মওদুদের বই : খালেদা ও হাসিনা সম্পর্কে অজানা তথ্য
মোবায়েদুর রহমান : বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘বাংলাদেশ : ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ’। বইটির বাংলা সংস্করণের নাম ‘কারাগারে কেমন ছিলাম: ২০০৭-২০০৮’। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের গ্রন্থের নাম ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’। এই বইটি আলোড়ন তুলেছে একটি বিশেষ কারণে।
মওদুদ আহমদের বইটি আলোচনায় এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। এর আগে ২০১০ সালে তার আর একটি বই প্রকাশিত হয়। নাম ‘চলমান ইতিহাস’। কারাগারে কেমন ছিলামের এর মত চলমান ইতিহাস তেমন ঢেউ তুলতে পারেনি। কারাগারে কেমন ছিলাম বইটি নিয়ে ঢেউ তুলেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বইটিকে কেন্দ্র করে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করে মওদুদ আহমদকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। তার সেই আক্রমণাত্মক বক্তব্য পড়ে আমি বইটি পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি। আমার সংগ্রহে রয়েছে বাংলা সংস্করণটি। ৩৯১ পৃষ্ঠার বই। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। এত বিশাল একটি বইয়ের দুই এক পৃষ্ঠা মাত্র টাচ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব।
অথচ এই বইটিতে এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি এবং ভূম-লীয় রাজনীতির ফরম্যাটে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই পুস্তিকায় এক-এগারোর জরুরি সরকারের সাথে বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সম্পর্ক যেমন আলোচিত হয়েছে- তেমনি মওদুদ আহমদ বেগম জিয়ার সাথে কথা বলার পর এমন সব তথ্য দিয়েছেন যেগুলো আজো দেশবাসীর অনেকের কাছেই অজানা। এক-এগারোর দুই বছরে যেসব জানা-অজানা ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে উইংসের আড়াল থেকে পাদ প্রদীপের আলোকের সামনে আনার জন্য মওদুদ সাহেব ধন্যবাদ পেতে পারেন। তার বইটি পড়ার পর অন্তত ৩৬টি পয়েন্ট আমি নোট করেছি যেগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এই সংকীর্ণ পরিসরে সেটি সম্ভব নয় বলে আমি পুস্তকটির উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে আলোচনা করব।
শেখ মুজিব ও জিয়া
বইটির ৩৪ ও ৩৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের মূল কৌশল অনুযায়ী এ বাহিনীকে একটি নি¤œতর বাজেটের অধীনে ক্ষুদ্র একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে রাখা হয়। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, শেখ মুজিব সেনাবাহিনীকে নিজের কর্র্তৃত্বাধীনে রেখে দেয়ায় তিনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন, আর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে তার ভূলুণ্ঠিত মর্যাদা ও সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে তার মূল অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করায় তাঁর বিরোধিতাকারীদের শিকার হয়েছেন”।
এই বইটি আসলে জনাব মওদুদের এক-এগারো আমলের কারাগারের দিনলিপি বা দিনপঞ্জি, যেটিকে আমরা ইংরেজিতে বলি ডাইরি। বইটির মোড়ক উন্মোচনের পর, বিশেষ করে রিজভীর সংবাদ সম্মেলনের পর, রাজনৈতিক মহল বিশেষ এই বইটিকে এবং মওদুদ আহমদকে বিএনপি এবং বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনি বইটি যদি খুঁটিনাটি পড়েন তাহলে দেখবেন যে সেখানে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক বেশি গোলা বারুদ রয়েছে। পাশাপাশি বেগম জিয়ার অনমনীয় মনোভাবও প্রকাশিত হয়েছে এই বইটিতে। বইটির ছত্রে ছত্রে আওয়ামী রাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
শেখ হাসিনা
১০৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘অনেকদিন যাবৎ একটি সুগভীর প্রোথিত আন্তর্জাতিক চক্রান্তের জের ধরে বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ প্রতিপন্ন করে এর ভাবমূর্তি বিনষ্টের প্রয়াস চালানো হচ্ছিল। বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার দেশে এবং বিদেশে নিজের দেশ বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।’
যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাজারে নানা মহলে নানা কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপির ভূমিকা কোনো সময়ই স্বচ্ছ নয়। কিন্তু জনাব মওদুদ তার মত তুলে ধরেছেন বইটির ১৯০ পৃষ্ঠায়। দিনলিপি, সোমবার, ১২ নভেম্বর, ২০০৭। এখানে তিনি লিখছেন, ‘সম্প্রতি আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে। এটা অনেকটাই রহস্যে ভরা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সাড়ে তিন বছর ওরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। যারা গণহত্যা চালিয়েছে ও তাদের সহযোগিতা করেছে তাদের বিচারের জন্য সে সময় একটা আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং দালাল বা সহযোগী হিসেবে একজনকেও সাজা দেয়নি। ১৯৯১-৯৫ সালের পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দল হিসেবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে তখন আজ যাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে সেই জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অংশীদার। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারে অধিষ্ঠিত থাকাকালে একদিনের জন্যও তারা এ ইস্যু নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। এক কথায় বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো আওয়াজ তোলেনি। এখন হঠাৎ করে এ ইস্যু ওঠানোর রহস্য কি?”
আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্র
একটি কথা এখন মুখে মুখে চাউর হয়েছে যে আওয়ামী লীগ এবং গণতন্ত্র এক সাথে যায় না। সেই বিষয়টি লেখক তুলে ধরেছেন বইটির ২৯১ পৃষ্ঠায়। ঘটনাটি মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০০৮। মওদুদ আহমদ লিখেছেন, “আওয়ামী লীগ বিভাজনের রাজনীতির আরেক পর্যায়ের সূচনা ঘটালো। দলের প্রেসিডিয়ামের এক বৈঠকে তারা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা খালেদা জিয়া ঘোষিত জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যোগ দেবে না এবং আমাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির সুযোগ নিয়ে সরকারকে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যেতেই সহায়তা করবে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, আওয়ামী লীগ কখনোই সত্যিকারের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং উচ্চ গুণসম্পন্ন কোনো নির্বাচনে তারা উৎসাহিত নয়। এখানে নীতিগত বিষয়টি একেবারেই মুখ্য নয়।”
এর পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। বইয়ের ২৯০ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, “সকল নিষেধাজ্ঞা ভেঙে সংবাদপত্রগুলো গতকাল আদালতে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য প্রধান শিরোনামে প্রকাশ করেছে। সেখানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই বক্তব্যের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী এবং দলের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীদের মানসিকতা চাঙ্গা করে তুলতে তা বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।
জাতীয় স্বার্থ ও আওয়ামী লীগ
আমার মনে হয়েছে যে, বিএনপির কিছু কিছু নেতা মওদুদ সাহেবের বইটি ভালো করে পড়েননি। সেটা হতেই পারে। কারণ, ৩৯১ পৃষ্ঠার বই পড়তে সময় লাগে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এই বইয়ে মওদুদ আহমদ আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বইটির ৩০০ এবং ৩০৭ পৃষ্ঠায় গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা তার মুক্তির বিনিময়ে সরকারের সাথে কোন্ কোন্ শর্তের ভিত্তিতে সমঝোতা করেছিলেন তা কেই জানে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জাতীয় একটি স্বার্থকে বিলিয়ে দিতে আওয়ামী লীগ কখনোই দ্বিধাবোধ করে না। শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে প্যারোলে মুক্তি পেলেও আসলে তা ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তিনি খুব আমোদের সাথেই ছুটি উপভোগ করছেন। কানাডাতে গিয়ে তিনি মেয়েকে দেখে এসেছেন। তার ভাগ্নে, রেহানার ছেলের বিয়ে খেতে গিয়েছেন ফিনল্যান্ড ও লন্ডনে। সেখানে থেকে ফিরে যাবেন আমেরিকায়। কী চমৎকার চিকিৎসা চলছে?’
