Thursday, May 29, 2014

কবিতার ব্যক্তিকতা ও সর্বজনীনতা মাহমুদ দারবিশ অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ

কবিতার ব্যক্তিকতা ও সর্বজনীনতা
মাহমুদ দারবিশ
অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
মাহমুদ দারবিশ এর জন্ম ১৯৪১ সালে। পশ্চিম গ্যালিলির বিরওয়া গ্রামে। ১৯৪৮ সালের জুনে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী তাঁর গ্রাম জবরদখল করে নেয়। তখন তাঁর পরিবার গিয়ে আশ্রয় নেয় লেবাননে। বছরখানেক পরে তারা ফিরে এসে দেখেন তাদের গ্রাম ইসরায়েলিরা নিশ্চিহ্ন করে নতুন বসতি স্থাপন করেছে। আল-বিরওয়াকে আক্ষরিক অর্থেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। তখন তারা ইসরাইল-অধিকৃত দির আল-আসাদ-এ বসতি স্থাপন করেন, সেখানেই বেড়ে ওঠেন। মাতৃভাষা আরবী ছাড়াও তিনি হিব্রু ভাষাতেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। ১৯৬০ সালে হাইস্কুলের শিক্ষা শেষ করে তিনি হাইফাতে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তার কবিতা, অন্যান্য লেখা এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার কারণে তাকে অনেকবার ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের জেল এবং গৃহবন্দিত্ব ভোগ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ইসরায়েল ত্যাগ করেন। দারবিশ ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করতে যান। সেখানকার মস্কো ইউনিভার্সিটিতে এক বছর পড়ার পর চলে যান প্রথমে মিসর, পরে লেবাননে। ১৯৭৩ সালে তিনি ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থায় (পিএলও) যোগদান করেন। ইসরায়েলি সরকার তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাকে পিএলও-র প্যালেস্টিনিয়ান রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৭ সালে তিনি পিএলও-ও কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে ‘ফিলিস্তিনী জনগণের স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রণয়ন করেন। ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে তিনি পিএলও থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি ১৯৯৫ সালে আম্মানে এবং ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনের কর্তিত অংশ পশ্চিম তীরে চলে যান। তিনি রামাল্লা থেকে আল-কারমিল পুনঃপ্রকাশ করেন, এই ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি তিনি বৈরুত ও প্যারিস থেকে বের করতেন।
মাহমুদ দারবিশ কবিতা লিখছেন তাঁর কৈশোর কাল থেকে। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (উইংলেস বার্ডস) প্রকাশিত হয় উনিশ বছর বয়সে। তার গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশের অধিক। ৩৫টিরও বেশি ভাষায় তার রচনা অনূদিত হয়েছে। তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো আফ্রো-এশিয়ান রাইটার্স ইউনিয়নের ‘লোটাস প্রাইজ’, সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘লেনিন পিস প্রাইজ’, ফ্রান্সের ‘নাইট অফ দি অর্ডার আর্টস এন্ড লেটার্স,’ ইত্যাদি।
