Friday, May 30, 2014

বীজ নিয়ে দুর্ভোগ চাষীদের, পানি সঙ্কট ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ সোনালী আঁশের সুখদুঃখ ৩

বীজ নিয়ে দুর্ভোগ চাষীদের, পানি সঙ্কট ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’
সোনালী আঁশের সুখদুঃখ ৩
কাওসার রহমান ॥ বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ হলেও এ দেশের পাট চাষ আমদানিকৃত বীজের ওপর নির্ভরশীল। কোন প্রকার উৎসাহ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক বীজ উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের পাটবীজের বাজার ভারতীয় বীজ ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ ডলারের পাটবীজ আমদানি করছে ভারত থেকে। চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বীজ দেশে উৎপাদিত হওয়ায় দেশের পাট চাষ ভারতীয় বীজনির্ভর হয়ে পড়েছে। আর এতে প্রতিবছরই পাট বুনন মৌসুমে চাষীদের পাটবীজ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নমানের বীজের কারণে পাট চাষ নিয়ে চাষীদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। পাটবীজের পাশাপাশি পাট ভেজানোর জন্য পানি সঙ্কটও এখন কৃষকের কাছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ নির্ভরশীলতা কমাতে হলে চাহিদার অন্তত ৬০ ভাগ বীজ দেশে উৎপাদন করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) বীজ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের নিজের বীজ নিজে উৎপাদনের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে।
পাটচাষীরা জানান, উপজেলা পর্যায়ে বিএডিসির তালিকাভুক্ত ডিলাররা অনেকেই বীজ উত্তোলন করেন না। আবার কোথাও বীজ পাওয়া গেলেও তা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়। তাই চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় চোরাইপথে আসা ভারতীয় নিম্নমানের বীজ দিয়ে। এসব বীজের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক বীজ আমাদের দেশে চাষের উপযোগী নয়। ভারতীয় বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাও কম। প্রতি মৌসুমে নিরুপায় হয়ে প্রধান ফসল পাট চাষ করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
পাটচাষীদের অভিযোগ, প্রতিবছরই পাট বপন মৌসুমে ভেজাল বীজে গ্রামের হাট-বাজার সয়লাব হয়ে যায়। অত্যন্ত সুন্দর মোড়কে বিক্রি হওয়া ওই বীজ কিনে চাষীরা প্রতারিত হর। বীজ বপনের পর দেখা যায় অনেক কম চারা গজায়। আবার যে সকল গাছ জম্মে সেগুলোও একটু বড় হয়েই তাতে ফুল ধরে যায়। এতে চাষীরা দুর্ভোগে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর সদরের পাটচাষী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার প্রধান ফসল পাট। বাধ্য হয়েই পাটের আবাদ করতে হয়। ভারতীয় বীজ দিয়ে পাট চাষ করে আশাতীত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। পাট পরিপক্ব হওয়ার আগেই ফুল চলে আসে। এতে আঁশের মান ও উৎপাদন মারাত্মক হারে কমে যায়।
এ প্রসঙ্গে মুকসুদপুর উপজেলার পাটচাষী এবং জুট গ্রোয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘বিএডিসির পাটবীজ মানসম্পন্ন হলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। আবার পেতেও বিলম্ব হয়। ফলে চাষীদের পাটবীজ বপনের জন্য বাজারের সুদৃশ্য মোড়কের বীজের ওপর নির্ভর করতে হয়।’ চাহিদা অনুযায়ী দেশীয় পাটবীজ না পাওয়ায় চাষীরা ক্রমেই ভারতীয় বীজের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে তিনি জানান।