অনেক তথ্য আছে এই বইয়ে, যেগুলো অনেকেরই অজানা ছিল। মওদুদ সাহেব সেগুলো টেনে বের করে এনেছেন। এ সম্পর্কে আগামী বৃহস্পতিবার আরো একটি কিস্তি প্রকাশ করার ইচ্ছা রয়েছে।
বিএনপি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য
আজ বিএনপি সম্পর্কে লেখকের একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করব। ১৭৬ পৃষ্ঠায় মওদুদ আহমদ লিখছেন ‘১৯৯১-৯৬ সালের তুলনায় বিএনপি সরকারের রাজনৈতিক অবদান ২০০১-২০০৬ সালে ছিল নিঃসন্দেহে অনেক কম। এরপর আমরা ক্ষমতায় গেলে বিএনপির সাফল্য হয়তো হবে আরো কম- কারণ দলটির শাসন কৌশলে উন্নতির কেনো স্পর্শ লাগেনি। বিএনপির রাজনীতির রক্তধারায় আত্মোপলব্ধি এবং আত্মসংশোধন শব্দ দুটির কোনো অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতার দাপট, অর্থলোলুপতা, বিলাসবহুল জীবনযাপন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং দুর্নীতির মাত্রা বোধহয় একই পর্যায়ে থেকে যাবে। আওয়ামী লীগের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। এরপর যখনই তারা আবার ক্ষমতায় আসবে সেই শাসনকাল হবে আরো নিকৃষ্ট।
বিশ্ব পর্যায়ে বিএনপির বন্ধুহীন হয়ে পড়া এবং রাজনীতিতে প্রান্তিক অবস্থায় চলে আসার পেছনে মূল কারণ হলো দুটি। সেগুলো হলো- (১) জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গভীর সখ্যতার কারণে বিএনপিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এমন ইসলামী উগ্রবাদী শক্তির সহযোদ্ধা হিসেবে যাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয় (২) তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে থাকা লোকজনের দুর্নীতি। বিএনপি যদি এ দুয়ের গ্লানি কাটিয়ে ভারসাম্যময় মধ্যপন্থী গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে পারবে না এবং কোনো রকমে আসতে সক্ষম হলেও বেশিদিন তা ধরে রাখতে পারবে না। অন্যদিকে জাতি যদি নারী নেত্রীদের ব্যক্তিগত রাজনীতির প্রতি মোহান্ধ থেকে যায় তা হবে জাতির জন্য সম-পরিমাণেই বিবাদময়’।
http://www.dailyinqilab.com/মওদুদ আহমদের বইটি আলোচনায় এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। এর আগে ২০১০ সালে তার আর একটি বই প্রকাশিত হয়। নাম ‘চলমান ইতিহাস’। কারাগারে কেমন ছিলামের এর মত চলমান ইতিহাস তেমন ঢেউ তুলতে পারেনি। কারাগারে কেমন ছিলাম বইটি নিয়ে ঢেউ তুলেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বইটিকে কেন্দ্র করে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করে মওদুদ আহমদকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। তার সেই আক্রমণাত্মক বক্তব্য পড়ে আমি বইটি পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি। আমার সংগ্রহে রয়েছে বাংলা সংস্করণটি। ৩৯১ পৃষ্ঠার বই। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। এত বিশাল একটি বইয়ের দুই এক পৃষ্ঠা মাত্র টাচ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব।
অথচ এই বইটিতে এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি এবং ভূম-লীয় রাজনীতির ফরম্যাটে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই পুস্তিকায় এক-এগারোর জরুরি সরকারের সাথে বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সম্পর্ক যেমন আলোচিত হয়েছে- তেমনি মওদুদ আহমদ বেগম জিয়ার সাথে কথা বলার পর এমন সব তথ্য দিয়েছেন যেগুলো আজো দেশবাসীর অনেকের কাছেই অজানা। এক-এগারোর দুই বছরে যেসব জানা-অজানা ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে উইংসের আড়াল থেকে পাদ প্রদীপের আলোকের সামনে আনার জন্য মওদুদ সাহেব ধন্যবাদ পেতে পারেন। তার বইটি পড়ার পর অন্তত ৩৬টি পয়েন্ট আমি নোট করেছি যেগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এই সংকীর্ণ পরিসরে সেটি সম্ভব নয় বলে আমি পুস্তকটির উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে আলোচনা করব।
