Saturday, August 2, 2014

নেপথ্য ভাষন -অশোক দাশগুপ্ত ভালর খারাপ খারাপের ভাল

নেপথ্য ভাষন -অশোক দাশগুপ্ত
ভালর খারাপ খারাপের ভাল

Aajkaal: the leading bengali daily newspaper from Kolkata

সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে বি জে পি-র আসন অনেক বাড়বে, কে না জানতেন৷‌ বিহারেও ছবিটা একই রকম ছিল৷‌ চূড়াম্ত কোণঠাসা হয়েও এই বাস্তব মানতে চাননি নীতীশ কুমার৷‌ সন্দেহ নেই, বিহারকে অপেক্ষাকৃত সুশাসন দিয়েছেন নীতীশ৷‌ সেই ‘সুশাসন’-ই তাঁকে তরিয়ে দেবে, ভেবেছেন৷‌ বি জে পি-র সঙ্গে জোট ভাঙার পরে তেমন কোনও সম্ভাবনাই যে নেই, সব সমীক্ষা বলেছে৷‌ নীতীশ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন: এ-সবের কোনও দাম নেই, বি জে পি-র লম্ফঝম্পই সার, সামনে থাকবে তাঁর দল জে ডি ইউ-ই৷‌

অন্যদিকে লালুপ্রসাদ যাদব অঙ্ক কষেছেন, জোট ভাঙায় বি জে পি এবং জে ডি ইউ– দুই দলেরই ক্ষতি হবে৷‌ প্রচুর ভিড় টেনে ভেবেছেন, তাঁর সুদিন ফিরল বলে৷‌ কংগ্রেস একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিল, যাতে এই দুই শক্তিকে এক জোটে জড়ো করা যায়৷‌ কিন্তু বিহারে কংগ্রেসকে কে পাত্তা দেয়! ভোটে ৪০-এর মধ্যে ৩১ আসন তুলে নিয়ে গেল এন ডি এ, রামবিলাসের এল জে পি-র ৬ শতাংশ ভোট সাহায্য করল৷‌ এই চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে নীতীশ বুঝলেন, একলা চলে বি জে পি-কে ঠেকানো যাবে না, আগামী বিধানসভা ভোটে গৈরিক শক্তির জয় প্রায় অবধারিত৷‌ বুঝলেন লালুপ্রসাদও৷‌ চমকপ্রদ জয়ের আশা যখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল, তিনিও মানলেন, ‘শত্রু’ নীতীশের সঙ্গে হাত মেলাতেই হবে, যদি বি জে পি-র জয়রথ থামাতে হয়৷‌ উল্লেখযোগ্য, লালুপ্রসাদ যদি একটু উদার হয়ে রামবিলাস পাসোয়ানকে সঙ্গে রাখতে পারতেন, এত খারাপ ফল হত না৷‌ রামবিলাস এখন সরকারে৷‌ কিছু করার নেই৷‌

লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমারের শত্রুতার বয়স কুড়ি৷‌ ১৯৭৫-৭৭ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের ইন্দিরা-বিরোধী দুরম্ত আন্দোলনে দু’জন ছিলেন সহযোদ্ধা৷‌ সেই ঐতিহাসিক সময়ে যাঁরা কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়লেন, বিহারের দখল পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁরা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেলেন৷‌ ‘সুসময়ে’ কেউ কারও মুখদর্শন করতে চাননি৷‌ ‘দুঃসময়’ ঘটিয়ে দিল পুনর্মিলন৷‌ কংগ্রেসও সঙ্গে৷‌ বিধানসভার ১০ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে আসন ভাগ হল: ৪, ৪, ২ (কংগ্রেস)৷‌ এবারই সুফল কতটা পাওয়া যাবে, জানি না৷‌ কিন্তু লালু-নীতীশ একসঙ্গে থাকলে বিহারে বি জে পি-র স্বপ্ন সফল হবে বলে মনে হয় না৷‌

ব্যাপারটা শুধু বিহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়৷‌ প্রভাব পড়তে পারে গোটা ভারতে৷‌ তথাকথিত সুসময়ের ভুল দুঃসময়ে শুধরে নেওয়ার সুযোগ৷‌ কংগ্রেসের কথাই ভাবুন৷‌ হারবেন জানতেন, কিন্তু ৪৪-এ নেমে যেতে হবে, ভাবতে পারেননি কংগ্রেস নেতারা৷‌ দলের অভ্যম্তরীণ হিসেবে বলা হচ্ছিল, পরাজয় অনিবার্য, তবে ১০০ আসন আসবেই৷‌ অর্ধেকও এল না৷‌ বিরোধী দলনেতার পদও পাওয়া যাচ্ছে না৷‌ কংগ্রেস বুঝল, হিন্দি বলয়ে নিজেদের জোরেই জমি মজবুত করা এখন দিবাস্বপ্ন৷‌ রাহুল গান্ধীর তত্ত্ব খারিজ হয়ে গেল৷‌ মূল প্রতিপক্ষ বি জে পি-র বিরুদ্ধে বন্ধুত্ব বাড়াতেই হবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে, ঠেকে বুঝল কংগ্রেস৷‌