পাটের দেশ বাংলাদেশ। আগের দিনে চাষী তার প্রয়োজনীয় পাটবীজ নিজে উৎপাদন করত। সে বীজ ঘরে ঘরে যতœ করে রাখত এবং পাট চাষ করত। দেশ স্বাধীনের পর চোরাইপথে ভারত থেকে কিছু পরিমাণ পাট আসতে শুরু করে। যতই দিন যেতে থাকে ভারতীয় বীজ আসা বাড়তে থাকে। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের মধ্যে ভারতীয় পাটবীজের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। তবে আগে চোরাইপথে বীজ এলেও, বর্তমানে বৈধভাবে আমদানির মাধ্যমে দেশে পাটবীজ আসছে। চলতি বছর বীজের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে সাড়ে তিন হাজার টন পাটবীজ আমদানি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতীয় বীজ বোর্ড এ বীজ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। প্রায় ৫০০ ব্যবসায়ী সাড়ে ৩ হাজার টন পাটবীজ (তোষা-জেআরও ৫২৪ জাত) আমদানি করবেন বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে পাটবীজের চাহিদা ৫ থেকে ৬ হাজার টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বিএডিসি দেয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আর ২০ শতাংশ যোগান দেয় কৃষক নিজে। অবশিষ্ট ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বীজ ভারত থেকে আসে। অনেক সময়ই ভারত থেকে আমদানিকৃত বীজে মিশ্রণ থাকে। ফলে ভাল চারা গজায় না। ছোট পাটগাছেই ফুল হয়ে যায়। পাটের মানও ভাল হয় না। তাঁদের মতে, ভাল পাট উৎপাদনের জন্য ভাল বীজ প্রয়োজন। আর ভাল মানের বীজ পাটের ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিগত ২০০১-০২ সালের তুলনায় ২০০৫-০৬ সালে পাটের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.২৯ শতাংশ কমেছে। কিন্তু মোট উৎপাদন ৩.১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গড় ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ১২.৫০ শতাংশ। পাট চাষে বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত, আধুনিক প্রযুক্তি এবং উৎপাদন কলাকৌশলের ব্যবহারের ফলে এ বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। সময়োপযোগী ও প্রচলিত শস্যক্রমের সঙ্গে মানানসই আগাম বপনযোগ্য তোষা পাট জাত উদ্ভাবন করার ফলে দেশী ও তোষা পাট চাষের অনুপাত সত্তর দশকের ৭০:৩০- এর স্থলে বর্তমানে প্রায় ২০:৮০ অনুপাতে এসে দাঁড়িয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাট গবেষণার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪৩টি পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করেছে। এ সব উন্নত জাতই এখন কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ০৭২ এবং ০৯৯৭ জাত দুটি ভাল মানসম্পন্ন পাটবীজ। এগুলোর ফলনও ভাল হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর বীজ ব্যবসায়ীদের সাড়ে ৩ হাজার টন পাটবীজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর সরকার আমদানি করবে এক হাজার টন। বেনাপোল ও বুড়িমাড়ি বন্দর দিয়ে এ বীজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। ৩০ মার্চ পর্যন্ত বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১১শ’ টন এবং বুড়িমাড়ি দিয়ে ৭শ’ টন পাটবীজ আমদানি হয়েছে। এখনও বীজ আসা অব্যাহত আছে বলে দুটি বন্দরের কোয়ারেন্টাইন অফিস সূত্রে জানা যায়।
এবার প্রতিকেজি পাটবীজের আমদানি মূল্য এক ডলার ১০ সেন্ট থেকে এক ডলার ৫০ সেন্ট পর্যন্ত বলে এক আমদানিকারক জানান। অর্থাৎ এক টনের দাম ১১শ’ ডলার থেকে ১৫শ’ ডলার। ভারতের কৃষি কল্যাণের চক্র মার্কা, ন্যাশনাল সিড কর্পোরেশনের পাঞ্জা মার্কা, পাণ্ডে কৃষি ভাণ্ডারের রানী মার্কা, জয়সাল সিড কোম্পানির মহারানী মার্কা, জয় কিষান সিডের গরু মার্কা, কৃষি সেবায়নের বেটাবেটি মার্কাসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির পাটবীজ বাংলাদেশে আমদানি হয়ে থাকে। প্যাকেটগুলো সুন্দর বলে চাষীকে আকৃষ্ট করে। ফলে ভারতীয় বীজ বেশি বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি ভারতীয় পাটবীজ ১১০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে। বৃষ্টি নেই বলে বীজের চাহিদা কম। তবে অনেক চাষী সেচ দিয়ে বীজ বপন করছেন। বৃষ্টি হলে চাহিদা বেড়ে যাবে বলে বীজ ব্যবসায়ীরা জানান। ভারতে পাটবীজ উৎপাদিত হয় মহারাষ্ট্রে। সব কোম্পানির বীজের প্যাকেটে লেখা থাকে মহারাষ্ট্রে তৈরি জেআরও-৫২৪।