শেখ মুজিব ও জিয়া
বইটির ৩৪ ও ৩৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের মূল কৌশল অনুযায়ী এ বাহিনীকে একটি নি¤œতর বাজেটের অধীনে ক্ষুদ্র একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে রাখা হয়। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, শেখ মুজিব সেনাবাহিনীকে নিজের কর্র্তৃত্বাধীনে রেখে দেয়ায় তিনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন, আর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে তার ভূলুণ্ঠিত মর্যাদা ও সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে তার মূল অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করায় তাঁর বিরোধিতাকারীদের শিকার হয়েছেন”।
এই বইটি আসলে জনাব মওদুদের এক-এগারো আমলের কারাগারের দিনলিপি বা দিনপঞ্জি, যেটিকে আমরা ইংরেজিতে বলি ডাইরি। বইটির মোড়ক উন্মোচনের পর, বিশেষ করে রিজভীর সংবাদ সম্মেলনের পর, রাজনৈতিক মহল বিশেষ এই বইটিকে এবং মওদুদ আহমদকে বিএনপি এবং বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনি বইটি যদি খুঁটিনাটি পড়েন তাহলে দেখবেন যে সেখানে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক বেশি গোলা বারুদ রয়েছে। পাশাপাশি বেগম জিয়ার অনমনীয় মনোভাবও প্রকাশিত হয়েছে এই বইটিতে। বইটির ছত্রে ছত্রে আওয়ামী রাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
শেখ হাসিনা
১০৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘অনেকদিন যাবৎ একটি সুগভীর প্রোথিত আন্তর্জাতিক চক্রান্তের জের ধরে বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ প্রতিপন্ন করে এর ভাবমূর্তি বিনষ্টের প্রয়াস চালানো হচ্ছিল। বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার দেশে এবং বিদেশে নিজের দেশ বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।’
যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাজারে নানা মহলে নানা কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপির ভূমিকা কোনো সময়ই স্বচ্ছ নয়। কিন্তু জনাব মওদুদ তার মত তুলে ধরেছেন বইটির ১৯০ পৃষ্ঠায়। দিনলিপি, সোমবার, ১২ নভেম্বর, ২০০৭। এখানে তিনি লিখছেন, ‘সম্প্রতি আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে। এটা অনেকটাই রহস্যে ভরা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সাড়ে তিন বছর ওরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। যারা গণহত্যা চালিয়েছে ও তাদের সহযোগিতা করেছে তাদের বিচারের জন্য সে সময় একটা আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং দালাল বা সহযোগী হিসেবে একজনকেও সাজা দেয়নি। ১৯৯১-৯৫ সালের পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দল হিসেবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে তখন আজ যাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে সেই জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অংশীদার। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারে অধিষ্ঠিত থাকাকালে একদিনের জন্যও তারা এ ইস্যু নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। এক কথায় বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো আওয়াজ তোলেনি। এখন হঠাৎ করে এ ইস্যু ওঠানোর রহস্য কি?”
আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্র
একটি কথা এখন মুখে মুখে চাউর হয়েছে যে আওয়ামী লীগ এবং গণতন্ত্র এক সাথে যায় না। সেই বিষয়টি লেখক তুলে ধরেছেন বইটির ২৯১ পৃষ্ঠায়। ঘটনাটি মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০০৮। মওদুদ আহমদ লিখেছেন, “আওয়ামী লীগ বিভাজনের রাজনীতির আরেক পর্যায়ের সূচনা ঘটালো। দলের প্রেসিডিয়ামের এক বৈঠকে তারা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা খালেদা জিয়া ঘোষিত জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যোগ দেবে না এবং আমাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির সুযোগ নিয়ে সরকারকে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যেতেই সহায়তা করবে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, আওয়ামী লীগ কখনোই সত্যিকারের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং উচ্চ গুণসম্পন্ন কোনো নির্বাচনে তারা উৎসাহিত নয়। এখানে নীতিগত বিষয়টি একেবারেই মুখ্য নয়।”
এর পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। বইয়ের ২৯০ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, “সকল নিষেধাজ্ঞা ভেঙে সংবাদপত্রগুলো গতকাল আদালতে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য প্রধান শিরোনামে প্রকাশ করেছে। সেখানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই বক্তব্যের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী এবং দলের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীদের মানসিকতা চাঙ্গা করে তুলতে তা বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।
জাতীয় স্বার্থ ও আওয়ামী লীগ
আমার মনে হয়েছে যে, বিএনপির কিছু কিছু নেতা মওদুদ সাহেবের বইটি ভালো করে পড়েননি। সেটা হতেই পারে। কারণ, ৩৯১ পৃষ্ঠার বই পড়তে সময় লাগে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এই বইয়ে মওদুদ আহমদ আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বইটির ৩০০ এবং ৩০৭ পৃষ্ঠায় গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা তার মুক্তির বিনিময়ে সরকারের সাথে কোন্ কোন্ শর্তের ভিত্তিতে সমঝোতা করেছিলেন তা কেই জানে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জাতীয় একটি স্বার্থকে বিলিয়ে দিতে আওয়ামী লীগ কখনোই দ্বিধাবোধ করে না। শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে প্যারোলে মুক্তি পেলেও আসলে তা ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তিনি খুব আমোদের সাথেই ছুটি উপভোগ করছেন। কানাডাতে গিয়ে তিনি মেয়েকে দেখে এসেছেন। তার ভাগ্নে, রেহানার ছেলের বিয়ে খেতে গিয়েছেন ফিনল্যান্ড ও লন্ডনে। সেখানে থেকে ফিরে যাবেন আমেরিকায়। কী চমৎকার চিকিৎসা চলছে?’
অনেক তথ্য আছে এই বইয়ে, যেগুলো অনেকেরই অজানা ছিল। মওদুদ সাহেব সেগুলো টেনে বের করে এনেছেন। এ সম্পর্কে আগামী বৃহস্পতিবার আরো একটি কিস্তি প্রকাশ করার ইচ্ছা রয়েছে।
বিএনপি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য
আজ বিএনপি সম্পর্কে লেখকের একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করব। ১৭৬ পৃষ্ঠায় মওদুদ আহমদ লিখছেন ‘১৯৯১-৯৬ সালের তুলনায় বিএনপি সরকারের রাজনৈতিক অবদান ২০০১-২০০৬ সালে ছিল নিঃসন্দেহে অনেক কম। এরপর আমরা ক্ষমতায় গেলে বিএনপির সাফল্য হয়তো হবে আরো কম- কারণ দলটির শাসন কৌশলে উন্নতির কেনো স্পর্শ লাগেনি। বিএনপির রাজনীতির রক্তধারায় আত্মোপলব্ধি এবং আত্মসংশোধন শব্দ দুটির কোনো অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতার দাপট, অর্থলোলুপতা, বিলাসবহুল জীবনযাপন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং দুর্নীতির মাত্রা বোধহয় একই পর্যায়ে থেকে যাবে। আওয়ামী লীগের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। এরপর যখনই তারা আবার ক্ষমতায় আসবে সেই শাসনকাল হবে আরো নিকৃষ্ট।
বিশ্ব পর্যায়ে বিএনপির বন্ধুহীন হয়ে পড়া এবং রাজনীতিতে প্রান্তিক অবস্থায় চলে আসার পেছনে মূল কারণ হলো দুটি। সেগুলো হলো- (১) জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গভীর সখ্যতার কারণে বিএনপিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এমন ইসলামী উগ্রবাদী শক্তির সহযোদ্ধা হিসেবে যাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয় (২) তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে থাকা লোকজনের দুর্নীতি। বিএনপি যদি এ দুয়ের গ্লানি কাটিয়ে ভারসাম্যময় মধ্যপন্থী গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে পারবে না এবং কোনো রকমে আসতে সক্ষম হলেও বেশিদিন তা ধরে রাখতে পারবে না। অন্যদিকে জাতি যদি নারী নেত্রীদের ব্যক্তিগত রাজনীতির প্রতি মোহান্ধ থেকে যায় তা হবে জাতির জন্য সম-পরিমাণেই বিবাদময়’।
__._,_.___
No comments:
Post a Comment