে নিচ্ছে। প্রথমে বাংলা তারপর ইংরেজি থাকা উচিত। ইংরেজির পর হিন্দি, আরবি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান যেকোনো ভাষার অপশন রাখলে ভালো।
লাভ-ক্ষতির হিসাব তো আছেই। কিন্তু বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করার পেছনে সবচেয়ে বড় যে যুক্তি আমাদের হাতে আছে তা হলো- ওরা বহু বছর ধরে আমাদের চ্যানেল বন্ধ রেখেছে।
তবে, হঠাৎ একদিন চ্যানেল বন্ধ করার দরকার নেই। এজন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। আগে থেকে ঘোষণা দিতে হবে যে অমুক মাসের অমুক তারিখ থেকে আমরা চ্যানেল বন্ধ করে দেবো। এই সময়ের মধ্যে কিছু কাজ করতে হবে।
দর্শকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
নিজেদের লাভ বুঝে উপযুক্ত বিকল্প তৈরির জন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।টিভি চ্যানেলগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। পুনর্বিন্যাস করতে পারলে যেখানে ২০-২৫টি চ্যানেলই বেশি মনে হচ্ছে সেখানে ৫০টা চ্যানেলও বেশি মনে হবে না।
আমাদের এনিমেশন, গান, নাটক, সিনেমার উত্থানের জন্য তরুণদের জায়গা করে দিতে হবে। এফডিসির মতো প্রতিষ্ঠান তরুণদের জন্য খুলে দিতে হবে। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের মতো বেসরকারি উদ্যোগ আরও উৎসাহিত করতে হবে।
কাজগুলো খুব কঠিন নয়। এর সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ও বিনিয়োগের স্বার্থ জড়িত। এটা ঘটানো দরকার। কথা চলতে থাকুক। আমাদের বর্তমান সরকার ও এর সংস্কৃতি ও তথ্যমন্ত্রণালয় ভীষণ দেশপ্রেমিক। তারা যে দেশের টিভি, সিনেমা, গান ইত্যাদির বিকাশ চান। ইন্ডাস্ট্রিকে শক্তিশালী করতে চান। আর ভারতের চ্যানেল বন্ধ করার পক্ষে আমাদের যথেষ্ট যুক্তি আছে। নিশ্চয় বলতে বলতে আমরা একসময় তাদের মন গলাতে পারবো।
মাহবুব মোর্শেদকথাসাহিত্যিক
[মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। এর দায় কোনোক্রমেই পরিবর্তন ডটকমের নয়।]
http://www.poriborton.com/post/50325/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF-%E0%A6%86%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%A0%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF
No comments:
Post a Comment