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ড. এ কে এম মাকসুদুল আলম বলেন, দেশে পাট চাষের ধরন বদলে গেছে। আগে দেশী জাতের পাট শতকরা ৮০ এবং তোষা জাতের পাট শতকরা ২০ ভাগ চাষ হতো। এ জন্য দেশে তৈরি বীজে চাহিদা মিটত। এখন শতকরা ৮০ ভাগ তোষা এবং শতকরা ২০ ভাগ দেশী জাতের পাট চাষ হচ্ছে।
তিনি জানান, বছরে পাটবীজের চাহিদা ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টন। দেশী বীজ আমদানি করতে হয় না। তবে তোষা জাতের বীজের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়।
ড. এ কে এম মাকসুদুল আলম বলেন, ‘কৃষক তার প্রয়োজনীয় বীজ নিজেই উৎপাদন করতে পারে। এ জন্য দরকার উৎসাহ ও প্রণোদনা। বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে শাকসবজির সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে পাটবীজ উৎপাদন করা সম্ভব। আগস্ট মাসের দিকে বীজের চাষ করলে জানুয়ারি মাসে বীজ ঘরে তোলা যায়। এ জন্য চাষীদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। এভাবে দেশে পাটবীজের ঘাটতি মেটানো যেতে পারে।’
কৃষি বিভাগ জানায়, দেশে প্রতিবছর সাত লাখ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়ে থাকে। এ জন্য ৫ হাজার টন পাটবীজের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া সারাবছর শাক হিসেবে আবাদের জন্য ৫০০ টন পাটবীজের দরকার হয়। এর মধ্যে ১০ শতাংশ জমিতে দেশী পাটের এবং ৯০ শতাংশ জমিতে তোষা পাটের আবাদ হয়। অন্যদিকে, ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে মেস্তার আবাদ হয়। সে হিসাবে তোষা পাটের প্রায় ৪০০০-৪২০০ টন, দেশী পাটের ৮০০-৯০০ টন এবং মেস্তার ২৫০-৩০০ টন বীজের প্রয়োজন হয়।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮০ লাখ বেল পাট। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত লাখ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিল ৮০ লাখ বেল। এ কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর পাটবীজের চাহিদা বেশি।
এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মহাপরিচালক (বীজ উইং) আনোয়ার ফারুক জানান, দেশে পাটবীজের চাহিদা রয়েছে পাঁচ হাজার টন। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে যোগান হয় মাত্র দেড় হাজার টনের। এ বছর ভারত থেকে আমদানি করা হবে সাড়ে তিন হাজার টন। বিএডিসি এক হাজার ৪২০ টন পাটবীজ কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করবে। এ ছাড়া বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক হাজার টন পাটবীজ কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করবে।
কৃষকদের অভিযোগ, দেশী বীজ সময়মতো পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে সরকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসিও সময়মতো চাষীদের হাতে বীজ তুলে দিতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর অঞ্চলের পাটচাষী এবং জুট গ্রোয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন বলেন, ‘বিএডিসি এপ্রিলে বীজ দেয়। তখন পাট চারা ৫-৬ ইঞ্চি বড় হয়ে যায়।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘বিএডিসির ডিলাররা ভারতীয় পাটবীজ বিক্রিতে বেশি আগ্রহী। কারণ ভারতের পাটবীজে বেশি লাভ।’