তিনি দুইবার বিয়ে করেন। কিন্তু কোনো বিয়েই স্থায়ী হয়নি। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
দারবিশ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ৯ আগস্ট আমেরিকার টেক্সাসের হাউসটনে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর কাব্যসমগ্র দিওয়ান পড়লে যে-কেউ সঙ্গে-সঙ্গেই প্রগাঢ় প্রেমে আচ্ছন্ন হবেন, যা তাঁর মূলভাব। কখনও কখনও এটা নারীর প্রতি প্রেম, হোক সে নামী বা বেনামী, বাস্তব বা কল্পিত, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে জন্মভূমি ফিলিস্তিনের প্রতি প্রেম, যদিও প্রায়ই তিনি এটাকে উপমায়িত করেন দয়িতা নারীর সঙ্গে। দারবিশের কবিতার মধ্যে বাস করে ফিলিস্তিন, যা তার বেশিরভাগ কবিতাকে জীবন্ত করে তোলে, কিন্তু একইসঙ্গে, কবিতা তার স্বদেশও বটে, এর মধ্যেই তিনি বাস্তব ও স্মৃতির ফিলিস্তিনকে প্রাণবান করেন তার প্রত্যেক তাৎপর্যময় অনুপুঙ্খ সমেত।
একজন শিশুর ভিটে হারানো এবং তারপর ইসরায়েলের অধীন নিজভূমে আগন্তুকের মতো বেড়ে ওঠার আঘাত ও যন্ত্রণা তার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, তার ব্যক্তিত্বের ওপর এর প্রভাব ছিল খুবই গভীর; তার সকল কবিতা এবং অন্যান্য লেখায় এই ক্ষত প্রতিফলিত হয়েছে। ইসরায়েলে থাকতে তিনি স্বদেশী ফিলিস্তিনীদের ক্ষতি এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সকল অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ লড়াই নিয়ে কবিতা লিখতেন। অবশ্য ইসরায়েল ত্যাগ করার পর, আরববিশ্বে বসবাস করার সময়, তিনি আরব শাসকদের অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং ফিলিস্তিনী স্বার্থের প্রশ্নে তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তার মোহমুক্তি ঘটে।
একমাত্র ফিলিস্তিনই তার বাসভূমিÑ তার এই বিশ্বাস আরও শক্ত হয়, তিনি অনুধাবন করেন যে, সেটাই তার একমাত্র বাসভূমি যা তার চিরকাল ছিল এবং থাকবে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও আদর্শবোধের ফিলিস্তিনের মৃত্যু ঘটে। ফিলিস্তিনের বিশাল অংশ ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলে রূপান্তরিত হয়, সেটা এখনও সেভাবেই থেকে গেছে। অন্য অংশগুলোর ইতিহাস বড্ড গোলমেলে : কিছু যুক্ত হয়েছিল পশ্চিম তীর নামে জর্দানের সঙ্গে, গাজা উপত্যকা শাসন করছিল মিসর। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল সেগুলোও দখল করে নেয় এবং নতুন নতুন বসতি স্থাপন করতে থাকে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পর কিছু অংশ চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পিত হয় বটে, কিন্তু ইসরায়েল বাস্তবে সেগুলোকেও আবার জবরদখলে নিয়ে বসতি স্থাপন করে। তিনি তার জনগণের জন্য যে স্বাধীন বাসভূমির আকাক্সক্ষা করেছিলেন সবকিছুই তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তার আদর্শ বাসভূমির জন্যে লড়াই অবিরামভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে তার কবিতায়, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও ফিলিস্তিন বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা এবং ফিলিস্তিনীদের ওপর আরোপিত দুর্ভোগ ও অবিচারের প্রতি বিশ্ববাসীর উদাসীনতার কারণে হতাশ ফিলিস্তিনী ও আরব জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে তিনি জাতীয় প্রতীকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন।