‘সুসময়’ কংগ্রেসের ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশি৷‌ ২০০৪ ও ২০০৯ ভোটে মোটামুটি সাফল্য পেয়ে সোনিয়ারা ভাবতে শুরু করেছিলেন, এরকমই চলবে৷‌ অধিকাংশ আঞ্চলিক দল কিছুতেই বি জে পি-র সঙ্গে যাবে না৷‌ মোদির বিধ্বংসী প্রচারও ২০০ আসন দিতে পারবে না বি জে পি-কে৷‌ একের পর এক বিধানসভা ভোটে ব্যর্থতা দেখেও, রাহুল গান্ধীকে সামনে রাখা হয়েছে৷‌ আজ দেখুন, কংগ্রেস নেতারা বলতে শুরু করেছেন, সোনিয়াকেই মূল দায়িত্ব নিয়ে চলতে হবে৷‌ মানে, রাহুল চলে না! কেউ চাইছেন, সোনিয়াকে সামনে রেখে যৌথ নেতৃত্ব৷‌ কেউ আওয়াজ তুলছেন, প্রিয়াঙ্কাকে আনতে হবে৷‌ অ্যান্টনির রিপোর্টে কার্যত সোনিয়ারও প্রচ্ছন্ন সমালোচনা৷‌ এই খারাপ সময়ে ভাল কিছু পাওয়ার চেষ্টা জারি৷‌

সুসময় হল সুসময়৷‌ কিন্তু তার গর্ভেই লুকিয়ে থাকে দুঃসময়ের শিশু৷‌ বাড়তে থাকে৷‌ ক্ষমতার সূত্রে দুর্নীতি আসে, বাড়ে, জড়িয়ে পড়ে দল ও সরকার৷‌ ৪৪-এ নেমে এলেও, কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তা নয়৷‌ উত্তরাখণ্ডে ৩ বিধানসভা কেন্দ্রেই বি জে পি-কে হারিয়ে, দুটি কেন্দ্র ছিনিয়ে নিয়ে কংগ্রেস এই আত্মবিশ্বাস পেতে পারে যে, মোদির আকাশছোঁয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না হলে, মোদি সরকার ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারালে, অম্তত ১১টি রাজ্যে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সুযোগ পাবে কংগ্রেসই৷‌ এজন্য সংগঠন গোছাতে হবে৷‌ বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব সামনে আনতে হবে৷‌ সোনিয়াকে বাদ দিয়ে নয়৷‌ হবে না৷‌ হলে ভাল হবে না৷‌

একবার এই রাজ্যের দিকে তাকান৷‌ সি পি এম তথা বামফ্রন্টের বৃদ্ধি থেকে সমস্যা৷‌ টানা ক্ষমতায় থাকার জেরে পার্টিতে সুবিধাভোগীদের সরব অনুপ্রবেশ৷‌ অসহ্য ঔদ্ধত্য নানা স্তরে৷‌ আমরা যখন এত শক্তিশালী, নিজেদের মধ্যে কোন্দল যেন চলতেই পারে৷‌ গণসংগঠনের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া৷‌ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে এখন আর কত ক্ষতি হবে? বেনোজল সরেছে, যতটুকু বাকি আছে– সরবে৷‌ লক্ষ্মণ শেঠের মতো আঞ্চলিক মনসবদাররা দলের কিছু ক্ষতি করলেও, কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উঠে আসবে নতুন নেতৃত্ব৷‌ দুর্নীতির সুযোগ নেই, ঔদ্ধত্যের জায়গা নেই৷‌ সি পি এম নেতারা জানেন, অবিলম্বে ক্ষমতায় ফেরা প্রায় অসম্ভব৷‌ তাতে কী? প্রস্তুতির সময়৷‌ শুদ্ধির সঙ্গে লড়াকু সংগঠক বেছে নেওয়ার সময়৷‌

বৃদ্ধির সমস্যা এখন ভাবাচ্ছে মমতাকে৷‌ একচ্ছত্র নেতৃত্বের জোরে সামলাচ্ছেন৷‌ স্হানীয় স্তরে উপদলীয় কোন্দল বাড়ছে৷‌ সুবিধার মধু খেতে বেনোজল৷‌বেনোজন দলে ভিড়ছে৷‌ সুসময়ের মধ্যেই জন্মাচ্ছে দুঃসময়ের চারাগাছ৷‌ সরকার চালাতে গিয়ে এই সমস্যা তাঁকে ভাবাচ্ছে৷‌ প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ঝড় না-ই বা উঠুক, হাওয়া কখনও জোরদার হতে পারে৷‌ বি জে পি-র প্রধান বিরোধী দল হওয়ার চেষ্টা বিফল করতে সি পি এম তথা বামফ্রন্ট অবশিষ্ট শক্তি নিয়ে লড়লে, পরিস্হিতির অবনতি হতেই পারে না৷‌ সুসময়ের পাপ দুঃসময়ে মুছে দেওয়ার চেষ্টা প্রবল হতেও পারে৷‌ ঠিক পথে চললে, এক সময় প্রমাণিত হবে, সুসময় আসলে দুঃসময়, দুঃসময় আসলে সুসময়৷‌ ভাল সময়ে খারাপের আবাহন৷‌ খারাপ সময়ে ভালর জন্য লড়াই৷‌

No comments:

Post a Comment