বিএডিসির পরিচালক কৃষিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ বছর মার্চেই পাটবীজ দিয়ে দেয়া হয়েছে। এবার ৯০০ টন তোষা পাটবীজ দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, শাক হিসেবে দেশী পাটবীজের চাহিদা বাড়ছে। ইতোমধ্যে এ চাহিদা ৮০০ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন এ চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু ভর্তুকি ও মুনাফা কম হওয়ার কারণে পাটচাষীরা বীজ উৎপাদনে আগ্রহী হয় না। ভর্তুকি না দিলে কৃষদের মধ্যে পাটবীজ উৎপাদনে আগ্রহী তৈরি হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাল মানের পাট উৎপাদনের জন্য মানসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল বীজের প্রয়োজন। আর এ বীজ পেতে হলে আমদানির পরিবর্তে দেশে চাহিদার সম্পূর্ণ পাটবীজ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু বীজ উৎপাদন একটি ঝামেলার কাজ। ফলে কৃষক পাটবীজ উৎপাদন করতে চায় না। তার ওপর তারা কখনই রবি মৌসুমে ধান চাষ বাদ দিয়ে পাটবীজ চাষ করবে না। আবার একরে পাটবীজ পাওয়া যায় ২০০ থেকে ৩০০ কেজি। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পাটবীজ করার মতো এত জমিও বাংলাদেশে নেই। ভারতের মহারাষ্ট্রে শুধু পাটবীজ উৎপাদন করা হয়। তাদের প্রচুর জমি আছে সেটা তারা পাটবীজ উৎপাদনের জন্য কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে মুকসুদপুর উপজেলা পাটচাষী সংগঠন ও জুট গ্রোয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওবায়দুর রহমান বলেন, খরচ বেশি হওয়ার কারণে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। পাটবীজ উৎপাদনে কৃষকরা তখনই উদ্বুদ্ধ হবে, যখন বেশি মুনাফা পাবে। এ জন্য ভর্তুকির পাশাপাশি কৃষকদের উৎপাদিত পাটবীজ সরকার কর্তৃক কিনে নেয়ার গ্যারান্টি থাকতে হবে।
উৎপাদিত বীজের খরচও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক কেজি পাটবীজ উৎপাদন করতে খরচ পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আর সরকার সেটা ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করে ১২০ টাকায়। এ মূল্যে কৃষক কখনই তার উৎপাদিত পাটবীজ বাজারে বিক্রি করতে পারবে না। তাই কৃষক যাতে নিজের বীজ নিজে উৎপাদনে উৎসাহিত হয় সে জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে প্রণোদনা দিতে হবে বীজ উৎপাদনের জন্য। দেশে বীজ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লে শুধু পাটের উৎপাদনই বাড়বে না, বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।
এ প্রসঙ্গে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম বলেন, নানা কারণে দিন দিন পাটচাষীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ জন্য কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে পাটচাষীদের এ খাতে ফিরিয়ে আনতে তিনি প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ‘পাটের শাক ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। সবজি হিসেবে পাট চাষ বাড়াতে পারলে চাষীরা লাভবান হবে। এ জন্য কৃষককে নাবি পাটবীজ দিতে হবে। কৃষক নাবি বীজ দিয়ে পাট চাষ করে শাক হিসেবে বিক্রি করবে। আবার সেই পাট থেকে কিছু বীজও উৎপাদন করতে পারবে। এতে পাটবীজ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। অন্যান্য সবজির সঙ্গেও বীজের জন্য পাট আবাদ করা যেতে পারে। এটা করা গেলে দেশে পাটবীজের সঙ্কট হবে না।’
দেশে পাটবীজের অভাব দূরীকরণে বিজেআরআই পাটবীজ উৎপাদনের জন্য ‘নাবী পাটবীজ উৎপাদন’ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। নাবি পদ্ধতিতে মাত্র ৩-৪ মাসে দ্বিগুণ (প্রায় ৭০০ কেজি/হে.) ফলন পাওয়া যায়। কৃষক পর্যায়ে এ প্রযুক্তি খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের ঘাটতি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ‘নিজের বীজ নিজে করি’-এই স্লোগান নিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষীদের পাটবীজ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রত্যেক পাটচাষী যাতে অন্তত এক শতাংশ জমিতে পাটবীজ উৎপাদন করে সরকারকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পাটবিশেষজ্ঞ ড. আবুল কাশেম বলেন, বিএডিসিকে দেশের চাহিদার অন্তত ৫০ ভাগ বীজ উৎপাদন করা করতে হবে। সেই সঙ্গে নিজের বীজ নিজে করি এই স্লোগান নিয়ে প্রত্যেক পাটচাষীকে অন্তত এক শতাংশ জমিতে পাটবীজ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলে পাটবীজের সঙ্কট কেটে যাবে।