মাহমুদ দারবিশের ক্ষেত্রে স্বদেশরূপী কবিতার মানে কেবল এই নয় যে, একদা স্বদেশে ছিলেন এই আবেগগত পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকবেন বলে তিনি কবিতা লেখেন। তার কাছে কবিতা হচ্ছে একটা সেতুবন্ধ যার মাধ্যমে তিনি প্রকৃত স্বদেশ ফিরে পান এবং নিজেকে ও পাঠকসমাজকে অঙ্গীকারবদ্ধ করেন ফিলিস্তিনকে পুনর্জীবনদান এবং ফিলিস্তিনীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সকল অবিচার নিরসনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন যে, ইসরায়েলকে একটা জাতি এবং রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি এবং শান্তিতে বসবাস করতে দেয়া উচিত, কিন্তু তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে, ফিলিস্তিনও একটা জাতি এবং রাষ্ট্র, তাকেও একইভাবে সমান স্বীকৃতি এবং শান্তিতে বসবাস করার অধিকার দিতে হবে।
২০০০ সালের মার্চ মাসে ফ্রান্সে ফরাসী ভাষায় মাহমুদ দারবিশের একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনের ভূমিকা তিনি নিজেই লেখেন। পরে এই ভূমিকাটি বিভিন্ন কাগজে প্রবন্ধ হিসেবে ছাপা হয়। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি সেই ভূমিকার ভাষান্তর। এই প্রবন্ধে সাধারণভাবে কবিতা, তার বিশ্বজনীন আবেদন এবং কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে দারবিশের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। Ñঅনুবাদক

কবিদের লেখা ভূমিকা আমি ক্কচিৎ পড়ি, আর যদি পড়িই তাহলে সেটা প্রধানত এজন্যে যে কবি যা বলেন এবং কবিতায় যা পাওয়া যায় তার মধ্যেকার চমৎকার বৈষম্যকে আমি উপভোগ করতে চাই।
কিন্তু তাহলে, উদাহরণ হিসেবে ধরুন, এই কবিতা সংকলন উপস্থাপন করার জন্যে আমার প্রতি ক্রমাগত অনুরোধের প্রতি আজ আমার প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত? বিশেষত যেহেতু আমার কাছে প্রত্যেকটা অ্যান্থলজিই প্রবঞ্চনা বলে মনে হয়, যদিও সংকলক তার বাছাইকৃত কবির সঙ্গে যতদূর সম্ভব খাপ খাওয়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, তিনি হয়ত পারেন সাহিত্যকর্মটির ছায়াকে পাশে রেখে তার আলোকোজ্জ্বল উৎসকে রক্ষা করতে, আলাদা করে নিতে পারেন একটা কবিতাকে তার কর্মকাঠামোর মধ্যে তার অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ঠিক রাখতে পারেন কেবল কবিতার পথে যাত্রার যে গাদ্যিক পথ সেটাকে, গুরুত্ব দিতে পারেন একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করে এমন সব প্রতীক, উপমা ও পরিবেশকে এবং এই অন্তর্মুখী প্রক্রিয়ার শেষে, একজন মধ্যমমানের কবিকে করে তোলেন ব্যতিক্রমী হিসেবে, বা অন্যভাবে...
একটা এ্যান্থলজি কেবল সন্দেহকেই বাড়িয়ে তোলে। একজন কবির বাছাইকৃত কবিতাসমগ্র দিয়ে কি তার পূর্ণ জগতকে সত্যিকারভাবে জানা সম্ভব? বিশেষ করে যখন তা করা হয় অনুবাদের সাহায্যে?
