মুক্তিযুদ্ধের ১১ সেক্টেরের ৬টিই এখন রাজাকারদের দখলে!!
আমরা এমন একটি জাতি, যেই জাতির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৪৪ বছর ধরে চলছে বিতর্ক। জ্বলন্ত সত্য ঢেকে দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চলছে নিরন্তর প্রচারণা। সত্য চাপা দিতে মিথ্যার কোরাস গাইছেন সবাই। মিথ্যার এই কোরাসের মধ্যে যারাই ভিন্নমত পোষন করছেন তারাই আখ্যায়িত হচ্ছেন রাজাকার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ সত্য কথা বললে, বা লিখলেই রাজাকার বা পাকিস্তানের দালাল। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
ltte/32778-2014-09-07-16-44- 03?q= 7d5f6b8b37434d664cc9f0c0111d2d 19031233123
আমরা এমন একটি জাতি, যেই জাতির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৪৪ বছর ধরে চলছে বিতর্ক। জ্বলন্ত সত্য ঢেকে দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চলছে নিরন্তর প্রচারণা। সত্য চাপা দিতে মিথ্যার কোরাস গাইছেন সবাই। মিথ্যার এই কোরাসের মধ্যে যারাই ভিন্নমত পোষন করছেন তারাই আখ্যায়িত হচ্ছেন রাজাকার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ সত্য কথা বললে, বা লিখলেই রাজাকার বা পাকিস্তানের দালাল। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
একের পর এক প্রশ্ন উথ্থাপিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের জাতীয় বীরদের নিয়ে। যে বীরেরা জীবন বাজি রেখে একাত্তরে জগৎসেরা পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের কাউকে কাউকে এখন বলা হচ্ছে রাজাকার, আবার কেউ আইএসআই'র চর আর কেউবা পাকিস্তানের দালাল অথবা নব্য রাজাকার।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে যে সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারা সবাই ছিলেন সামরিক বাহিনীর চৌকষ কর্মকর্তা ছিলেন। এদের অধীনেই সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকসহ বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুরসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকদের অনেকে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত ছিলেন, কেউ বা ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন, আবার অনেকে দেশপ্রেম বোধ থেকে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
সেক্টর কমান্ডার সবাই জাতীয় বীর হিসেবেই পরিচিত। স্বাধীনতার পরপরই তারা রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হন। এসব পুরষ্কারের চেয়েও তারা এদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে সম্মান ও ভালবাসা পেয়েছিলেন সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় পাওনা। আর শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করে একটি জাতিকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেয়া তাদের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। কিন্তু সেই বীরেরা দিনে দিনে কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছেন?
আসুন এবার দেখে নেই সেই ১১ সেক্টরের দায়িত্বে থাকা জাতীয় বীরদের বর্তমান পরিচিতি!!
মেজর এম এ জলিল ছিলেন বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার দেশপ্রেম নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তিনি জাসদ নামে ওই সময়ের মেধাবী তরুণদের নিয়ে দল গঠন করার পরই তাকে নানাভাবে স্বাধীনতা বিরোধী বলা হত। ১৯৮৪ সালে তাকে জাসদের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলেন। সাথে সাথেই এক শ্রেণীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। শুধু বক্তৃতা বিবৃতিতেই নয় তাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করে অনেক লেখালেখিও হয়েছে।
সিলেট অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি দিয়ে বিদেশ পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে তিনি চাকরিচ্যুত হন এবং দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। সাথে সাথেই এই মুক্তিযোদ্ধা এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে হয়ে গেলেন রাজাকার। তাকে রাজাকার বলে গালি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে অনেক বক্তৃতা হয়েছে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ১ নম্বর সেক্টর ও পরবর্তিতে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও রংপুর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সেরও প্রধান। তাকে শুধু রাজাকার নয়, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা ধারণ করে তিনি যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তানের চর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ঢুকে পড়েছিলেন, পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এমনই হাজারো কথা বলা হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে।
৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ এস ফোর্সেরও প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ কেউ স্বাধীনতা বিরোধী বললেও পরবর্তিতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি রাজাকার গালি থেকে বেঁচে যান।
সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও পুরো টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা ও পাবনা জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে এক বিশাল বেসামরিক সেক্টর গড়ে তুলেছিলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। একাত্তরে বীরত্বের কারণে আতঙ্কিত পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে উপযুক্ত পুরষ্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে সম্বোধন করতো। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে বলতেন বঙ্গবীর। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র বীরোত্তম খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ থেকে সরে গিয়ে যখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ করলেন তখনই তিনি হয়ে গেলেন নব্য রাজাকার।
এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ প্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। স্বাধীনতার পর তিনি পদোন্নতি পেয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল হন এবং বিমান বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান। শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর তিনি এর প্রতিবাদে বিমান বাহিনী প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বলেই এতদিন আমরা জেনে এসেছি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ এবং ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখার জন্য এ কে খন্দকার ১৯৭৩ সালে বীর উত্তম খেতাব এবং ২০১১ সালে এই সরকারের আগের আমলেই স্বাধীনতা পদকও পান।
এক সপ্তাহ আগেও তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশবাশীর কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বই প্রকাশের পরই তিনি পাকিস্তানের চর হয়ে গেছেন। সংসদেও তাকে গালাগালি করতে সবাই সরব। কেউ বলছেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পরিকল্পনা নিয়ে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঢুকে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী এই বীর যোদ্ধাকে কেউ বলছেন খন্দকার মুশতাকের দোসর। কেউ তার বই বাজেয়াপ্ত করতে বলছেন। বলছেন গ্রেফতার করতে। রাজাকার বলতেও কেউ দ্বিধা করছেন না। পত্র পত্রিকা আর টেলিভিশনের টক শো এখন তাকে নিয়েই ব্যস্ত।
জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় একাত্তরের এমন অনেক নায়ককেই আজ খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করছেন রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের দায়িত্ববান ব্যক্তিরা। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং দেখেছেন তারাও কিন্তু এদের উপস্থাপন করছেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে। এই বীরদের অনেকেই ইহজীবন ত্যাগ করেছেন। অনেকেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাজাকার গালি শুনছেন। এরাও একদিন বিদায় নেবেন। যারা আজ এদের রাজাকার বানাচ্ছেন তারাও একদিন বিদায় নেবেন। কিন্তু বেঁচে থাকবে দেশ। আসবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর জ্বল জ্বল হয়ে জ্বলবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক অধ্যায়। কিন্তু আগামী প্রজন্ম এই গৌরবজনক অধ্যায় সম্পর্কে কতটা জানতে পারবে? তারা কি জানবে সেক্টর কমান্ডারদের একটা বড় অংশ ছিল রাজাকার কিংবা পাকিস্তানের চর?
সর্বশেষ পাকিস্তানের চরের খাতায় নাম লেখানো এ কে খন্দকারকে যুক্ত করলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ১১ সেক্টরের মধ্যে ৬ টি সেক্টরই (সেক্টর- ৯: মেজর এম এ জলিল, সেক্টর- ৫: মীর শওকত আলী, সেক্টর- ১ এবং ১১: মেজর জিয়াউর রহমান, সেক্টর- ৩:কে এম শফিউল্লাহ, বেসামরিক সেক্টর: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি) এখন সেই কথিত পাকিস্তান পন্থী, রাজাকার অথবা আইএসআই'র চরদের দখলে। অবশ্য বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডর মরে বেঁচে গেছেন। আর কয়েকজন মরেও বাংলাদেশের ইজ্জতহীন রাজনীতির কবলে পরে ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যার্থ হয়েছেন।
সাময়িক সুবিধা কিংবা বাহ্বা কুড়ানোর জন্য আমরা হয় তো আজ জাতির এই বীরদের সমাজের সামনে হেয় করছি, গালাগালি করে পচাচ্ছি। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখছি আমাদের সন্তানদের কথা? কোন বীরদের সামনে রেখে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই। নইলে ইতিহাস যেমন আমাদের ক্ষমা করবে না তেমনই ক্ষমা করবে না আগামী প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম আমাদের মরণোত্তর বিচার করবে।
http://tazakhobor.com/bangla/একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে যে সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারা সবাই ছিলেন সামরিক বাহিনীর চৌকষ কর্মকর্তা ছিলেন। এদের অধীনেই সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকসহ বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুরসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকদের অনেকে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত ছিলেন, কেউ বা ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন, আবার অনেকে দেশপ্রেম বোধ থেকে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
সেক্টর কমান্ডার সবাই জাতীয় বীর হিসেবেই পরিচিত। স্বাধীনতার পরপরই তারা রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হন। এসব পুরষ্কারের চেয়েও তারা এদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে সম্মান ও ভালবাসা পেয়েছিলেন সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় পাওনা। আর শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করে একটি জাতিকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেয়া তাদের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। কিন্তু সেই বীরেরা দিনে দিনে কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছেন?
আসুন এবার দেখে নেই সেই ১১ সেক্টরের দায়িত্বে থাকা জাতীয় বীরদের বর্তমান পরিচিতি!!
মেজর এম এ জলিল ছিলেন বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার দেশপ্রেম নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তিনি জাসদ নামে ওই সময়ের মেধাবী তরুণদের নিয়ে দল গঠন করার পরই তাকে নানাভাবে স্বাধীনতা বিরোধী বলা হত। ১৯৮৪ সালে তাকে জাসদের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলেন। সাথে সাথেই এক শ্রেণীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। শুধু বক্তৃতা বিবৃতিতেই নয় তাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করে অনেক লেখালেখিও হয়েছে।
সিলেট অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি দিয়ে বিদেশ পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে তিনি চাকরিচ্যুত হন এবং দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। সাথে সাথেই এই মুক্তিযোদ্ধা এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে হয়ে গেলেন রাজাকার। তাকে রাজাকার বলে গালি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে অনেক বক্তৃতা হয়েছে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ১ নম্বর সেক্টর ও পরবর্তিতে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও রংপুর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সেরও প্রধান। তাকে শুধু রাজাকার নয়, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা ধারণ করে তিনি যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তানের চর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ঢুকে পড়েছিলেন, পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এমনই হাজারো কথা বলা হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে।
৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ এস ফোর্সেরও প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ কেউ স্বাধীনতা বিরোধী বললেও পরবর্তিতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি রাজাকার গালি থেকে বেঁচে যান।
সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও পুরো টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা ও পাবনা জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে এক বিশাল বেসামরিক সেক্টর গড়ে তুলেছিলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। একাত্তরে বীরত্বের কারণে আতঙ্কিত পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে উপযুক্ত পুরষ্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে সম্বোধন করতো। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে বলতেন বঙ্গবীর। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র বীরোত্তম খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ থেকে সরে গিয়ে যখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ করলেন তখনই তিনি হয়ে গেলেন নব্য রাজাকার।
এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ প্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। স্বাধীনতার পর তিনি পদোন্নতি পেয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল হন এবং বিমান বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান। শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর তিনি এর প্রতিবাদে বিমান বাহিনী প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বলেই এতদিন আমরা জেনে এসেছি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ এবং ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখার জন্য এ কে খন্দকার ১৯৭৩ সালে বীর উত্তম খেতাব এবং ২০১১ সালে এই সরকারের আগের আমলেই স্বাধীনতা পদকও পান।
এক সপ্তাহ আগেও তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশবাশীর কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বই প্রকাশের পরই তিনি পাকিস্তানের চর হয়ে গেছেন। সংসদেও তাকে গালাগালি করতে সবাই সরব। কেউ বলছেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পরিকল্পনা নিয়ে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঢুকে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী এই বীর যোদ্ধাকে কেউ বলছেন খন্দকার মুশতাকের দোসর। কেউ তার বই বাজেয়াপ্ত করতে বলছেন। বলছেন গ্রেফতার করতে। রাজাকার বলতেও কেউ দ্বিধা করছেন না। পত্র পত্রিকা আর টেলিভিশনের টক শো এখন তাকে নিয়েই ব্যস্ত।
জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় একাত্তরের এমন অনেক নায়ককেই আজ খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করছেন রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের দায়িত্ববান ব্যক্তিরা। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং দেখেছেন তারাও কিন্তু এদের উপস্থাপন করছেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে। এই বীরদের অনেকেই ইহজীবন ত্যাগ করেছেন। অনেকেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাজাকার গালি শুনছেন। এরাও একদিন বিদায় নেবেন। যারা আজ এদের রাজাকার বানাচ্ছেন তারাও একদিন বিদায় নেবেন। কিন্তু বেঁচে থাকবে দেশ। আসবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর জ্বল জ্বল হয়ে জ্বলবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক অধ্যায়। কিন্তু আগামী প্রজন্ম এই গৌরবজনক অধ্যায় সম্পর্কে কতটা জানতে পারবে? তারা কি জানবে সেক্টর কমান্ডারদের একটা বড় অংশ ছিল রাজাকার কিংবা পাকিস্তানের চর?
সর্বশেষ পাকিস্তানের চরের খাতায় নাম লেখানো এ কে খন্দকারকে যুক্ত করলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ১১ সেক্টরের মধ্যে ৬ টি সেক্টরই (সেক্টর- ৯: মেজর এম এ জলিল, সেক্টর- ৫: মীর শওকত আলী, সেক্টর- ১ এবং ১১: মেজর জিয়াউর রহমান, সেক্টর- ৩:কে এম শফিউল্লাহ, বেসামরিক সেক্টর: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি) এখন সেই কথিত পাকিস্তান পন্থী, রাজাকার অথবা আইএসআই'র চরদের দখলে। অবশ্য বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডর মরে বেঁচে গেছেন। আর কয়েকজন মরেও বাংলাদেশের ইজ্জতহীন রাজনীতির কবলে পরে ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যার্থ হয়েছেন।
সাময়িক সুবিধা কিংবা বাহ্বা কুড়ানোর জন্য আমরা হয় তো আজ জাতির এই বীরদের সমাজের সামনে হেয় করছি, গালাগালি করে পচাচ্ছি। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখছি আমাদের সন্তানদের কথা? কোন বীরদের সামনে রেখে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই। নইলে ইতিহাস যেমন আমাদের ক্ষমা করবে না তেমনই ক্ষমা করবে না আগামী প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম আমাদের মরণোত্তর বিচার করবে।
__._,_.___
No comments:
Post a Comment