পাটবীজ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি পাটের চারা ধার করতে হয়নি। তখন তো অনেক বেশি জমিতে পাট চাষ হতো। এখন হয় না কেন? এ বিষয়টি আমাকে দেখতে হবে। আমরা চাষীদের উদ্বুদ্ধ করব নিজের বীজ নিজে করার জন্য। প্রত্যেক চাষী যদি বছরে পাঁচ কাঠা জমিতেও বীজ উৎপাদন করে তাহলে তো দেশে পাটবীজের অভাব হওয়ার কথা নয়। বিএডিসি যাতে আরও বেশি পরিমাণে বীজ উৎপাদন করতে পারে সে ব্যাপারে আমি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব।
মানসম্পন্ন পাটবীজ প্রসঙ্গে পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, ‘আমরা সময়মতো চাষীদের কাছে মানসম্পন্ন পাটবীজ পৌঁছে দেয়ার জন্য ভারত থেকে বীজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার এক হাজার টন পাট বীজ এবার আমরা আমদানি করে কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করব।’
পাটবীজের পাশাপাশি পাট চাষ ও পাট ভেজানোর জন্য পানি সঙ্কট এখন কৃষকের কাছে ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের নদী-নালা-খাল-বিল-ডোবা-নালা সব ভরাট হয়ে যাওয়ায় পাটকাটা মৌসুমে দেখা দেয় তীব্র পানি সঙ্কট। পানির অভাবে পাটের জমিতে কৃষক সেচও দিতে পারে না। পাট কাটার পর পাট ভেজানো নিয়েও প্রতিবছরই পানি সঙ্কটে পড়ছে চাষীরা। পানির অভাবে পাটের মান কমে যাচ্ছে। আবার দূর দূরান্তে নিয়ে পাট ভেজাতে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের উৎপাদন খরচও।
বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অল্প পানিতে বা চৌবাচ্চায় পাট ভেজানোর জন্য রিবন রেটিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু এ পদ্ধতিটিও সর্বপ্রচারিত নয়। ফলে দেশে পাটের মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। পানি সঙ্কট সমস্যার দ্রুত অবসান না করলে দেশে মানসম্পন্ন পাটের উৎপাদন দুরূহ হয়ে পড়বে। আর মানসম্পন্ন পাট পাওয়া না গেলে পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনাও হয়ে পড়বে দুষ্কর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেললাইন বা বড় রাস্তার পাশে ডোবা বা নালাগুলো পুনর্খনন করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার ভরাট হওয়া খালগুলোও পুনর্খনন করে সরকার পানির প্রবাহ বাড়াতে পারে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা ১০০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচীর আওতায় এ খালগুলো খনন করা উচিত। এতে শুধু পাটই নয়, সব ফসলই সেচ সুবিধা পাবে। সেই সঙ্গে নৌপরিবহনেও গতি আসবে।
এ প্রসঙ্গে পাট সচিব ফণী ভূষণ চৌধুরী বলেন, ‘তিনি বলেন, খাল-বিল সংস্কার করা গেলে নাব্য বাড়বে। এর সুফল শুধু পাটই পাবে না, অন্য ফসলও পাবে। সেচ সুবিধা বাড়বে। নৌপরিবহনে গতি আসবে। বন্যা সমস্যাও কমে যাবে।’
পানি সঙ্কট সমাধানে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল সংস্কার একটি কার্যকর পদক্ষেপ হবে বলে তিনি মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক খাল-নালা সংস্কারের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘আগে এই সমস্যা ছিল না। সম্প্রতি এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।’
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-05-31&ni=174505

No comments:

Post a Comment