প্রত্যেক ভাষার রয়েছে নিজস্ব প্রতীকপদ্ধতি, নিজস্ব ভঙ্গি এবং গঠনপ্রক্রিয়া। অনুবাদক শব্দার্থের ফেরিওয়ালা নন, বরং তাদের মধ্যকার নবতর সম্পর্ক-জালের নির্মাতা। অর্থের হালকা অংশের চিত্রকরও নন তিনি, বরং তার ছায়া ও তার তাৎপর্যের সতর্ক পর্যবেক্ষকও তিনি।
সুতরাং কবিতার অনুবাদক নিজেকে স্থাপন করেন একজন সমান্তরাল কবির জায়গায়, তিনি মূল ভাষার উৎস থেকে স্বাধীন হয়ে যান এবং মূল কবি তার ভাষার মাধ্যমে কবিতাকে যে পরিণতি দান করেছেন অনুবাদের ভাষাও সেই একই পরিণতি ভোগ করে।
মূল লেখা থেকে স্বাধীনতা লাভের এই জায়গাটাতেই অনুবাদক সেই চমৎকার এবং অনিবার্য বিশ্বাসঘাতকতা করেন যা কবির ভাষাকে রক্ষা করে তার নিজ জাতীয়তার ভর থেকে, এবং একইসঙ্গে অনুবাদের ভাষায় লীন হয়ে যাওয়া থেকে। মূল লেখার বিশেষ মূলগত বিষয়গুলোর মতো সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যকে যথাসম্ভব সংরক্ষণ করতে বাধ্য অনূদিত কবিতা, যা উপস্থাপিত হয় ভিন্ন একটি ভাষার গঠন কাঠামো এবং তার নিজস্ব সূত্র প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে।
এটাই সেই দ্বৈততা যা অনূদিত কবিতার বিশেষ চমৎকারিত্ব তৈরি করে। সকল ভাষার সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যকার সংলাপন বা পার্থক্যের স্বাদই হোক, বা কাব্য-অভিজ্ঞতার বিশাল সমৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্য আবিষ্কারের তৃষ্ণাই হোক, এর থেকেই অনূদিত কবিতা প্রত্যেক ভাষার উন্নয়ন ঘটায়Ñ অন্য একটি ভাষার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে একটি ভাষা তার স্টাইল এবং গঠন কাঠামোকে পুনর্নবায়নের ক্ষমতা লাভ করে।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে একজন মৌলিক ও সৃজনশীল অনুবাদক নির্মাণ ও ধ্বংশ করার ক্ষমতা লাভ করছেন। অনূদিত কবিতা আর কেবল মূল লেখকের একক সম্পত্তি হয়ে থাকতে পারছে না, এর মালিকানা অনুবাদকের ওপরেও বর্তাচ্ছে, তিনিও সমান অধিকার নিয়ে এর কবি হয়ে উঠছেন। সেই প্রেক্ষিতে অনূদিত লেখাটি তার মূলের চেয়ে ভাল না খারাপ হলো সেটা কোনও বিবেচ্য বিষয় নয়।
তাহলে আমরা অনূদিত কবিতার ওপর আস্থা রাখব কী করে? যা উন্মোচিত হয় না, যা এগিয়ে চলে মুখোশের আড়ালে, সেইখানে থেমে এই আস্থা স্থপান করতে হবে। শব্দের পেছনে অস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে ছায়া তাকে ধরে রেখে, এবং সম্ভবত সেই দূরত্ব যা ক্ষণিকের জন্যে তার উপস্থিতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তারপর ঝাপসা হয়ে যায় তাকে ধরে রেখে।
অনুবাদে প্রণীত একটা এ্যান্থলজিকে আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব? মোটের ওপর, সেইরকম একটা এ্যান্থলজিকে যা সম্পাদনা করেছেন কবি স্বয়ং?
অন্য কথায়, প্রিয় পাঠক, কীভাবে আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন?
এই সংগ্রহ, যা একটা ব্যক্তিগত এ্যান্থলজি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা নয়। যেহেতু এটা সম্পূর্ণরূপে আমার এখতিয়ারাধীন ছিল, আমার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল, সেহেতু আমি এতে গত দুই দশকের রচনাকেই কেবল জায়গা দিয়েছি। তার কারণ খুব সরল। আমার রচনাসংগ্রহগুলোর প্রত্যেকটাই কোনও না কোনওভাবে ধারাবাহিকতাকে ভেঙ্গে দিতে চায়, আগেরটাকে নাকচ করে দেয় আমার নতুন অঙ্গীকারের সাহায্যে। আমি অপরিবর্তনীয়ভাবে অনুভব করি যে, ততক্ষণ পর্যন্ত যাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং প্রান্তবর্তী বলে মনে হয় তার উন্নয়ন ঘটানো এবং তাকে কেন্দ্রবর্তী করা দরকার।
এই প্রয়োজনীয়তা উদ্ভূত হচ্ছে সম্ভবত এই বাস্তবতা থেকে যে, আমার বসবাস নদীর ভেতর নয়, বরং তার তীরে, এবং সময় আমাকে বিজ্ঞতা শেখাচ্ছে, ইতিহাস যেমন শেখাচ্ছে বিপরীতার্থকতা। আমার বয়স যত বাড়ছে আমি ততই অস্তিত্বের জটিলতা এবং সমসাময়িক চাপ থেকে আমার ভাষাকে রক্ষা করার আকাক্সক্ষা সম্পর্কিত আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি।
জনগণের কাছে আমার ভাবমর্যাদা আমার উদ্বেগের চেয়ে প্রবল। আমাকে ‘ফিলিস্তিনের কবি’ অভিধা দেয়া হয়েছে, আমার অবস্থান স্থিরীকৃত হয়েছে আমার ভাষার ভেতর, আমাকে মিথ থেকে আমার বাস্তবতাকে রক্ষা করতে হয় এবং সবকিছুর প-িত হতে হয়, ইতিহাসের অংশ হিসেবে এবং এর মধ্য দিয়ে আমি যে পরিণতি লাভ করেছি তার সাক্ষী হিসেবে। এটাই কারণ যে, ভবিষ্যতের কাছে আমার অধিকার বর্তমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং একইসঙ্গে আমার অতীত অস্তিত্বের বৈধতাকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রামের দাবি জানায়। সেজন্যে আমার কবিতা পরিবর্তিত হয়ে যায় অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের সাক্ষ্যে।
আমি যখন লেখালেখি শুরু করি তখন আমি আমার ক্ষতি, আমার অনুভূতি, আমার অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতাকে বর্ণনা করেছিÑ অর্থাৎ একটা বিশেষ পরিবেশ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ‘আমি’ সম্পর্কে বলা আমার বাতিক হয়ে উঠেছিল। আমার অস্তিত্ব যে একটা সামষ্টিক অস্তিত্বকে নির্মাণ করে তার প্রতি আমি খুব কম মনোযোগই দিয়েছি। আমি চেয়েছিলাম আমাকে প্রকাশ করতে, স্বপ্ন দেখেছিলাম কেবল আমারই পরিবর্তনের।
ভূমি থেকে উচ্ছেদ, আমার ব্যক্তিগত কাহিনীর সঙ্গে জনতার কাহিনীর সংমিশ্রণের যে বাস্তবতা তার মুখোমুখি হয়ে আমি কী-ই বা করতে পারতাম? সেজন্যে পাঠকরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই আমার ব্যক্তিগত কণ্ঠে তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কণ্ঠ উচ্চারিত হতে শোনেন। কিন্তু আমি যখন বন্দী ছিলাম, তখন আমি আমার মায়ের হাতের কফি আর রুটির স্মৃতি তর্পণ করে গান গাইতাম, আমি আমার পারিবারিক পরিবেশের বাইরের যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর চেষ্টা করতাম না। আর যখন আমি নির্বাসন, আমার অস্তিত্বের ভোগান্তি এবং স্বাধীনতার জন্য আকুতির গান গাইতাম তখন আমার ‘প্রতিরোধের কবিতা’ লেখার ইচ্ছে হয়নি, একজন আরব সমালোচক সেসময় যা বলেছিলেন; ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ বলা হয় যাকে তার পরাজয়ের পর আশা করতে থাকার মতো প্রচুর কাব্যিক উপশম পাঠকরা আমার লেখায় খুঁজে পাক এ কল্পনা আমি করিনি।
আমি যখন সেসব দিনগুলোর কথা আবার ভাবি, তখন কবিতার ছড়িয়ে পড়ার বিপুল ক্ষমতাকে আবার প্রত্যক্ষ করি, যদিও এটা না খোঁজে নির্জনতা, না আশ্রয় নেয় প্রচলিত ধারার, এবং এর কোনওটাই তার সৌন্দর্য বিচারের বৈধ মাপকাঠি নয়। কিন্তু আমি যখন ওইসব লোকের কথা ভাবি যারা ‘রাজনৈতিক কবিতা’র দুর্নাম করে বেড়ায়, তখন আমার এটা জানা থাকে যে, তার চেয়েও খারাপ জিনিসের অস্তিত্ব আছে, সেটা হলো রাজনৈতিকতার প্রতি অতি-অবজ্ঞা, বাস্তবতা ও ইতিহাসের প্রশ্নগুলোর প্রতি কান না দেয়া, এবং আশাবাদের উদ্যোগে দৃঢ়ভাবে অংশ নিতে অস্বীকার করা।
সেজন্যে এই এ্যান্থলজি পাঠক বা রচয়িতার সঙ্গে প্রতারণা করতে চায় না বলে আমার বর্তমান কাব্য-অভিজ্ঞতার পক্ষাবলম্বন করে আমার প্রারম্ভকালকে পরিত্যাগ করবে না। সমানভাবে, আমি ঠিক নির্ধারণ করতে পারি না ধারাবাহিকতার সঙ্গে সেই আপাতঃবিচ্ছেদ ঘটে গেছে কোন্ মুহূর্তটিতে। আমি একটা অভিযোজন প্রক্রিয়ার অনুসরণ করেছি যার মধ্যে পরস্পর মিশ্রিত হয়ে গেছে বিভিন্ন পর্যায়, প্রত্যেকটার মধ্যে রয়ে গেছে আসন্ন পরিবর্তনের বীজ।
আমার কবিতায় আমি গুণগত অতিক্রমণ প্রত্যাশা করেছি। কিন্তু ক্রমসঞ্চয়ের ফলকে কি অস্বীকার করা সম্ভব? আমি জানি না। তবে, উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার ‘নির্বাসনের কবিতা’র পর্বকে তার আগের পর্বের বিস্তার হিসেবে দেখি। যেন আমার ব্যক্তিক-সামষ্টিক কণ্ঠ বিস্তৃত হয়ে অন্য সীমানায় প্রবেশ করে, যেটা আরও বড় এবং সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময়। যেন আমার কণ্ঠ আরও ঋদ্ধ হয়ে তার কবিতার ধারণাকে ফিরিয়ে এনে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দেয় এবং সর্বজনীন কাব্য-অভিজ্ঞতার আরও নিকটবর্তী করে। দূরত্বের ধৈর্য, কোনও এক প্রান্ত থেকে দর্শন, বীরোচিত কবিতার দ্বারা ভাষার ওপর আরোপিত ভরকে হালকা করার সুযোগ এনে দেয় কবিতার জন্যে, তখন সে তার নিজের দিকে দৃষ্টি দিতে পারে আরও নির্দোষভাবে, আরও প্রশান্ত হয়ে, এবং হীনাবস্থা ও নিয়মাক্রান্ত একটা স্থানের সকল উপাদান ও স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে।
আমি সময়ের পরিবর্তন, সর্বজনীন কাব্যভাষার স্বরপ্রবাহের প্রতি খুব সংবেদনশীল। আমি অবিশ্রান্ত চেষ্টা করি কবিতার কাছে পৌঁছতে তার ব্যক্তিগত জীবন ও ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে, এবং তার থেকে মুক্তিলাভের মাধ্যমে। আমি অবিশ্রান্ত চেষ্টা করি কবিতাকে তার পৌরাণিক পূর্বপুরুষের অধিকতর কাছে পৌঁছে দিতে, কিন্তু এ চেষ্টাও করি যাতে তার অভ্যন্তরীণ উপাদান থেকে একটা সমসাময়িক পুরাণও তৈরি হয়। কিন্তু কবির অভ্যন্তর থেকে বাহির এবং তারপর বাহির থেকে অভ্যন্তরে ভ্রমণকে উপলব্ধি করা যাবে কীভাবে? কীভাবেই বা একজনের ‘অহং’-এর ভেতর নিমজ্জিত হওয়া থেকে বাঁচা এবং জনগণের মুখপাত্র ও প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হয়ে লুপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে?
কবিতার মূল সন্দেহাতীতভাবে একটাই : মানুষের আত্মপরিচয়, তার অতীতের নির্বাসন থেকে বর্তমানের নির্বাসনে স্থানান্তরিত হওয়া। কবিতা জন্মলাভ করে জীবনের প্রথম বিস্ময়গুলো থেকে, জায়মান মানবতা অস্তিত্বের প্রথম রহস্যগুলো অবলোকন করে বিস্মিত হয়। এইভাবে, বিশ্বজনীনতা হচ্ছে, একেবারে শুরু থেকেই, স্থানিক।
প্রত্যেকেই যা পরিগ্রহ করেÑ ব্যক্তিকতা ও বিশ্বজনীনতার মধ্যে এই ভ্রমণ, যা নির্মিত হয় ভাষা, স্থান এবং বিকাশ-পর্যায়ের বহুত্ব দ্বারা, এতে মানবজাতির কাব্য-অভিজ্ঞতা একীভূত হয় এবং ‘রাজধানী’র আধিপত্য’ এবং ‘আঞ্চলিকতা’র আনুগত্য থেকে মুক্ত একটা সর্বজনীনতা অর্জন করে।
তবে মনে হয় কম্পাসের ক্রমবিন্দুগুলো লেবেল ছাড়া বোধগম্য হয় না।
তাহলে, এর অর্থ কী দাঁড়াবে যদি আমি উদাহরণস্বরূপ বলি যে, আমার কবিতা আসে ‘দক্ষিণ’ থেকে, যে এটা উদ্ভূত হয় একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে যেখানে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি?
এর মানে কী হবে যদি আমি বলি যে, আমার কবিতার জন্ম হয় এমন একটা দেশ থেকে যেখানে সময় এবং স্থানের মধ্যকার সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেছে, এমন একটা পিতৃভূমি থেকে যার সন্তানরা ভূতে রূপান্তরিত হয়েছে?
এটা সেই পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয় যার দ্বারা গতিমান আরবীয় আধুনিকতা এবং এখনও জন্ম হয়নি এমন এক নগরীর জন্য লুপ্ত হয়ে যাওয়া তাঁবুর বাসিন্দাদের সমস্যাগুলোকে বিবৃত করা যায়।
তার গোপন অংশ কবিতার লক্ষ্য নয়, বরং কবিতার গতি এবং যে চিন্তা তাকে গতিমান করে তার মধ্যকার চাপ এবং তার গাদ্যিক ও ছান্দিক অবস্থার টানাপোড়েন থেকে তার জন্ম। আর তার লুক্কায়িত অংশ কাব্যভাষা এবং বাস্তবতার মধ্যকার দ্বন্দ্বের একটা রূপ, যার বর্ণনা দিতে কবিতা আদৌ উৎসাহিত নয়, সেটা তার উৎকর্ষের খাতিরে। এই অস্পষ্ট অংশটুকই পাঠকের সামনে একটা জায়গা খুলে ধরে যেখানে পাঠক সুনির্দিষ্ট বার্তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে পড়তে এবং তার ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন, এবং এইভাবে কবিতাটিকে দ্বিতীয় জীবন দান করতে পারেন।
অবশ্য যে পাঠক আমাকে নবায়ন করেন এবং যাকে আমি নবায়ন করি, তার সঙ্গে আমার কবিতার বিচ্ছেদ প্রতিরোধ করে যে জিনিসটি তা স্পষ্টতা বা অস্পষ্টতা কোনটাই নয়। আমার কাব্য-অভিজ্ঞতার একটা কূটাভাস এই যে, প্রত্যেকবার আমি আমার স্টাইল এবং উপস্থাপন কৌশলকে এগিয়ে নিয়েছি, আমি আমার পাঠককে আরও নবায়নের জন্যে প্রস্তুত করে নিয়েছি, এবং লক্ষ্য করেছি যে আমাদের স্ব-স্ব কাব্য-রুচি আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এর ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে সম্ভবত এই বাস্তবতার মধ্যে যে, আমার কাব্য-প্রকল্পনা সবসময় উদ্ভূত হয়েছে আরবী কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, তার স্বরপ্রবাহ এবং সৌন্দর্যতাত্ত্বিক নিয়মের ধারাবাহিকতায়।
প্রত্যেক কবির রয়েছে তার নিজস্ব অভ্যাস। আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা তাদের কবিতা দুইবার লেখেন। প্রথমবার আমি আমাকে ন্যস্ত করি আমার অবচেতন প্রাণনার ওপর; দ্বিতীয়বার আমি কাঠামো কৌশলের অনুজ্ঞা সম্পর্কে আমার নিজ ধারণাকে অধিকতর গুরুত্ব দেই। আর এটা ক্কচিৎভাবেই প্রথমটির প্রতিফলন হয় না।
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment